Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

ঘাতকের আত্মকথন

Icon

মইনুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লোকটা আমাদের উপস্থিতি আশা করেনি। আশা করার কথাও নয়। কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই মেইন ডোরের সিকিউরিটি লক ভেতর থেকে এঁটে দিয়ে কাশেম যখন তাকে চেয়ারে বসিয়ে কপালে পিস্তল ঠেকাল, সে কিছু বুঝতে না পেরে বোকা বোকা চোখে একবার আমার দিকে একবার কাশেমের মুখের দিকে তাকাল।

লোকটা বরকত, একজন সাংবাদিক। তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না। জনি শিকদার আমাকে যা বলেছে, আর আমাকে যা করতে হবে, আমার কাজের জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। আমি বরকতের কাছে এগিয়ে গেলে সে এবার আমার দিকে স্থীর চোখে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, কে আপনারা? কী চান?

লয়েড ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানী রিপোর্টটা চাই। বের কর। আমার কঠিন কণ্ঠস্বরে সে খুব বিচলিত হলো না বোধ হয়। অজ্ঞতার ভান করে শান্ত গলায় বলল, এ রকম কোনো রিপোর্ট তো আমার কাছে নেই। প্রচণ্ড থাপ্পড়টা ওর গালে পড়তেই একপাশে কাত হয়ে গেল সে। সে অবস্থায় চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। ওর চোখে মুখে ভয় কাজ করছে।

আজ দুই মাস হলো রিপোর্টটা তুমি তৈরি করেছ, তুমি জানবে না কেন? রিপোর্ট বের কর। আমি চাপা গলায় ধমকে উঠলাম। বোধ হয়, শব্দ পেয়েই পাশের রুমের পর্দা সরিয়ে এক তরুণী বের হয়ে এসেছে। আমাদের এভাবে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠতে চাচ্ছিল, কাশেম দ্রুত তার কাছে গিয়ে তার চুলের মুঠি চেপে ধরল। হিংস্র গলায় বলল, চিৎকার করলে খুন করে ফেলব। চুপ, মুখ বন্ধ। মেয়েটি, বরকতের স্ত্রী হবে, কাশেমের মুখের দিকে ভীত, বিভ্রান্ত চোখ মেলে রেখে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে উদ্বেগ আর আতঙ্কে মিশানো চিৎকারটা সে গলার ভেতর আটকে রেখেছে।

বরকত এবার স্ত্রীর দিকে মুখ ফেরাল। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। মাথা নুইয়ে কিছু ভাবছে সে। আমি ওর শার্টের কলার চেপে ধরলে মুখ খুলল সে। বিড়বিড় করে বলল, বললাম তো, এ রকম কোনো রিপোর্ট সম্পর্কে আমি জানি না। হিংস্র শ্বাপদ শিকারের গতিবিধি লক্ষ করতে যেমন করে শিকারের ওপর চোখ গেঁথে রাখে, একইভাবে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হলো সে মুখ নিচু করে আমার ক্ষুরধার চাহনি থেকে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করছে।

একাত্তরের এক রাতে রাজাকারের তাড়া খেয়ে আমি নেমে গিয়েছিলাম নদীর খাঁড়িতে। সেটা ছিল কৃষ্ণপক্ষের রাত, অন্ধকার ভীষণ। দূর থেকে তাকিয়ে মনে হলো শহরটা লোমশ কালো দৈত্যের মতো উবু হয়ে বসে অনুজ্জ্বল নীল আলোর অজস্র আধবোজা চোখ মেলে আমাকে দেখছে। আমি কোথায় লুকিয়েছি সেটা তার জানা আছে।

খাঁড়ির চারপাশে ছড়ানো উৎকট একটা গন্ধ ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমার নাকে বিঁধতে লাগল। সামান্য নড়াচড়া করতেই মনে হলো আমার পা পিচ্ছিল কাদায় দেবে যাচ্ছে। চরম বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের ইন্দ্রিয় ভয়ানক রকম সজাগ হয়ে ওঠে। আমি অনুভব করছিলাম আমার চোখের দৃষ্টি, আমার শ্রবণশক্তি, বোধশক্তি প্রবলভাবে জেগে উঠছে। আমি বুঝতে পারলাম কাদা নয়, মানুষের গলিত অবশিষ্টাংশে পা রাখায় আমার পা পিছলে যাচ্ছে।

মৃত্যু যখন তাড়া করে তখন নিজেকে বাঁচানোর তাগিদটা বোধ হয় বেশি করে অনুভব করা যায়। নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তাই তখন মুখ্য বলে মনে হয় আর তাই ঘরে অসুস্থ স্ত্রী রোশনীকে রেখে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম, রাজাকারদের নাগালের বাইরে। বুড়িগঙ্গার খাঁড়িতে, দম আটকে যাওয়া পচা গন্ধ আর গলিত শবের ভেতর আত্মগোপন করে ছিলাম রাতভর। শেষ রাতের দিকে ঘরে ফিরে রোশনীর লাশ পেয়েছিলাম। মেঝের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে ছিল। নিষ্প্রাণ, উলঙ্গ, ছিন্নভিন্ন, মুখটা দরোজার দিকে ফেরানো, নিথর চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। সে কি দরজার দিকে তাকিয়ে আমার অপেক্ষা করছিল? রোশনীর মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ছিলাম, আর তখন আমার প্রিয় কুকুর লিরা কোথা থেকে এসে মুখ উঁচু করে কুঁ কুঁ শব্দে আমার মুখ চাটতে লাগল। প্রচণ্ড ক্রোধের আগুনে আমার গা পুড়ে যাচ্ছিল। আমার ভেতর কাউকে খুন করার ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কুকুরটাকে কাছে টেনে ওর গলা চেপে ধরলাম। লিরা ছটফট করতে করতে বিস্ফারিত, অবিশ্বাস্য চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে এক সময় পায়ের কাছে নেতিয়ে পড়ল।

কখনো কখনো এ দৃশ্যটা চিন্তায় এলে আমার মাথায় নরকের আগুন জ্বলে ওঠে। আমাকে উন্মত্ত করে তুলে। চিন্তাটা মগজের ভেতর সাপের বাচ্চার মতো কিলবিল করতে থাকে। আমার মধ্যে খুনের নেশা জাগিয়ে দেয়। বস্তুতপক্ষে রোশনীর মৃত্যুর পর থেকে, সেই ভয়াল রাতের দুঃস্বপ্ন থেকে খুনের একটা নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে। এটা একটা অদ্ভুত নেশা। নৃশংস নেশা। আমার এই নেশার রহস্য বোধ হয় জনি সিকদার বুঝতে পেরেছিল। তাই বেছে বেছে সে শিকারের সন্ধানগুলো আমাকেই দেয়। ভারতীয় ঠগীদের দর্শনে আমি বিশ্বাসী নই তবু কখনো কখনো মনে হয়েছে শিকারের ভাগ্যই বোধ হয় তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়, খুন হওয়ার জন্য। জনি শিকদার একটা নিমিত্ত মাত্র।

মেয়েটি এখন ফুঁপাতে লেগেছে। আমি তার দিকে তাকালাম। ফর্সা মুখে লতিয়ে নেমেছে কালো কোঁকড়ানো চুলের গুচ্ছ। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে বলে হয়তো ঠোঁটটা সামান্য ফাঁক করে রেখেছে। দেখা যাচ্ছে দুধ-সাদা দাঁতের সারি। আমি তার চোখে মুখে ভয় এবং ঘৃণার মিশ্র অনুভূতির ছাপ দেখলাম। সে বুঝতে পারছে তার মৌচাকের মতো পুরুষ্ট বুকে আমার চোখের দৃষ্টি লেহন করছে। কাঁপা হাতে ওড়নাটা বুকের ওপর টেনে দিল সে। কারও মুখ খুলতে এবং মুখটা চিরতরে বন্ধ করতে খুন একটা উপযোগী অস্ত্র। আমি কাশেমের দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করলাম। মেয়েটাকে হিরহির করে টেনে পাশের রুমে ঢুকল সে। ভেতর থেকে ঝাপটাঝাপটির শব্দ আসছে।

এতে কাজ হলো। লক্ষ করলাম, বরকতের মুখ থেকে ঘৃণার ভাবটা চলে গেছে আর ভয়ের ছায়াটা গাঢ় হয়েছে। আমিও চাই ভয়টা ওর মনে থেকে যাক, জোঁকের মতো তাকে কামড়ে ধরে থাকুক। ফ্রিজে রাখা মাংসের মতো ধীরে ধীরে ভয়টা ওর মুখটাকে হীম-শীতল রক্তশূন্য আর ফ্যাকাশে করে তুলুক। পেশাদারি খুনিরা ভিকটিমের চোখে মুখে ভয়ের এ রংটা দেখে আনন্দ পায়। আমি অনেকবার অনেকের মুখে এ রং দেখেছি, আর উপভোগ করেছি দারুণ।

আমাদের হাতে সময় নেই। রিপোর্টটা বের কর। আমি কঠিন গলায় বললাম। মনে হচ্ছে বরকত তবু দোটানায় দুলছে। পেছন থেকে ওর পিঠে প্রচণ্ড লাথি ঝাড়লাম। কোঁত শব্দ করে আছড়ে পড়ল সে মেঝের ওপর তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসল। পাশের রুমের পর্দার ওপাশ থেকে অস্ফুট গোঙ্গানির শব্দ আসছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে বললাম, বুঝতে পারছ কী হচ্ছে? ওকে থামাতে হলে রিপোর্টটা চাই।

নিজেকে রক্ষার সুযোগ যখন থাকে না, মুক্তির কোনো উপায়ও থাকে না, তখন শিকার নিজেকে শ্বাপদের ধারালো দাঁতে ছেড়ে দেয়। আমি এ রকম একটা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বরকতের মধ্যে সেই ধস নামল অল্প সময়েই। সে দুর্বল হাত তুলে টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করল। ওখানে ল্যাপটপ রাখা আছে। পাওয়ার অন করা। মনিটরে হালকা নীল ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুটে আছে একটা ছবি। প্রকাণ্ড মিশমিশে কালো মহিষের গলা কামড়ে ধরে ঝুলে আছে সিংহটা। বড় বড় দুই চোখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে মহিষটা তাকিয়ে আছে। মহিষটার চোখের দৃষ্টিতে কী ভাসছে-বিভ্রান্তি? কষ্ট? নাকি বাঁচার নীরব অসহায় আকুতি? মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সব প্রাণীই বোধ করি বুঝতে পারে বেঁচে থাকার স্বাদ কতখানি প্রত্যাশার।

বরকত পর্দা থেকে মুখ ফেরাল, আমার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল, আগস্ট।

বুঝলাম সে পাসওয়ার্ড বলছে। আমি পাসওয়ার্ড বসালাম তারপর স্ক্রিন টপকে ফোল্ডারের ভেতর চোখ মেলে দিলাম।

কালপুরুষ। পাশ থেকে বিড়বিড় করে বরকত বলল।

কালপুরুষ নামের ফোল্ডারের ভেতর ঢুকতেই আমার ভেতরটা আনন্দে থইথই করে উঠল। রিপোর্টটার ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করে বগলে নিলাম। দরোজা খুলে প্যান্টের জিপার লাগাতে লাগাতে কাশেম বের হয়ে এসেছে। চোখ টিপে জানাল কাজ শেষ। আমার কাজও শেষ।

বরকত কার্পেটে কাত হয়ে শুয়ে ডাঙায় তোলা মাছের মতো মুখটা গোল করে বাতাস গিলছে, চোয়ালটা নাড়ছে অল্প অল্প। আমি দরোজার কাছে গিয়ে মুখ ফেরালাম। সে গিরগিটির মতো গলা উঁচু করে আমাদের চলে যাওয়া দেখছে। আমি ওর চোখে স্বস্তির ঝিলিক জ্বলে উঠতে দেখলাম তবে সেটা মুহূর্ত মাত্র, খুব কাছ থেকেই কাশেমের পিস্তল থেকে ছোড়া গুলি দুটো ওর শরীরে বিঁধল। পিঠটাকে দুবার ধনুকের মতো বাঁকা করল সে। দুই হাত মেঝের ওপর ছড়িয়ে, পেছন দিকে খানিকটা ছেঁচড়িয়ে মাথাটা কাত করে মেঝের ওপর নামাল। বসের নির্দেশ কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষীকে রেখে আসা যাবে না।

শহরতলীর এ এলাকাটা বেশ নির্জন। এখনো পুরোপুরি বসত গড়ে ওঠেনি। চারপাশে গাছগাছালিতে ঠাসা। ডালপালার ওপর ঝুঁকে আছে রাতের আকাশ। নক্ষত্রের নীল চোখগুলো দপদপ করে জ্বলছে। কার্তিকের বাতাসে কেঁপে উঠছে নারিকেলের পাতা। কাশেম মাফলার দিয়ে মুখে গালপট্টি বেঁধেছে। কালো প্যান্টের ওপর কালো জ্যাকেটে তাকে একটা ঢ্যাঙা ভূতের মতো লাগছে। সে তাকিয়ে আছে দূরে- গাছগাছালির ডালপালায় ছিটকে পড়া হেডলাইটের আলোর দিকে। বসের গাড়িটা দ্রুত এগিযে আসছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বগলের নিচে ল্যাপটপটা চেপে আছি। ভয়ংকর একটা দলিল সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো এই ক্ষুদ্র ডিভাইসটায় আত্মগোপন করে রয়েছে। আমি জানি বস এটা হাতে পাওয়ার জন্য কেমন অস্থির হয়ে রয়েছে।

মালটা দে। জনি সিকদার গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল। আমি বিশ্বস্ত বান্দার মতো ল্যাপটপটা তার হাতে তুলে দিলাম।

গাড়ি ছুটছে। জনি সিকদার সামনের সিটে কাত হয়ে, ঘাড় গুঁজে, ল্যাপটপের ভেতর সেঁদিয়ে গেছে। আমার কাছ থেকে পাসওয়ার্ডটা নিয়ে হামলে পড়েছে সে ল্যাপটপের অন্তঃপুরে। নিবিষ্ট মনে রিপোর্টটা খুঁজছে। আমি ওর ভাবসাব লক্ষ করছি। এক সময় অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মুখ তুলে তাকাল সে, বলল, রিপোর্টটা তো দেখছি না। কোথায় সেটা?

আমি হন্তদন্ত হয়ে ঝুঁকে পড়লাম ল্যাপটপের ওপর। স্ক্রিনের নীল আভায় সাঁতরাতে সাঁতরাতে আমার চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে উঠল। খুব বিব্রত বোধ করছি। জনির গরম চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, রিপোর্টটা কালপুরুষ ফোল্ডারে ছিল। ফোল্ডারটা তো এখানেই দেখেছিলাম। আমার নিজেরই তো অবাক লাগছে। ফোল্ডারটা গেল কোথায়! জনির দুই চোখ দিয়ে যেন টগবগ করা গেসিয়ারের গরম বাষ্প বের হতে লাগল।

বৃষ্টি থেমে গেছে এখন। কালো পিচের ওপর ছিটকে পড়ছে গাড়ির হেডলাইটের হলদে আলো। খোলা জানালায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ঠান্ডা বাতাস। সঙ্গে বৃষ্টির ছাঁট। গাড়ি চালাচ্ছে কাশেম। কালো পাজেরোটাকে রেসের ঘোড়ার মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে। ভিউফাইন্ডারে ওর হুডিতে ঢাকা ভাবলেষহীন কঠোর মুখটা দেখতে পারছি।

দূরে আলোর বুদবুদ নিয়ে খেলছে শহরটা। সেদিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি লিস্ট থেকে রিপোর্টসহ ফোল্ডারটা গেল কোথায়? ব্যাপারটা ধোঁয়াশার মতো লাগছে। লয়েড ইন্টারন্যাশনালের দুর্নিতিগ্রস্ত একটি প্রকল্পের এমন পাকাপোক্ত রিপোর্টটা এভাবে বেমালুম উবে যাওয়ার রহস্যটা কী?

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম