মুখ থুবড়ে পড়া গণতন্ত্রকে দাঁড় করানো প্রয়োজন
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
হুমকিধমকি দিয়ে এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করে হয়তো অনেক তাৎক্ষণিক লাভ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ইতিহাসকে নির্বৃত্ত করা যায় না। সত্যের কাছে পৌঁছার জন্য ইতিহাসের থাকে অনন্ত প্রচেষ্টা। কিছু সময় হয়তো মানুষকে ভুলের আবর্তে রাখা যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য বেরিয়েই আসে। রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙতে ভাঙতে এখন শূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
গণতন্ত্র নামে যা এখন প্রকাশ্য, তা এক রকম গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা। অথবা বলা যায়, গণতন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে বা গণতন্ত্রের চাদর মুড়িয়ে স্বেচ্ছাতন্ত্রের শক্তিমান হওয়া। দুর্নীতি প্রতিপালন করে গণতন্ত্রের পরিচর্যা সম্ভব নয়। এ দেশে বিভিন্ন শাসনপর্বে গণতন্ত্রের নামে স্বেচ্ছাতন্ত্র এমন জেঁকে বসেছে যে, গণতান্ত্রিক আচরণ অলীক বস্তুতে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র এখন আটকে আছে নির্বাচনি খাঁচায়। তাও নির্ভেজাল থাকেনি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেত। কিন্তু তেমনটি কার্যত দেখা যায়নি। নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং নানা কৌশলে নির্বাচন গড়াপেটার মধ্য দিয়ে ফলাফল শক্তিমানের পক্ষে আনাকে আর যা হোক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রকাশ বলা যায় না।
অনেক আগে থেকেই জাল ভোটার তালিকা, নির্বাচনে টাকা ও শক্তির জোরে ভোট কেনা, জাল ভোটে ব্যালট বাক্স ভরা, এসবের বাস্তবতায় মানুষ নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এর ফল আমরা বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং চলমান উপজেলা নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করছি। নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে মানুষ আর ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হচ্ছে না। এর সুবিধা নিচ্ছে বিএনপি। বলছে তাদের নির্বাচন বর্জনের ডাকে মানুষ সাড়া দিয়েছে। বাস্তবতা হলো, মানুষ এমনিতেই আগ্রহ হারিয়েছে। বিএনপির কৃতিত্ব নেওয়ার কিছু নেই। বরং বিএনপি নানা ছুতোনাতায় নির্বাচন বর্জন করে যাচ্ছে। এটিও গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।
বিএনপির মতো একটি বড় দল গণতান্ত্রিক দায়িত্ব মেনে যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ আছে বলে ভোটারের প্রাণচাঞ্চল্য অনেক বেশি দেখা যেত। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রচর্চা করা প্রাচীন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নেতারাই তো বলেছিলেন ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’। এভাবে গণতান্ত্রিক আচরণ থেকে আওয়ামী লীগই যখন দূরে সরে গেছে, সেখানে বিএনপির কাছ থেকে গণতন্ত্রচর্চা আশা করব কেন? সব নির্বাচনের আগেই ভীতি পেয়ে বসে বিএনপি নেতাদের মাথায়। এদেশের বাস্তবতায় নির্বাচনি যুদ্ধের মাঠে সক্রিয় থেকেই এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বিএনপি নেতাদের অভিমান দেখলে মনে হয়, তাদের জেতার নিশ্চয়তা দিলেই তারা নির্বাচনে আসবে। তাই বলতে হবে, নির্বাচনি ব্যবস্থা নষ্ট করার পেছনে বিএনপির দায়ও কম নয়।
এসব কারণেই বলা যায়, গণতন্ত্র শক্তভাবে দাঁড়াতে না পারার পেছনে রয়েছে আমাদের ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা দলগুলোর ব্যর্থতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙার অপরাধে ইতিহাস তাদের কখনো ক্ষমা করবে না। কঠিন দলতন্ত্রে আটকে থাকায় এবং সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির চারণভূমিতে পরিণত করায় এখন আর সম্ভব নয় গণতন্ত্রের পরিচর্যা করা। তাই বলা যায়, ক্ষমতাপ্রত্যাশী বর্তমান রাজনীতিকদের হাতে গণতন্ত্রের অগ্যস্তযাত্রাই হয়ে গেল! অথচ এ দেশে গণতন্ত্রচর্চার ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন।
সাত শতকজুড়ে মাৎস্যন্যায়কালে অরাজকতায় ডুবন্ত দেশকে রক্ষার জন্য নতুন অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অভিজাতরা। শত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় সে সময়ের প্রজন্ম অভিশপ্ত সিংহাসনে বসতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু রাজ সিংহাসন তো খালি থাকতে পারে না। এ অবস্থায় অভিজাতরা যোগ্য রাজা খুঁজে বের করার জন্য এক ধরনের নির্বাচনের পথে গেলেন। সব দিক বিচারে তাদের সম্মতিক্রমে রাজা করা হলো সেনাবাহিনীর সদস্য গোপালকে। এভাবে পাল রাজত্বের গোড়াপত্তন হয়। এরপর থেকে আধুনিক গণতান্ত্রিক কাঠামো হয়তো তৈরি হয়নি, কিন্তু জনগণকে মূল্য দিয়েই শাসকরা রাজ্য শাসন করতেন।
মধ্য যুগের বাংলার সুলতানগরা জনগণের শক্তিকে শ্রদ্ধা করতেন। আমাদের দেশের কপট রাজনীতিকদের মতো কথায় কথায় ‘জনগণ’ নামজপ করতেন না। যেমন-বিএনপি নেতারা বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করব। পরক্ষণে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির আন্দোলন প্রতিহত করব। প্রকৃত জনগণ খুঁজে বেড়ায় এসব অদৃশ্য জনগণের অস্তিত্ব। গণতান্ত্রিক বোধ কোনো পক্ষে না থাকায় উভয়পক্ষ জন-ইচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে ‘জনগণ’ শব্দটিকে নিয়ে লোফালুফি করে।
চৌদ্দ শতকের মাঝ পর্বে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণাকারী সুলতানদের প্রতিহত করতে দিল্লির সুলতানরা বাংলার জনগণের সমর্থন আশা করেছিলেন। তাই তারা যুদ্ধের আগে বাংলার জনগণের সামনে প্রচারপত্র জারি করে বলতেন, আমরাই বৈধ মুসলিম শাসক, বাংলার সুলতানরা বিদ্রোহী-অবৈধ। আবার দিল্লির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাংলার সুলতানরা স্থানীয় মানুষের সমর্থন পেতে নানাভাবে চেষ্টা করতেন। এমনকি আরবি লিপিতে কলিমা খোদাই করা মুদ্রার এক পিঠে হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতীকও উৎকীর্ণ করতেন। অর্থাৎ বহির্ভারতীয় সুলতানদের মধ্যে একধরনের গণতান্ত্রিক বোধ কাজ করলেও বর্তমানে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা মঞ্চশোভন শব্দ ছাড়া গণতান্ত্রিক আচরণ দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কঠিন দলতন্ত্রে আটকে থাকলে গণতন্ত্রকে বাঁচানো যায় না। এ কারণেই সব কিছু খুইয়ে শেষ পর্যন্ত কোনোভাবে নির্বাচনি গণতন্ত্রের সামান্য কিছু দলীয় সরকারগুলো টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। সেখানেও চরম স্খলন ঘটেছে এখন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এদেশের বড়সংখ্যক মানুষ হতাশ হয়ে এখন ভোট দিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ডাকে নয়-আরও আগে থেকেই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার। নির্বাচনি সংঘাত এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেনি। দীর্ঘকাল ধরে এদেশের মানুষ নির্বাচনি সংঘাত দেখে অভ্যস্ত। নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি আগে-পরে দেখেছে। কিন্তু যখন থেকে মানুষ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছে, নির্বাচন এর আপন নিয়মে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হচ্ছে না, তখন থেকে ভোটকেন্দ্রবিমুখ হচ্ছে নামুষ। মানুষ দেখেছে সরকারের প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন নীতিহীনভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে এবং সরকার থেকে এর পুরস্কার হাতে হাতে পেয়ে যাচ্ছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা আধিপত্য বিস্তার করে ভোটারের ভোট নিজেরাই দিয়ে দিচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনে ভোটারের রায়ের প্রতিফলন ঘটছে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এবার নির্বাচনগুলোয় দেখলাম আমার ঘনিষ্ঠজন, যারা উৎসবের আনন্দ নিয়ে ভোট দিতে যেত, তারা অনেকেই ভোট দিতে যায়নি। সবার মুখে একই কথা আওয়ামী লীগের তিনজন দাঁড়িয়েছে, এদেরই কেউ না কেউ নির্বাচিত হবে। আমি ভোট না দিলেও ফলাফল একই হবে। তাই বিনা কারণে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই।
কোনো দলই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। ক্ষমতায় থেকে সব দলই নিজের মতো করে নির্বাচন গড়াপেটা করতে দ্বিধা করেনি। আজ যে বিএনপি নেতারা এত কথা বলছেন, তারা কি মাগুরা নির্বাচন করেননি? শেষ পর্যন্ত তা হজম করতে পারেননি অবশ্য। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আজিজ সাহেবের সময় কি লাখ লাখ ভুয়া ভোটারের তালিকা তৈরি হয়নি? আসলে ক্ষমতাসীন সব দলই এদেশের গণতন্ত্রের অগ্যস্তযাত্রা ঘটিয়ে শেষে টিমটিমে জ্বলা নির্বাচনি গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরেছে।
এ অবস্থা ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ধীরে ধীরে প্রশাসনিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নতি দেখিয়ে এ ভাঙন রোধ করা সম্ভব নয়। আমলাতন্ত্র ও বণিকতন্ত্র শক্তিশালী হতে হতে রাজনীতিকদের আত্মিক শক্তি দুর্বল করে দেবে। রাজনীতিকরা এদের ক্রীড়নক হতে বাধ্য হবেন। বিদেশি শক্তিগুলো সহজে নাক গলানোর মওকা পেয়ে যাবে।
আমাদের ক্ষমতাধর রাজনীতিকরা বুঝতে চান না, যতই ক্ষমতার দাপট দেখান না কেন, কঠিন দলতন্ত্র বজায় রেখে এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন কমাতে না পারলে রাষ্ট্র ও দেশের সব প্রতিষ্ঠান ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে পড়বে। একসময় খসে পড়তে থাকবে একেকটি অঙ্গ। তখন লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়বে। সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন রাজনীতিকদের আত্মম্ভরিতার উচ্চাসন থেকে নেমে এসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর আর কোনো বিকল্প নেই। উটপাখির মতো ‘আজকের বিপদ এড়াতে পারলেই টিকে যাব’-এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
দলতন্ত্র আর দুর্নীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেরুদণ্ড কুরে খাচ্ছে। সরকারি ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এবং শিক্ষার ভার মুক্তচিন্তার শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের হাতে না থাকায় ভুল পথে খেই হারাচ্ছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা। দুর্নীতি বিষ ছড়াচ্ছে আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অসহায়ত্ব এখন সবার চোখের সামনেই উন্মোচিত। বিদেশে অর্থপাচারের জোয়ার দুর্বৃত্তায়িত পরিবেশে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। রোধ করা যায়নি রিজার্ভ চুরি। প্রবাসীরা সরকারি মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে ভরসা পাচ্ছে না। কমে যাচ্ছে প্রবাসী আয়। বিদেশি ঋণের টাকা শোধ করতে হচ্ছে ঋণ করে। এসব নেতিবাচক অবস্থার তো একটি বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী। তেমন অবস্থা মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ কি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক সরকারগুলো করতে পারবে।
দুঃখ এই, এখন তীরে এসে তরি ডোবার দশা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বহির্বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্যের পথ ধরে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ২০৪০ সালে উন্নত দেশে পৌঁছার স্বপ্নকে মানুষ এখন স্বপ্নকল্পনা ভাবছে না। কিন্তু তবু ঈশান কোণে জমাট কালো মেঘ আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। রাজনীতিতে গণতন্ত্রচর্চা ফিরিয়ে না আনতে পারলে স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা তো থেকেই যাচ্ছে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com