শতফুল ফুটতে দাও
নজরদারির পুঁজিবাদ ও নাগরিক স্বাধীনতা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড মোটর কোম্পানি এবং জেনারেল মোটর্স পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নতুন ধারার প্রবর্তন করে। এ ধারাটি হলো বিশাল ও ব্যাপক গণ-উৎপাদনভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পুঁজিবাদ। দেখা গেছে, নতুন ধরনের অর্থনৈতিক যুক্তি এবং এগুলোর বাণিজ্যিক মডেল আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের ট্রায়াল এবং এর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আমাদের সময়ে গুগল নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে অগ্রনায়ক, আবিষ্কারক, ধ্যান-ধারণার সম্প্রসারণকারী, পরীক্ষণকারী, অগ্রগামী বাস্তবায়নকারীর। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে? এর ভূমিকা হচ্ছে নজরদারি পুঁজিবাদের রোল মডেল এবং তার বিস্তৃতি ঘটানোর আড্ডা হিসাবে। জেনারেল মোটর্স এবং ফোর্ড তাদের উদ্ভাবনার মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদের আইকনে পরিণত হয়। এর ফলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে পণ্ডিতরা গবেষণা করার তাগিদ অনুভব করেন। সাধারণ মানুষও তাদের প্রতি আকৃষ্টবোধ করেন। কেননা এ নামকরা কোম্পানিগুলো অন্য কোম্পানিগুলোর জন্য শিক্ষা গ্রহণের উৎস হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। সাম্প্রতিককালে গুগল যা করছে, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সংগত। এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্য শুধু গুগলের সমালোচনা করা নয়। এটা প্রয়োজন কীভাবে গুগল একটি শক্তিশালী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চয়ন ঘটাচ্ছে তা বোঝার জন্য।
ফোর্ড ও জেনারেল মোটর্সের হাতে গণ-উৎপাদনের বিজয় সূচিত হওয়ার পর শত শত গবেষক, ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব, প্রকৌশলী, সাংবাদিক ও পণ্ডিত খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন কী পরিস্থিতিতে এদের আবিষ্কার, উৎপত্তি এবং তা থেকে পরিণতিগুলো সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক দশক পর পণ্ডিতরা ব্যক্তি ফোর্ড এবং তার কোম্পানি নিয়ে ব্যাপকভাবে লিখেছেন। জেনারেল মোটর্স সম্পর্কেও একই ধরনের গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। পিটার ড্রাকার তার মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের জন্য জেনারেল মোটর্সকে বেছে নিয়েছিলেন। এ অনুসন্ধান থেকেই ১৯৪৬ সালে তিনি ‘কনসেপ্ট অফ দ্য করপোরেশন’ নামক কালজয়ী গ্রন্থটি রচনা করেন। এ গ্রন্থে বিংশ শতাব্দীর ব্যবসা সংগঠনের প্র্যাকটিসগুলো কোডিফাই করেন। এর ফলে ড্রাকার ব্যবস্থাপনার গুরু হিসাবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। একদিকে যখন উল্লিখিত দুটি কোম্পানির ওপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা ও বিশ্লেষণ চলছিল, তার পাশাপাশি কোম্পানি দুটির নেতৃত্ব তাদের আবিষ্কার এবং অনুশীলনের বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এভাবে মার্কিন পুঁজিবাদের বিবর্তনের চিত্র নানা গবেষণা, পর্যালোচনা এবং বিচার বিশ্লেষণে উঠে আসে।
গুগল ভয়ংকর ধরনের গোপনীয়তার আশ্রয়ী একটি কোম্পানি। এটা বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন যে, ড্রাকার বা তার সমকক্ষ কেউ গুগলের দৃশ্যপট এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে সক্ষম হবে। এর নির্বাহীরা সাবধানতার সঙ্গে তাদের Messages of Digital Evangelism বই পুস্তক এবং ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে তুলে ধরেন। কিন্তু কোম্পানিটি কীভাবে কাজকর্ম চালায়, তা গবেষক এবং সাংবাদিকদের দৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণভাবে আড়াল করে রাখা হয়। ২০১৬ সালে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার এক অভিযোগে মামলা করে জানান দিয়েছিলেন যে, কোম্পানিটির ভেতরে একটি গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড চালু আছে। এ গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির কর্মচারীরা এর গোপনীয়তা সংক্রান্ত চুক্তি কীভাবে অমান্য করছে। এভাবে গুগল তার অভ্যন্তরীণ গোপনীয়তা রক্ষা করে। প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ হাল ভ্যারিয়ান দীর্ঘদিন গুগলের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসাবে কাজ করেছেন। তার কিছু পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ থেকে ইঙ্গিত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করতে পারি। ভ্যারিয়ানকে বলা হয় Googlenomics-এর অ্যাডাম স্মিথ এবং তিনি এর বিজ্ঞাপন মডেলের গডফাদার। ভ্যারিয়ানের কাজ থেকে নজরদারির পুঁজিবাদের যুক্তির গোপন ইঙ্গিতগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা আরও বুঝতে পারি কীভাবে নজরদারির পুঁজিবাদ ক্ষমতার আসনে বসেছে।
ভ্যারিয়ান পাণ্ডিত্যপূর্ণ জার্নালে দুটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধগুলোর আলোচ্য বিষয় ছিল কম্পিউটারের মধ্যস্থতায় লেনদেন এবং আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর এর রূপান্তরকারী প্রভাব। দুটি লেখা খুবই ভদ্র ভাষায় এবং বাস্তবধর্মী গদ্যে রচিত হয়েছে। কিন্তু ভ্যারিয়ান কিছু বিষয় চেপে গেছেন, যা তার যুগান্তকারী ঘোষণার বিরুদ্ধে যায়। তিনি বলেছেন, ‘অধুনা কার্যত সব লেনদেনের মাঝখানে অবস্থান করছে একটি কম্পিউটার। এ কম্পিউটারগুলোর রয়েছে আরও বহুবিধ ব্যবহার।’ হাল ভ্যারিয়ান কম্পিউটারের চার রকমের ব্যবহার চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো-‘Data extraction and analysis,' 'New contractual forms due to better monitoring,' 'Personalization and customization' এবং 'Continuous experiments’.
ভ্যারিয়ানের আলোচনা থেকে যে চার ধরনের ব্যবহারের কথা উঠে এসেছে, সেগুলোই অচিন্তনীয়ভাবে নজরদারির পুঁজিবাদের অদ্ভুত যুক্তির নিয়ামকরূপে দাঁড়িয়ে গেছে। এর ফলে মানুষের শেখার ব্যাপারটি বিশেষ আকার ধারণ করেছে এবং এর ফলে যে তথ্য সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে, তার মধ্যে ধীরে ধীরে সবাই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এখনকার জগৎ ও জীবনকে বুঝতে হলে আমাদের নজরদারির পুঁজিবাদের লেন্স ও পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। ভ্যারিয়ান বলছেন, উপাত্ত আহরণ এবং বিশ্লেষণ নিয়ে সবাই কথা বলছেন। আর এ কথা বলাটা হলো ‘বিগ ডাটা’। ডাটা বা উপাত্তকে নজরদারির পুঁজিবাদ কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে। এ ডাটার ব্যবহার রয়েছে পুঁজিবাদের পবিত্র ম্যানুফ্যাকচারিং প্রক্রিয়ায়। এক্সট্রাকশান বা আহরণ দিয়ে বোঝা যায় সামাজিক সম্পর্কগুলো কী এবং কেমন ধরনের এবং বস্তুগত অবকাঠামোর স্বরূপটাই বা কী। এর মাধ্যমে ফার্মগুলো উৎপাদনের আয়তনজনিত আর্থিক সুবিধা ও কাঁচামাল সরবরাহের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
অ্যানালাইসিস বা বিশ্লেষণ বলতে বোঝায় খুবই উচ্চ মার্গের জটিল বিশেষায়িত কম্পিটিশনাল সিস্টেম। এটাকেই বলা হয় মেশিন ইন্টেলিজেন্স বা যন্ত্রের বুদ্ধি। আজকাল যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) কথা বলা হয়, এটা তাই। এটা এক ধরনের আমব্রেলা ফ্রেইজ, কারণ এটা দিয়ে আমরা গাছগুলো না হোক বনটিকে ধরতে পারব। এ ফ্রেইজ অনুসরণ করার ফলে গুগল কোন পথে যাচ্ছে তা অনুসরণ করা সম্ভব। গুগল দাবি করে, যন্ত্রের বুদ্ধির উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে এর অবস্থান সর্বাগ্রে। যন্ত্রের বুদ্ধির মধ্যে রয়েছে যন্ত্র দিয়ে শেখা এবং তার সঙ্গে রয়েছে ক্লাসিক্যাল অ্যালগরিদমভিত্তিক উৎপাদন। এটাকে পূর্ব ধারণা সৃষ্টিকারক বিশ্লেষণ অথবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৃষ্টান্ত হিসাবে গুগল ভাষাগত অনুবাদ, কণ্ঠস্বর চিহ্নিতকরণ, দৃষ্টিগোচর প্রক্রিয়াকরণ, র্যাংকিং, পরিসংখ্যানগত মডেলিং এবং পূর্বানুমান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব সমুদয় কাজে আমরা বৃহদাকারে আমাদের উদ্দিষ্ট সম্পর্কগুলোর স্বাক্ষর সংগ্রহ করি। দেখা যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগামী দিনগুলোতে অনেক কাজেই ব্যবহৃত হবে। ভালো এবং মন্দ দুটিই। কিন্তু মন্দ কাজে ব্যবহার বিপজ্জনক হতে পারে, সেটাই আজ সুধীজনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের শাসক দল ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এর ফলে নাগরিকরা হয়তো বেশকিছু সুবিধা পাবে। তবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যন্ত নজরদারি করার ক্ষমতাও সরকার অর্জন করছে এবং করবে। শোনা যায়, তৃতীয় দেশের মাধ্যমে ইসরাইলে প্রস্তুত অতি উচ্চমানের আড়িপাতার যন্ত্র সরকার আমদানি করেছে। একটি সরকার যখন জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তখন তাকে নির্ভর করতে হয় গোয়েন্দা তথ্যের ওপর, যা এখন অত্যাধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তি দিয়ে উদ্ঘাটন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিকরা নজরদারি থেকে বাঁচার জন্য হোয়াট্সঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারের আশ্রয় নেয়। শোনা যাচ্ছে, ইসরাইলের প্রযুক্তি দ্বারা এ অ্যাপগুলোর গোপনীয়তা ভেদ করা সম্ভব। এক কথায় বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোকে ক্ষমতার আসনে জেঁকে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ