Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

নিজেই সেরা লেখক এমন আত্মম্ভরিতার প্রসার ঘটছে: তপন বাগচী

Icon

ফরিদুল ইসলাম নির্জন

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তপন বাগচী। কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার এবং লোকসংস্কৃতিবিদ। ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর মাদারীপুর জেলার মাতুলালয়ের কদমবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তুষ্টচরণ বাগচী ও মাতা জ্যোতির্ময়ী বাগচী। তার সহধর্মিণী ঢাকা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক কেয়া বালা। তূণী ও ছুটির বাবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন, পরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাত্রাগানের ওপর গবেষণায় পিএইচডি লাভ করেন। কর্মজীবনে সাংবাদিকতা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। কাজ করেছেন প্রথম সারির পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের পরিচালক হিসাবে কর্মরত। তার প্রকাশিত ৮৫টি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেতকীর প্রতি পক্ষপাত, সব নদীর নাম গঙ্গা ছিল, চিরবিরহের মোহ, কলঙ্ক অলঙ্কার হইল, মুজিব-নামে রক্তদামে, চরকাবুড়ি ওড়ায় ঘুড়ি, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, পুরাণের তিন নদীর গল্প। সাহিত্য অবদানের জন্য সুনীল সাহিত্য পুরস্কার, জেমকন কথাসাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার, নজরুল পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার অর্জন করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন

আপনার পড়া প্রিয় উপন্যাস কোনটি?

: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’।

বইটি কখন কীভাবে সংগ্রহ করেছেন?

: মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার কদমবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে এটি সংগ্রহ করেছিলাম। আমি আর বন্ধু অজিত সরকার ছিলাম বইয়ের পোকা। গ্রন্থাগারের সব গ্রন্থই আমাদের দুজনের পাঠের আওতায় ছিল।

কী কী কারণে বইটি আপনার প্রিয়?

: যে বয়সে দেবদাসকে ভালোবেসেছি, তখন তো আর কারণ খুঁজিনি। দেবদাস-পার্বতীর গভীর প্রণয়, তাদের প্রণয় পরিণয়ে রূপ না-পাওয়া, অভিমানে দেবদাসের নিরুদ্দেশ হওয়া, মদের নেশায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে, বন্ধু চুনীলালের দৌত্যে বাইজি চন্দ্রমুখীর সুশ্রূষা লাভ করা এবং চন্দ্রমুখীর কাছে পার্বতীর কথা বলতে-বলতে নিজেই চন্দ্রমুখীর প্রেমে পড়ে যাওয়ার দ্বন্দ্ব ও দ্বৈরথ আমার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হয়েছে। লেখকের ভাষায়-‘এমনি করিয়া একবার পার্বতী, একবার চন্দ্রমুখী তাহার হৃদয়রাজ্যে বাস করিতেছিল’। পার্বতীর বিয়ে হয় বিপত্নীক এক জমিদারের সঙ্গে। দেবদাস যখন শোকে-বিরহে কাতর হয়ে মৃত্যুমুখে উপনীত, তখন সে গরুর গাড়িতে করে হাতিপোতা গ্রামে পার্বতীর বাড়ির ঘাটে এসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার হাতে উলকি দিয়ে লেখা ছিল নাম ‘দেবদাস’। পাঠকের প্রতি তাকিয়ে শেষ অনুচ্ছেদে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহ-করস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে-যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’ এটুকু পাঠ করার পর কেঁদেছি। বলতে পারেন যে, কাঁদবার জন্যই আমি বারবার দেবদাস পড়ি।

পাঠক বইটি কেন পড়বে? আপনার বিবেচনায় কী কী শিল্পগুণে সমৃদ্ধ বইটি?

: আমার মতো কেঁদে সুখ নেওয়ার জন্য পড়বে। এ কাহিনির জনপ্রিয়তার একটি চিত্র বলি। ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেবদাসকে নিয়ে। ১৯০০ সালে রচিত হলেও এটা গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে। ১৯২৮ সালে এটি পর্দায় আসে নরেশ মিত্র পরিচালিত নির্বাক চলচ্চিত্র হিসাবে। ১৯৩৫ সালে এটি চলচ্চিত্রায়ণ করেন নিজেই নায়ক হয়ে, নায়িকা ছিলেন যমুনা দেবী। ১৯৩৬ সালে একে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করেন কুনন্দলাল সায়গল ও যমুনা দেবীকে নিয়ে। পরের বছর তিনিই দেবদাসকে অহমিয়া ভাষায় নির্মাণ করেন ফণী শর্মা ও জুবাইদা বেগমকে কেন্দ্রে রেখে। বাংলাভাষায় ৫টি চলচ্চিত্র আছে দেবদাসকে নিয়ে। বাংলাদেশেও ২ বার এ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন একবার বুলবুল-কবরী ও আরেকবার শাকিব-অপুকে নিয়ে। ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানে ৩ দেশে ৭টি ভাষায় মোট ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে দেবদাস উপন্যাস নিয়ে। একশ পেরিয়ে গেলেও এর পাঠক কিংবা চলচ্চিত্রায়ণ থেমে থাকেনি। এ উপন্যাস এত সরল ও সহজ ভাষায় লেখা যে, পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন। কাহিনিবিন্যাস এবং সংলাপ এত লাগসই যে, মনে হবে নিজেই চরিত্র হয়ে উঠেছি। শ্রেণিদ্বন্দ্বের কারণে কত গভীর প্রেম যা পরিণয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়, এ উপন্যাস তারই দলিল। দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েও যে প্রথম প্রেম মরে না, দেবদাস তারই প্রমাণ। শেষ দৃশ্য এতই করুণ, আবার এতই প্রেমময় যে, পাঠকমাত্রই অশ্রুসজল হয়।

এমন বই এখন সচরাচর লেখা হয়? হলে উল্লেখ করেন, না হলে কেন হচ্ছে না বলে মনে করেন?

: এমন উপন্যাস সচরাচর লেখার সাধক-লেখক কই? সংখ্যা ও সংস্করণ বিচারে দেবদাসের চেয়ে বেশি বিক্রীত উপন্যাস হয়তো লেখা হয়েছে। কিন্তু, পাঠের পরও মস্তিষ্কে অনুরণন তোলা এবং শতবর্ষ পেরিয়েও দাগ কেটে রাখার মতো কাহিনি-বুনট তো পাচ্ছি না। তাৎক্ষণিক আবেগের বিষয় নিয়ে অনেক উপন্যাস লেখা হয়েছে, মৃত্তিকালগ্ন কাহিনি লেখা হয়েছে কিন্তু তাতে আবেগের চিরন্তনতা নেই। হয়তো পাঠকের আবেগের স্তরও পরিবর্তিত হয়েছে।

আপনার লেখা আপনার সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটি?

: প্রথম কবিতার বই ‘কেতকীর প্রতি পক্ষপাত’, গীতিকবিতার বই ‘কলঙ্ক অলঙ্কার হইল’, ছড়ার বই হচ্ছে ‘মঙ্গা আসে ঘরের পাশে’, কিশোর গল্পের বই হচ্ছে ‘সাতদিনের সাতকাহন’, প্রবন্ধের বই ‘সাহিত্যর সাম্প্রতিক পাঠ’ এবং গবেষণার বই ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান’ জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’।

কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি সবখানেই আপনার বিচরণ। কোনটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

: মনের টানে-প্রাণের টানে কবিতাই লিখতে এসেছিলাম। আমার ভেতরের শক্তি আমাকে কবিতা লেখায়। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি কবিতা লিখতেই। অন্যান মাধ্যমে আমার কাজ তো কবিতাবোধেরই সম্প্রসারণ।

ভালো বই নির্বাচনে পাঠকরা কোন বিষয়টি বিবেচনা করবে?

: বইটি পড়ার পরও যদি মনের ভেতরে অনুরণন টের পাওয়া যায়, তবে মনে করতে হবে ওটা ভালো বই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম