Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ভ্রুমধ্যসাগর : গোধূলিঘোড়ার অপার্থিব হ্রেষা

Icon

আহমেদ বাসার

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভাষার বিশদ ভাঙাগড়া আর বোধের নান্দনিক বিভায় নির্মিত কাব্যসৌধ ভ্রুমধ্যসাগর। আলোচ্য গ্রন্থে কবি নাঈম ফিরোজ এক অধরা ভাষাভঙ্গির সন্ধান পেয়েছেন, যা একই সঙ্গে মনোগ্রাহী ও লক্ষ্যভেদি। আধুনিক কবিতার ক্লান্তি, জরা ও একাকিত্বের সুদীর্ঘ সাঁকো পেরিয়ে কবি এ গ্রন্থে পৌঁছে যান পোস্টমডার্ন কবিতার আলো-অন্ধকারে। এখানে তিনি কান পেতে শুনতে পান দূর ক্যাভালরির গান। অস্তমন্ময়তায় দেখেন উড়ে যাচ্ছে ফুজিয়ামা, হিমালয় ও তূর। আর সূর্যফাল্গুনী দিনে ঝিলম জলের দিকে টের পান উননীল শালুকের দুল।

পোস্টমডার্ন কবিতা মানব সভ্যতার মহান আখ্যানগুলো খারিজ করে দিয়ে প্রান্তমুখীন যাত্রা অভিলাষী। জার্মান দার্শনিক হ্যাবারমাসের ‘Modernity: An Incomplete Project’ প্রবন্ধে মহান মানব আখ্যানের ভাঙনে হতাশার সুর শোনা যায়। কিন্তু উত্তরাধুনিক ধ্যান-ধারণায় বিষয়টি উদযাপনের আবহে ধরা দেয়। ‘Answering to the question: what is postmodernism?’ প্রবন্ধে ফ্রাঁসোয়া লিওতার গ্র্যান্ড ন্যারেটিভগুলোর ভাঙনের উল্লাসকেই উত্তরাধুনিকতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থে ‘খারিজ করে দেবো’ কবিতায় কবি বলেন, ‘কীভাবে মানুষের মুখের দিকে তাকাতে হয় জানা নেই’। মানবীয় ভূগোল ভুলে কবি বরং যোগ দেন ‘পাখিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়’। কিংবা দেখেন ‘লেটুস অন্ধকারে কান কামড়ে নাবে অন্ধ সন্ধ্যা’।

মনে ভেসে ওঠে টি এস এলিয়টের ‘Love Song of J. Alfred Prufrock’ কবিতার চমকে দেয়া পঙ্ক্তিমালা-

Let us go then, you and I

When the evening is spread out Against the sky

Like a patient etherised upon a table.

নাঈমের কবিতায় দেখি-শামাদান থেকে গলে গিয়ে সন্ধ্যা/ কার কানে দুলেছিলো হয়ে/ উননীল শালুকের দুল।

এলিয়ট সন্ধ্যাকে টেবিলে শুয়ে থাকা রোগীর বিবর্ণতায় দেখেছেন। নাঈমের কবিতায় সন্ধ্যা শালুকের দুল হয়ে দোলে। লক্ষণীয়, শালুক প্রান্তিক গ্রামবাংলার প্রতিনিধিত্বশীল উপকরণ।

পোস্টমডার্ন কবিতা যুক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়ে অযৌক্তিক বাস্তবতার এক অভিনব বিশ্বে পাঠককে নিয়ে যায়। ‘অবিকল বিকাল’ কবিতায় কবি বলেন-‘কিছুদিন এমন যায় নির্ভানায়/ এহেন অ-বিকালে একটা আর্য কাক/ ফেলে গেলো তার নিয়নপেন্সিলে আঁকা/ গ্রাফাইটের মতো খুব সুধাময় ছাই শরীর। ‘এখানে যুক্তির কাঠামোর ভাঙনের সুর শোনা যায়। কিংবা ‘পলান টুক টুক’ কবিতায় ‘এই আলোহীন আকাশ / মূলত ভাতের নাকচ করা অবৈধ সন্তান’ পঙ্ক্তিটিও এক্ষেত্রে উল্লেখ্য।

পোস্টমডার্ন কবিতা শব্দ ব্যবহারে সংস্কারমুক্ত। দেশি, বিদেশি, প্রমিত, আঞ্চলিক সব শব্দই অনায়াসে ঢুকে যায় তার সর্বগ্রাসী ও সর্বগ্রাহী শরীরী সীমায়। আলোচ্য গ্রন্থে শব্দ ব্যবহারে কবি সর্বত্রগামী। নির্দ্বিধায় তিনি ব্যবহার করেন ‘জেরক্স রৌদ্রশালবন’, ‘ডেমিগড’ কিংবা ‘লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ’। একই সঙ্গে তিনি লেখেন, ‘বাইজা ওঠে সাইরেন’, ‘রাত্তির যায় যায় কারবালায়’, অথবা, ‘থাউকগা এইসব’ জাতীয় আঞ্চলিক শব্দাবলি। মিথ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সর্বত্র বিচরণশীল। তার কবিতায় বেহুলা, মহুয়া, রাধার যেমন দেখা মেলে, তেমনি দেখা যায় মেডুসার সর্পবিনুনি, জিউসের শান্ত আস্তিন আর নেফারতিতির ঈর্ষার অনুরণন।

কিছু কবিতায় শব্দ নিয়ে চমৎকার খেলায় মেতেছেন কবি। অনুপ্রাসের দ্যোতনায় শব্দগুলোকে তিনি ভিন্নমাত্রায় বাজিয়েছেন।-অন্ধ কারে/ অন্ধকারে / অন্ধ কারা/ হত্যা করে।

কবিতায় বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ধর্মশাস্ত্র ও ইতিহাসের অপূর্ব উদ্ভাসন ঘটেছে আলোচ্য গ্রন্থে। এখানে দেখা মেলে ‘ভারী আইসোটোপের আচ্ছাদন’, ‘ক্যাথারসিসের শিস’, ‘সিদরাতুল মুনতাহার মহিম গাছ’ কিংবা ‘পিডোপাইলদের পুলক’ ও ‘ঈশ্বরগুঞ্জন’-এর মতো শব্দ ও শব্দগুচ্ছ। পাশাপাশি বাংলার ঔপনিবেশিক অবদমনের ইতিহাস নয়া ভাষারূপ পায় এখানে। কবির ভাষায়-‘হেমরোদের স্পার্ম চুরি করেই জং ধরা ব্রিটিশ সকালও / একটানা একটা অবশ অবৈধ উপনিবেশ পেটে ধরে আছে’ (ভূমধ্যরাস্তায়)।

নাঈম ফিরোজের ভ্রুমধ্যসাগর প্রণয় প্রকাশেও নতুনত্ব সন্ধানী। ভূমধ্যসাগরের আদলে তিনি দেখেন প্রেয়সীর ভ্রুমধ্যসাগর-‘আমি অসংযত নোঙর ফেলেছি/ তোমার ভ্রুমধ্যসাগরে’ কিংবা জনান্তিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন-‘আমাকে ভালোবেসে মরে যে/ তাকে পাখি করো কেন? (তুমি যারে ডানা করো)।

ভ্রুমধ্যসাগর কাব্যে বিষয়কেন্দ্রিকতা ভেঙে পড়ে। বহুমাত্রিক অনুভবের অনুরণনে প্রান্তমুখী ভাবনাদুয়ার খুলে দেয় আলোচ্য গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা। বাংলা কবিতার প্রথাগত রক্ত-শিরায় গ্রন্থটির স্পন্দন দূরগামী হোক এ প্রত্যাশা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম