Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

যে ট্রেন ছেড়ে যায় না স্টেশন

Icon

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্টেশনে পৌঁছাতে খুব ঝক্কি পোহাতে হলো। স্টেশনটি কিন্তু মানুষের জীবন বদলে দেয় কিংবা নিদেনপক্ষে নতুন একটা দর্শনের সন্ধান দেয়। হ্যারি পটারের সিনেমার সেই দৃশ্যের মতো কোনো গোপন প্ল্যাটফর্ম না হলেও সেখানে যাওয়া খুব একটা সহজ নয়। অনেক পথ ঘুরে, অনেক ধ্যানের পর সেখানে যেতে হয়। তবে সবাই সেই পথের সন্ধান পায় না। কেউ কেউ পায়। আমি যে কোনোদিন পাব, সেটা আসলে ভাবতেও পারিনি। কিংবা পেলেও আমি যে সত্যি স্বপ্নের স্টেশনে যেতে চাইব কেবল একটা ট্রেনে ওঠার জন্য, যে ট্রেন আদতে কখনো স্টেশন ছেড়ে যায় না, সেটাও আসলে আমি কোনোদিন ভাবিনি, পরিকল্পনাও করিনি। কোন দৈব পথে আমি স্টেশনের সন্ধান পেলাম সেটা বলতে গেলে গল্পটা অনেক বড় হয়ে যাবে। তবে আমার বন্ধু বিনায়ক যেবার সড়ক দুর্ঘটনায় পা দুটো হারিয়ে ফেলল এবং তার কয়েকদিন পরেই তার প্রেমিকাও মরে গেল, সেই বিনায়ক আমাকে বলেছিলে তুই বেঁচে থাকতে চাইলে ও পথে যেতেই হবে।

আমার গোপন পরিচয়টা বিনায়ক জানে এবং জানে মানুষ খুন করা আমার একটা অভ্যাস ও কাজ। আর সেই অভ্যাসের গ্লানির কথাও টুকটাক হয়তো আন্দাজ করতে পারে।

তুই কি আমাকে ঘৃণা করিস?

বিনায়ক বলে, ঘৃণা কিন্তু এমন একটা অনুভূতি, যা কোনো কল্যাণ বা শান্তি বয়ে আনে না। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানুষকেও ঘৃণা করতে নেই। তবে আমি এখনো ওই স্তরে যেতে পারিনি দেখে যারা মানুষের কষ্ট দেখে আনন্দ পায়, তাদের হয়তো ঘৃণা করে ফেলি। বিনায়ক এত ভারি কথা বলার মানুষই না। কিন্তু স্টেশনের রাস্তা জেনে যাওয়ার পর আমাকে এসব সে বলে এবং আমাকে এটাও জানিয়েছে খুব দ্রুতই হয়তো সবকিছু গুটিয়ে ওখানেই সে চলে যাবে এবং আমিও যেন যাই, হয়তো সেখানে আমি শান্তি খুঁজে পাব।

স্টেশনের ভবনটা দেখলে কার্জন হলের কথা মনে হয়। বড় লাল ইটের দালান। তবে লাল রংটা এখানে একেবারে রক্তের মতো উজ্জ্বল। প্রথমে দেখেই মনে হলো, কেউ বোধহয় কিছুক্ষণ আগেই ভবনের বুকে ছুরি বসিয়ে গেছে। বিনায়ক যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে, ওভাবেই প্রবেশ করলাম। একটা বড় গাছের গুঁড়ি রাখা আছে প্রবেশপথের মূল দরজার সামনে। ওখানে গিয়ে গুঁড়িটাকে জড়িয়ে ধরতে হবে এমন করে, যেন গাছ ও বুকের মধ্যে কোনো জায়গা বাকি না থাকে। আমি তাই করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খুলে গেল।

একটা নীল ফুলের বাগান দেখতে পেলাম, তার পাশেই একটা পুকুর এবং পুকুরের পাড় ধরে চলে গেছে একটা রাস্তা। এখন আর ভবনের কোনো অস্তিত্ব নেই। মুহূর্তেই যেন পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। বিনায়ক নিশ্চিত ছিল, আমি শেষধাপটাও পার করতে পারব এবং স্টেশনটি আমাকে ঢোকার অনুমতি দেবে।

তুই কীভাবে নিশ্চিত?

বিনায়ক হাত-হাঁটু চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দিয়েছিল, তোর প্রেমিকা তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাছাড়া, এত এত মানুষকে কষ্টে রেখে তুই সত্যিই ভালো নেই।

তাহলে তুই বলতে চাচ্ছিস, সত্যিকারের কষ্ট যাদের আছে, তারাই কেবল যেতে পারবে? তাহলে কি সবার যেতে পারার কথা নয়? কষ্ট কার নেই?

না, সবাই যেতে পারবে না।

কেন?

কারণ, সবাই কষ্টে থাকে না।

আমি বিনায়কের কথাটার মর্ম এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। যদি সত্যি কথাই বলি, আমার কি এমন কষ্ট? রুয়েনা বলেছিল, আমার কষ্টটা একটা ভান। নিজের কাছে নিজেকে নিরপরাধ রাখার কৌশল। রুয়েনার কথা আমি উড়িয়ে দিতে পারিনি এবং সেই কথাটাই বিনায়ককে জানালাম।

তুই যেতে পারবি। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।

এখন সত্যিসত্যি ভেতরে এসে কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমি একটা স্টেশনে এসেছি। যেই স্টেশনের একটা ট্রেনে আমাকে উঠতে হবে এবং একটা স্লিপিং বার্থে গিয়ে ঘুমোতে হবে। তারপর আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করব, যেই স্বপ্নটা আসলে আমার নয়। কিন্তু কেন আমি অন্যের স্বপ্ন দেখার জন্য এত অস্থির হয়ে উঠলাম? একদম শেষ সময়ে এসে সব নিরর্থক মনে হতে থাকে।

দুই

বিনায়কের কথামতো আমি একটা বগিতে উঠলাম। মানুষের ছায়া দূরে থাক, একটা পোকামাকড়ও যেন নেই। বোঝাই যাচ্ছে বগিটা পরিত্যক্ত। সরু পথ। কারণ একপাশ ধরে পুরোটাই স্লিপিং বার্থ। সবশুদ্ধ ৬টা হবে। এরকম করে করে আমি অনেক বগি পার হলাম। আমাকে বিনায়ক বলেছিল, যেটা দেখলে মনে হবে, ওখানে কেউ আছে, সেই বার্থের দরজা খুলে আমাকে ঢুকে পড়তে হবে।

এতক্ষণ ধরে হাঁটছি অথচ তেমন কোনো বার্থ মনে ধরল না। এতক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমার ভীষণ পানির পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু ট্রেনে উঠে যাওয়ার পর পানি খাওয়া বারণ।

কেন?

পানি ধ্যানের জন্য ক্ষতিকর, স্বপ্নের জন্য ক্ষতিকর।

এমন অদ্ভুত যুক্তি আমি কখনো শুনিনি। অবশ্য যে ভ্রমণে আমি বের হয়েছি, তারচেয়ে অদ্ভুত আর কী হতে পারে? সুতরাং, সঙ্গে পানি থাকলেও খেতে পারছি না।

আমি এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন মানুষকে হত্যা করেছি, তার হিসাব রাখিনি। আমার গুরু বলেছিলেন, মানুষের রক্তের হিসাব রাখতে হয় না। তাছাড়া এটি আমার কাজ। রুটি-রুজির ব্যাপার। এ শহরে বা এ দেশে আর কে আছে, আমার মতো যে অদৃশ্য হয়ে মানুষ খুন করতে পারে? আমার স্ত্রী বা সন্তান কেউ আমার গোপন পেশা সম্পর্কে জানে না। জানলে অবশ্যই আমাকে ঘৃণাই করত অথবা না-ও করতে পারত। আলিশান বাসা, দামি আসবাব, সম্প্রতি কেনা মার্সিডিজ নিয়ে ওরা যথেষ্ট সুখী আছে।

আমার ছেলে মাজুলের ধারণা মানুষের চিকিৎসা করেই আমি এসব উপার্জন করেছি। আমার ছাত্ররাও তাই ভাবে। মোদ্দাকথা সমাজে আমার ক্লিন ইমেজ। এতটাই ক্লিন, ওই ইমেজ বাঁচিয়ে রাখার জন্য হলেও আমি মানুষ খুন করতে পারি।

তা হলে কেন আমার গ্লানি হলো? একটা প্রেমের জন্য? একজন নারীকে খুন করার জন্য?

আমাদের বিয়েটি ছিল এরাঞ্জ ম্যারেজ। বিয়ের আগে কোনোদিন তাকে দেখিনি। তবে সংসার মন্দ যাচ্ছিল না। আমাদের ভেতরে কোনো ঝগড়া হয় না, আবার প্রেমের কথাও হয় না। একে অপরের ভালো-মন্দ খেয়াল রাখি, ভালো সময়ও কাটাই। এরপর মাজুল এলো। আমাদের জীবনটা হয়ে গেল মাজুলকেন্দ্রিক। সুন্দর ও গোছানো।

এর ভেতরে আমার অদৃশ্য হতে পারার ক্ষমতা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছড়িয়েছে। আগে যেখানে হয়তো সাতদিনে একটা খুনের বায়না আসত, সেটা দিনে একটায় গিয়ে থামে। তবে একটার বেশি হত্যার ব্যাপারে আমি রাজি ছিলাম না। সীমিত করে রেখেছিলাম, যেমন চেম্বারে আমি ২০টার বেশি রোগী দেখি না।

বিনায়ক বলেছিল, আমার প্রেমিকা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আসলে ব্যাপারটা এত সরল নয়। আমার প্রেমিকা আমার কাছে আসবে কী করে? আমি তো তাকে সেই জায়গাটা দিইনি। আমার প্রেমিকা মানে রুয়েনা একদিন খুব বাজে ব্যবহার করল। বাজে ব্যবহার করার মানুষ রুয়েনা নয়। কিন্তু একটা মানুষ আর কতদিন সহ্য করবে? আমিও করলাম। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেল, মানুষজন এলো আমাদের থামাতে। আমরা বুঝতে পারছিলাম এভাবে থাকা সম্ভব না। কিন্তু তাই বলে অদৃশ্য হয়ে রুয়েনাকে আমি মেরে ফেলব!

সেই থেকে আমি আর ভালো নেই। আমার এখন একজন অন্য মানুষের জীবন দরকার। বিনায়ক ছাড়া আমি আর কার কাছে যাব? কিন্তু ওর বুদ্ধিতে যে এখানে এলাম, মনে হচ্ছে, অনন্তকাল হেঁটে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই।

অবশেষে স্লিপিং বার্থের একটা দরজা দেখে মনে হলো এটা আমার জন্য। কারণ দরজাটা নীলের জায়গায় লাল রং করা। লাল আমার পছন্দের রং। কারণ তো সহজেই অনুমেয়। আমি দরজাটা খুললাম। একটা সাধারণ ট্রেনের স্লিপিং রুম যেমন হয়, এটা ঠিক তেমনই। জানালা শাটার দিয়ে নামানো। দুটো বার্থ আছে। একটা ওপরে এবং একটা নিচে। ছোট্ট টেবিল আছে। টেবিলের ওপর খালি একটা জগ রাখা। কম্বলও আছে। এমনকি টের পেলাম এসি চলতে শুরু করেছে। আর সময়ক্ষেপণ না করে আমি বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

তিন

বিনায়ক বলেছিল, আমার চেতনা থাকবে, কিন্তু মানুষটা আমি থাকব না। আমার অন্য একজনের স্বপ্নের ভেতরে চলে যাওয়ার কথা অথবা ইনসেপনশন সিনেমার মতো কিছু একটা হওয়ার কথা। কিন্তু আমি স্পষ্ট টের পেলাম, এর কোনোটাই আমার সঙ্গে হচ্ছে না। আমি নিজেকে আবিষ্কার করি, আমার ঘরের সামনে।

দরজায় বেল দিতেই রিনিমা দরজা খুলে দেয়। পেছন থেকে মাজুল এসে আমাকে জাপটে ধরে।

বাবা, এসেছে! আজকে আমার জন্য কী এনেছ?

আমি পকেট হাতড়ে ওর জন্য কিটক্যাটের ছোট একটা প্যাকেট বের করি। স্বপ্নের ভেতরে থাকা সত্ত্বেও আমি জানি কিটক্যাট কোথায় থাকবে। এরপর ঠিক কী কী ঘটবে তা-ও আমার জানা। আমাকে রিনিমা গোসল করে আসতে বলবে, বলবে এসে দ্রুত খেয়ে নাও, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ঘুমিয়ে পড়ব এবং তার পর আমাকে আজকের খুনের জন্য বের হতে হবে, কেননা ততক্ষণে মোবাইলে আজ রাতে কাকে খুন করতে হবে তার পুরো বর্ণনা চলে আসবে। হলো ঠিক তাই।

রিনিমা এবং মাজুল ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি একছুটে ঘর থেকে বের হলাম। বিনায়ক আমাকে এভাবে ভুল তথ্য দিল? বিনায়কের বাড়ির দারোয়ান আমাকে চেনে। দেখতেই স্যালুট দিয়ে দরজা খুলে দিল। আমি এক ছুটে বিনায়কের ঘরে চলে গেলাম। ওর ঘরের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। ঢুকে দেখি বিনায়ককে ব্লো জব দিচ্ছে, রিনিমা যে রিনিমাকে আমি একটু আগে ঘুমে দেখে এসেছি। ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। দরজার পাশে চুপটি করে বসে পড়লাম। দেখতে থাকলাম ওদের। দুই পা হারানো বিনায়ককে ব্লো জব দেওয়ার দৃশ্যটি সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, রিনিমা অনন্তকাল ধরেই কাজটা করে যাচ্ছে, শেষ হচ্ছে না। বিনায়কের এতো স্ট্যামিনা!

স্বপ্ন থেকে উঠে আসব নাকি আরও কিছুক্ষণ দেখব? বুঝতে পারি না। এটাও বুঝতে পারি না, এ স্টেশন ছেড়ে বাড়িতে গিয়ে আমি কী করব? পালিয়ে যাওয়া সম্ভবত আমার জন্য নয়।

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম