Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিকল্প বাজেটে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিবছর নতুন নতুন আঙ্গিকে ভিন্ন ভিন্ন খাতে সরকার বাজেট পেশ করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। বড় অঙ্কের বাজেট ঘোষণা করা হলেও সংশোধিত বাজেটে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়। রাজস্ব আয় ৫ লাখ কোটি টাকা ধরা হলেও ২২ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়। মোদ্দা কথা, বাজেট যা করা হয়, তার যথাযথ বাস্তবায়ন কখনোই হয় না। আসলে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী বছরের শুরু থেকে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, সময়মতো অর্থছাড় এবং যথাযথ মনিটর করা হলে বাজেট বাস্তবায়নে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এদেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের একটি সংগঠন। এ প্রতিষ্ঠানে দেশের উচ্চপর্যায়ের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, বিশ্লেষকরা দেশের অর্থনীতির সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে দেশের উন্নয়নে ও জনকল্যাণে তাদের মতামত উপস্থাপন করেন। প্রতিবছর সরকারের বাজেট ঘোষণার আগে অর্থনীতি সমিতি বিকল্প বাজেট পেশ করে সরকারকে সহযোগিতা করে। অর্থনীতি সমিতি এবার যে বিকল্প বাজেট পেশ করেছে, তা কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ-উদ্ভূত বিপর্যয়কালীন বাজেট। অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট পেশের মূল লক্ষ্য আলোকিত মানুষসমৃদ্ধ বৈষম্যহীন শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিনির্মাণ, যা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। তাই গতানুগতিক বাজেট পেশ না করে বাজেটের আয় ও ব্যয় খাতে কাঠামোগত মৌলিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করে অর্থনীতি সমিতি।

সমাজ থেকে প্রধানত চার ধরনের বৈষম্য নিরসন করা প্রয়োজন। এগুলো হলো আয়, সম্পদ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন করা। এটি করা হলে সমাজ থেকে শ্রেণিবৈষম্য দূর হওয়ার পাশাপাশি সুখী ও সমৃদ্ধ একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হলে বাজেটের আকার বড় করতে হবে। তাই অর্থনীতি সমিতি ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছে, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ১.৫৭ শতাংশ বেশি। এতবড় আকারের বাজেটের টাকা কোথা থেকে আসবে, তার উৎস দেখিয়ে দিয়েছে অর্থনীতি সমিতি। এ অর্থের সিংহভাগ সংগ্রহ হবে সরকারের রাজস্ব আয় থেকে-১০ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা, বাকি ৭.৮৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৭০ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা আসবে বন্ড বাজার, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব থেকে। বিকল্প এ বাজেটে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে বলে জানা যায়। বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে একটা বিরাট অঙ্কের অর্থ চলে যায়, যা আমাদের মতো দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বিরাট বোঝা। বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্র্ট ও কল্যাণ রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়া। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে উল্লেখিত বিকল্প বাজেট সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

অর্থনৈতিক সমিতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের অন্যতম খাত হিসাবে চিহ্নিত করেছে সম্পদের ওপর কর, অতিরিক্ত মুনাফা আদায়ের ওপর কর, পাচারকৃত অর্থ ও কালোটাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি। যদিও খেলাপি ঋণ আদায় থেকে বলা না হলেও এখান থেকেও অর্থ প্রাপ্তি হতে পারে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। পরোক্ষ কর সর্বস্তরের মানুষকে দিতে হয় বলে মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ে। সে কারণে বিকল্প এ বাজেটে পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।

লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এবারের বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জানা যায়, দেশি-বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে আমাদের অর্থনীতি। আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক বিষয়গুলো বরাবরই উপেক্ষিত হয়। বাজেটে বরাদ্দকৃত সুযোগ-সুবিধাগুলো সর্বস্তরের মানুষ সমানভাবে ভোগ করতে পারে না। বাজেটে বরাদ্দকৃত বিষয়গুলো বা সুবিধাগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে সরকারকে সমস্যার মূলে গিয়ে তা সমাধানের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শক্ত হাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠায় নিদানকালের জন্য তারা যেটুকু সঞ্চয় করেছিল তা ভেঙে খেতে হচ্ছে। খাদ্য তালিকা থেকে পুষ্টিকর খাবার কমাতে গিয়ে পুষ্টিহীনতার কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। আসছে বাজেটে মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে, যার নির্দেশনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে দিয়েছেন। বাজার পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি রোধ করে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।

মনজু আরা বেগম : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

monjuara2006@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম