Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

থেমে গেল বিশ্বসাহিত্যের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যেখানে সব আছে আবার কিছুই নেই, এমন অ্যারিথমেটিকের নামই জীবন। সে জীবনে প্রেমিকের মতো শান্ত চরণে নেমে আসে মৃত্যুর অভিঘাত। জীবনের বিপরীত প্রান্তে বেড়ে ওঠা এ মৃত্যুর কাছেই থেমে যায় কলমের আঁচড়। ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে লিখে চলা ইসমাইল কাদারের কলম ১ জুলাই থেমে গেছে ৮৮ বছর বয়সে। পরলোকে যাত্রা করা ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ জয়ী এ সাহিত্যিকের জীবনকে দ্য গার্ডিয়ান এবং ওয়াশিংটন অবলম্বনে ফিরে দেখেছেন মেজবাহ উদ্দিন

ইসমাইল কাদারে ১৯৩৬ সালের ২৮ জানুয়ারি আলবেনিয়ার জিরোকাস্টারে একটি বুদ্ধিজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে মস্কোর গোর্কি সাহিত্য ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। মস্কো থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার পর প্রথমে সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ম্যান বুকার পুরস্কারজয়ী ইসমাইল কাদারের নাম নোবেল পুরস্কারের তালিকায় এসেছে অনেকবার। তার লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়ে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু তিনি দ্রুত উপন্যাস ও ছোটগল্পের দিকে মনোনিবেশ করেন। তার রচনায় আলবেনিয়ার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। দীর্ঘ ৬০ বছরের সাহিত্যিক জীবনে ইসমাইল কাদারে উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ ও বেশ কিছু নাটক রচনা করেছেন। কাদারের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘ক্রনিকল ইন স্টোন’, ‘দ্য ব্রিজ উইথ থ্রি আর্চেস’, ‘ব্রোকেন এপ্রিল’, ‘দ্য প্যালেস অফ ড্রিমস’। তবে তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’ তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এ উপন্যাসটি একজন ইতালীয় জেনারেলের গল্প, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলবেনিয়ায় তার মৃত সৈন্যদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এটি সাবেক ইতালি এবং ফ্রান্সের অভিজাত শিক্ষিত ব্যক্তি ইউসুফ ভ্রিওনিরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যিনি এটি ফরাসিতে অনুবাদ করার প্রস্তাব দেন। ভ্রিওনি ২০০১ সালে তার নিজের মৃত্যু পর্যন্ত কাদারের সব কাজ অনুবাদ করতে থাকেন এবং তার নাম কাদারের ক্যারিয়ারের গল্প থেকে আলাদা করা যায় না।

কাদারে আলবেনিয়ান সাহিত্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন এবং আলবেনিয়ান ইতিহাস ও সংস্কৃতির জটিলতাগুলো তুলে ধরেছেন। তার লেখায় তিনি আলবেনিয়ার সমাজের বিভিন্ন দিক, যেমন-ঐতিহ্য, আধুনিকতা, রাজনীতি এবং মানবতা তুলে ধরেছেন। তার সাহিত্যকর্মগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, যা তাকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দিয়েছে। ইসমাইল কাদারে তার সাহিত্যের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী কণ্ঠ তৈরি করেছেন, যা পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং আলবেনিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির জটিলতা উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। তার লেখায় কাব্যিক ভাষার ব্যবহার এবং গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ লক্ষণীয়। কাদারের রচনায় তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করেছেন, যা আলবেনিয়ার জনগণের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের কাহিনি তুলে ধরে।

ইসমাইল কাদারে আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট শাসনের সময়েও লেখালেখি করেন। তার রচনা প্রায়ই সামাজিক ও রাজনৈতিক ত্রুটি তুলে ধরত, যেখানে থাকত কমিউনিস্ট শাসনের কঠোর সমালোচনা। আলবেনিয়ার স্বৈরশাসক এনভার হোক্সার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন ইসমাইল কাদারে। ‘ব্রোকেন এপ্রিল’ ও ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’র মতো উপন্যাসে রূপক ও বিদ্রুপকে আশ্রয় করে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি।

যদিও হোজার আলবেনিয়ার মতো শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে কাদারের বেঁচে থাকা নিয়ে পশ্চিমের কিছু লোক তার বিপক্ষে আপসের অভিযোগ তুলেছিল। সংসদে তার সদস্যপদ, যেখানে তিনি কখনো উপস্থিত হননি, কিছু লোককে ভুলভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল যে, তিনি শাসকের প্রতি সহানুভূতিশীল। এটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে যে এ সন্দেহগুলো ছিল ভিত্তিহীন। একনায়কদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় আলবেনিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ইসমাইল কাদারেকে দেশদ্রোহী তকমা দিয়েছিল। নব্বই দশকের শুরুতে আলবেনিয়া ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান কাদারে। এক যুগ পর ২০০২ সালে আবার দেশে ফেরেন।

‘ব্রোকেন এপ্রিল’ সম্ভবত ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি পড়া কাদারের উপন্যাস। জাতীয় মিথ এবং কিংবদন্তিতেই কাদারের আশ্রয়-উদাহরণস্বরূপ ‘দ্য ঘোস্ট রাইডার’ জাতীয় পরিচয়কে পুনরুজ্জীবিত করে এবং লোক ঐতিহ্য ও ধর্মকে দমন করার প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে। কাদারে সমসাময়িক সাহিত্যে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না; তিনি এসকাইলাস এবং বায়রন-এ বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কাদারের বেশির ভাগ কাজ ৪০টিরও বেশি ভাষায় পাওয়া যায়, তবে বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং প্রচুর ছোটগল্প এখনো ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়নি।

ইসমাইল কাদারে ছিলেন তার প্রজন্ম এবং অন্যান্য সব প্রজন্মের সবচেয়ে পরিচিত আলবেনীয় লেখক এবং আমাদের যুগের অন্যতম অসাধারণ ইউরোপীয় ঔপন্যাসিক। তিনি এমন একটি কাজের সংকলন রেখে গেছেন যা বালজাকের ‘মানবিক কমেডি’র মতো বিশাল, একনায়কতন্ত্রের সমালোচনায় অরওয়েলের মতো অবিচলিত এবং কাফকার মতো উদ্বেগজনক।

নতুন প্রজন্মের লেখকরা তার রচনাকে অনুসরণ করে আলবেনিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে কাজ করছেন। কাদারের সাহিত্যকর্ম আলবেনিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য একটি মূল্যবান সূত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। কাদারের রচনায় নারীদের চরিত্রগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলো সাধারণত শক্তিশালী ও সাহসী, যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে নিজেদের অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এ নারীরা কাদারের রচনায় আলবেনিয়ার সমাজের বাস্তবতা ও সংগ্রামের প্রতিফলন।

নিকোলাই গোগোল, জর্জ অরওয়েল, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মিলান কুন্ডেরা এবং বালজাকের সঙ্গে প্রায়ই তার লেখার তুলনা করা হয়। তার বইগুলো হারিয়ে যাওয়া বলকান জীবনকে আশ্রয় দিয়েছে। ইসমাইল কাদারে তার সাহিত্যিক অবদানের জন্য বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০৫ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার, ২০০৯ সালে প্রিন্সেস অফ অ্যাস্টুরিয়াস পুরস্কার, ২০১৫ সালে জেরুজালেম পুরস্কার এবং ২০২০ সালে নিউস্ট্যাড আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক সাহিত্য পুরস্কার জিতেছেন কাদারে। এছাড়া ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক লেখালেখিতে আজীবন অবদানের জন্য তিনি আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড পান। শুধু নোবেল তাকে এড়িয়ে গেছে। ইসমাইল কাদারের সাহিত্যকর্ম শুধু আলবেনিয়ার নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের পাঠকদের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হয়। কাদারের রচনা পাঠকদের মননকে উদ্দীপিত করে এবং তাদের মানবতার গভীরতা সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। কাদারের ৮০টিরও বেশি উপন্যাস, গল্প, কবিতার সংকলন এবং প্রবন্ধগুলো একটি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ গঠন করে, যা আলবেনিয়ান হওয়ার মানে কী তা আবিষ্কার এবং প্রতিফলন করে। নিঃসন্দেহে তার সঙ্গেই চলে গেছেন ইউরোপের শেষ জাতীয় লেখক। ‘মৃত্যু জীবনের শেষ পৃষ্ঠা হলেও, সেই পৃষ্ঠায় লেখা থাকে স্মৃতির অপার শোভা।’ ইসমাইল কাদারের অপার শোভাময় সে স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

সুত্র : দ্য গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম