Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ও ‘বিকল্প বাজেট’

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবাকারে উপস্থাপন করেন। এ বাজেটের ওপর আগামী তিন সপ্তাহ জনপ্রতিনিধিরা আলোচনা করবেন এবং এ মাসের শেষ সপ্তাহে চূড়ান্তভাবে বাজেটটি অনুমোদন পাওয়ার পর ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা; এর মধ্যে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা; ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা; আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার কথা বলা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাধারণত ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। এবারে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে ব্যাংক খাত থেকে, আর বাদবাকিটা ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে, যার মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাবদ আসবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। সরকার সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে থাকবে ঋণের সুদাসল পরিশোধে। সরকারকে এ বছর প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে কেবল ঋণের সুদাসল পরিশোধে; যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশেরও বেশি।

কেমন হলো এবারের বাজেট? এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন, যা প্রতিটি বাজেট প্রস্তাবের পরপরই করা হয়ে থাকে। এর উত্তর আপনি-আমি দিতে কিছুটা সময় নিলেও সরকারি দল ও বিরোধী দল বিবৃতি দিতে কালক্ষেপণ করে না; এবং এ বিবৃতির ধরনটিও গতানুগতিক-দায়সারা-ফরমায়েশি। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হবে এ বাজেট যুগান্তকারী ও গণমুখী; অন্যদিকে বিরোধী দল বলবে এ বাজেট গরিবমারা ও হরিলুটের বাজেট। প্রকৃত সত্য হলো, আমাদের শাসনব্যবস্থা যেমন, আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন, আমাদের শাসকগোষ্ঠী যাদের দ্বারা প্রভাবিত, বাজেটটি তেমন। এতে নতুনত্বের কিছু নেই। তারপরও দু-চারটি কথা বলতে হয়। সাধারণত প্রতিবছরই বাজেটের আকার পূর্বতন বছরের তুলনায় ১২-১৩ শতাংশ বড় হয়। এবারের বাজেট গত বছরের তুলনায় সাড়ে চার শতাংশের মতো বড় হয়েছে, তাই প্রকৃত অর্থে বলা যায়, ছোট হয়েছে। অনেকে এটাকে ভালো বলছেন এ কারণে যে, এর দ্বারা আমাদের অর্থনৈতিক সংকটকে মেনে নেওয়া হয়েছে। তবে সমস্যা রয়েই গেল। এবারও ব্যাংকগুলোতে সরকারি ঋণের চাপ থাকবে, যার নেতিবাচক প্রভাব বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর পড়বে। এবারে এনবিআরকে গত বছরের তুলনায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি আহরণ করতে হবে। যদি বিনিয়োগ না বাড়ে, শিল্পকারখানা না বাড়ে, ব্যবসা না বাড়ে, তাহলে অতিরিক্ত করের সংস্থান করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সবই ব্যর্থ ও অকার্যকর। সেজন্য বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা দরকার ছিল। এ ছাড়া দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যাংক খাতে সংস্কার, রিজার্ভ বাড়ানো, ডলার সংকট নিরসন, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে টাকা আদায়ে অগ্রাধিকার প্রয়োজন। এসব কিছু প্রস্তাবিত বাজেটে কাঙ্ক্ষিত হারে দেখা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি, অপচয়, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ না করলে সংকট সামাল দেওয়া যাবে না।’ সুতরাং, এ বাজেট আমাদের আশার আলো দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এবারে অর্থনীতি সমিতি প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটের প্রসঙ্গে আসি।

২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ‘বিকল্প বাজেট’ প্রস্তাব করে আসছে। সাধারণত সংসদে জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনার আগে আগে অর্থনীতি সমিতি এ আয়োজন করে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত ৩ জুন ঢাকায় অর্থনীতি সমিতি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ‘বিকল্প বাজেট’ উপস্থাপন করে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম এ বিকল্প বাজেট উপস্থাপন করেন। এ সময় সাংবাদিক ও সমিতির সদস্য ছাড়াও জুম মিটিংরুম, ফেসবুক, ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৬৪টি জেলা, ১৩৫টি উপজেলা, ৪৫টি ইউনিয়ন এবং বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত থেকে নানা শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং, অর্থনীতি সমিতির আয়োজনটি অনেকখানি বড় পরিসরে সম্পন্ন করা হয়েছিল।

জাতীয় বাজেটের তুলনায় অর্থনীতি সমিতির বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রম। এ বাজেট গতানুগতিক নয়। যদিও সাধারণ অর্থে আমরা বাজেট বলতে এক বছরের সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব বুঝে থাকি, কিন্তু প্রকৃত পরিধিটা অনেকখানি প্রসারিত। আপনি কোন কোন খাতে ব্যয় করবেন এবং সেই ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন কোন খাতকে করের আওতায় আনবেন তার একটা অর্থনৈতিক দর্শনভিত্তি থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ ব্যয়ের ক্ষেত্রে এবং কর আহরণের ক্ষেত্রে কোন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করবেন তার একটা প্রতিফলন বাজেটে থাকতে হয়, যা আমাদের সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটগুলোতে চোখে পড়ে না। সে কারণে আমরা বিগত পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত বাজেটকে ‘গতানুগতিক বাজেটের’ বাইরে বিবেচনা করতে পারি না। অর্থনীতি সমিতির ‘বিকল্প বাজেটের’ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। সমিতির উপস্থাপিত বিকল্প বাজেটের মূল লক্ষ্য হলো, ২০৩৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তথা ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে একটি আলোকিত-শক্তিশালী-টেকসই মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে রূপান্তরিত করা।

সমিতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যটি অত্যন্ত পরিষ্কার এবং ধারাবাহিকভাবে এ উদ্দেশ্য আগামী এক দশকে বাস্তব রূপ পাবে। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থনীতি সমিতির বাজেটের মোট আকার (পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়) ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। এ আকার আমাদের চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় দেড়গুণেরও বেশি। সরকারের আয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ ২৪ হাজার ১১২ কোটি টাকা; যা আমাদের চলতি বাজেটের আয়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। বাদবাকি ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা; যা চলমান বাজেট ঘাটতির চেয়ে প্রায় সাড়ে চার শতাংশ কম। ‘বিকল্প বাজেটের’ আকার ও আয়ের পরিমাণ দেখে বিস্মিত হওয়ার কথা। কিন্তু সমিতি তার ব্যাখ্যা দিয়েছে। অর্থনীতি সমিতি বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় বলছে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে সরকারকে সেসব উৎসে হাত দিতে হবে, যেসব উৎসে অতীতে কখনো হাত দেওয়া হয়নি অথবা প্রয়োজনমতো হাত দেওয়া হয়নি, যার অন্যতম হলো সম্পদ কর, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর, পাচারকৃত ও কালোটাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি, বিদেশি নাগরিকদের ওপর কর, বিভিন্ন কমিশন ও বোর্ড কর্তৃক আহরণ বৃদ্ধি এবং সরকারের সম্পদ আহরণের প্রচলিত বিভিন্ন উৎসে আদায়ের যৌক্তিক বৃদ্ধি।

করের ক্ষেত্রেও অর্থনীতি সমিতির দৃষ্টি অত্যন্ত পরিষ্কার। সাধারণত দুই ধরনের কর থেকে সরকার আয় করে থাকে-একটি হলো পরোক্ষ কর এবং অন্যটি প্রত্যক্ষ কর। পরোক্ষ করের নেতিবাচক ফল সাধারণ আয়ের মানুষকে প্রভাবিত করে। অপরদিকে প্রত্যক্ষ করের প্রভাব কেবল সামর্থ্যবানদের ওপর পড়ে। অর্থনীতি সমিতির মতে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মধ্যে এখন পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়, যা মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ায়। তাই পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিতে হবে এবং দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত মানুষকে আগামী কয়েক বছর আয়কর বেষ্টনীর বাইরে রাখতে হবে।

অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেটে গতানুগতিক বাজেটের বাইরে যে দিকটা উল্লেখযোগ্য, তা হলো-পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়ের আনুপাতিক হার। প্রচলিত বাজেটগুলোতে উন্নয়ন বরাদ্দের তুলনায় পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। চলতি বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ৩২ শতাংশ আর পরিচালন ব্যয় ৬৮ শতাংশ। অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ শতাংশ আর উন্নয়ন ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ সমিতির বাজেটের উন্নয়ন-পরিচালন অনুপাত প্রচলিত বাজেটের অনুপাতের বিপরীত।

সুশাসনের অভাব ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিষয়টি অর্থনীতি সমিতির দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। অর্থনীতি সমিতির হিসাব ও তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৫০ বছরে এদেশে পুঞ্জীভূত মোট কালোটাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এবং এ পাঁচ দশকে মোট পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। সমিতি মনে করে, যদি সরকার ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে কালোটাকার মাত্র শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং পাচারকৃত টাকার মাত্র শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ উদ্ধারের সুযোগ রাখে, তাহলে উদ্ধারকৃত অর্থের পরিমাণ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা হবে সরকারের বাড়তি আয়।

অর্থনীতি সমিতির বাজেটের আকার এবং সরকারের আয়ের পরিমাণ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলার সুযোগ রাখবেন। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ সমিতির দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুমোদন করি। যে কোনো প্রস্তাব করার এখতিয়ার সমিতির আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা সমিতির নেই, আছে সরকারের। সুশাসন ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সরকারের; রাজনৈতিক সদিচ্ছার দায় সরকারের। তা না হলে যা হবে সমিতির ভাষায়, অর্থনীতি সমিতি মনে করে, অন্য কোনো ধরনের বাজেট দিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাঙ্ক্ষিত উত্তরণ-রূপান্তর সম্ভব নয়। বিকল্প বাজেট বাস্তবায়ন করলে আগামী ১০ বছরের মধ্যেই একদিকে বিপজ্জনক বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে স্বল্প-বৈষম্যপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব, যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দরিদ্র-বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি-অবস্থান থেকে শক্তিশালী-টেকসই একটি মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণি-অবস্থানে উত্তরণ-রূপান্তর ঘটাবে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম