Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ঢাকার উনিশ-বিশ

Icon

প্রত্যয় সরকার

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম খানের ঢাকের শব্দের ঢাকা নাকি বল্লাল সেনের গুপ্ত অবস্থায় প্রাপ্ত দেবী (ঢাকা+ঈশ্বরী) প্রভৃতি মতভিন্নতাকে বৈধতা দিতে ঢাকার নামের উৎস-সন্ধানে পণ্ডিতেরা ‘মতান্তরে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ‘মতান্তর’ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে কিছু গল্প বলব স্মৃতির শহর ঢাকার।

‘বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি’র ঢাকা সুপ্রাচীন নগরী। রবীন্দ্রনাথ এঁকে দিয়েছেন বৃহৎ নগরীর তকমা। ঢাকা নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তি-গাল-গল্প ছড়িয়ে আছে। এগুলোর স্থান হয় না মূল ধারার ইতিহাসে। গল্পগুলো মিশে আছে ঢাকার ইট-পাথরে, রিকশার টুং-টাং শব্দে, হারানো মসলিনের ভাঁজে, ফেরিওয়ালার ডাকে কিংবা পথতরুর ছায়ায়।

উনিশ শতকের ঢাকার দিকে যদি তাকাই দেখা যাবে বিগত-যৌবনা ঢাকাকে। ঢাকার জৌলুস ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে, বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর হওয়ার কারণে। ঢাকার আকৃতিও অনেকটা সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। ১৮৪৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভোলানাথ চন্দ্র বাবুবাজারের ঘাটে নোঙর করেন। সে সময়ের ঢাকার নদীর তীর ঘেঁষে দৈর্ঘ্য মাত্র চার মাইল, প্রস্থ এক মাইলের বেশি হবে না। বায়ান্ন বাজারের সংখ্যা তিন চারটিতে এসে ঠেকেছে। দুর্গন্ধ আর কোলাহলপূর্ণ ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা ইউরোপীয়দের দালানগুলো তার মতে চলনসই। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খানের তৈরি করা একটি গেটের খোঁজ তিনি করেছিলেন। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় শায়েস্তা খান এ গেট দিয়ে বের হন এবং সেটি বন্ধ করে দেন। গেটে লেখা ছিল, ‘ভবিষ্যতে ঢাকার কোনো শাসক যদি চালের দাম এতটা কমিয়ে আনতে পারেন তবেই ফটক খোলা হবে, নচেৎ তা বন্ধ থাকবে।’ এ ফটকটিও খুঁজে পাননি তিনি।

উনিশ শতকের প্রথমদিকেই ঢাকাই মসলিন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এর প্রায় হাজার দুয়েক বছর আগেও এ মসলিন রোমে রপ্তানি করা হতো। মসলিনের স্বর্ণযুগ ছিল মোগল আমলে। তবে উনিশ শতকেই মসলিনের সূক্ষ্ম সুতা তৈরির নদীকেন্দ্রিক বিশেষ আর্দ্রতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সতেরো-আঠারো শতকে দুনিয়াজুড়ে রাজত্ব করেছিল এ মসলিন। মসলিন বিলুপ্ত হওয়ার বেশ কিছু কারণ ছিল। মসলিন উৎপাদনকারীর আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। এটি দামি বস্ত্র, কিন্তু এর মুনাফাভোগী ছিল বণিকেরা। ম্যানচেস্টারের পণ্য বাজারজাত এবং নওয়াব-জমিদারদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসও এর অন্যতম কারণ। ১৮৫০ সালে প্রখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, সপুষ্পক ও অপুষ্পক উদ্ভিদ তত্ত্বেও প্রবক্তা স্যার জোসেফ ডাল্টন হুকার ঢাকা এসেছিলেন। তার বর্ণনা থেকে পাই মসলিন বোনার ফুটি কার্পাস তুলার সন্ধান না পাওয়ার কথা। হুকার পূর্ববঙ্গের দীর্ঘ জলপথে চলার সময় মাঝিদের দক্ষতায় অবাক হয়েছিলেন। কূলকিনারাহীন নদীর মাঝে কম্পাস ছাড়াই ঠিক নদী পাড়ি দিচ্ছে বাংলার দক্ষ নাবিকেরা।

ভোলানাথ চন্দ্রের ঢাকা আর হুকারের ঢাকার বর্ণনা অনেকাংশে এক। কারণ তাদের ঢাকা ভ্রমণের সময়কালের পার্থক্য খুব বেশি দিনের ছিল না। দুজনেই বলেছেন ঢাকার তাঁতিরা তাঁতের ব্যবসা ছেড়ে সোনা ও শঙ্খের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন মসলিনের দুর্দশাহেতু। কেদারনাথ মজুমদারের ঢাকার বিবরণ গ্রন্থে প্রাপ্ত তথ্যমতে উনিশ শতকের প্রতিবছরে ঢাকায় তিন লাখ টাকার সোনা ও রুপার অলংকার বিক্রি হতো। মা মারিয়ার জন্য ঢাকায় তৈরি একটি সোনার নেকলেস নিয়ে যাবেন, এমনটা হুকার ঠিক করে রেখেছিলেন অনেক দিন আগেই। তার মায়ের বড় শখের জিনিস এই নেকলেস। সিকিমে থাকতে ছেলের কাছে বায়না ধরেছিলেন, দেশে ফেরারকালে সম্ভব হলে হুকার যেন একটা ভারতীয় নেকলেস নিয়ে আসেন। হুকার উত্তরে চিঠিতে লিখিছিলেন, মা যেমনটি চাইছেন সুলভে পাওয়ার সেরা জায়গা হলো ঢাকা- I hardly think that I could get one good enough for you to wear, under 200 or 300 rupees here, but in Dacca I fancy they are cheaper.

একবিংশ শতাব্দীর ঢাকা ইট-পাথরের ঢাকা। গত গতাব্দীতে বঙ্গভঙ্গের পর নান্দনিক নগরে রূপদানের পরিকল্পনা করলেন হেয়ার সাহেব। তার নেতৃত্বেই ঢাকায় আসলেন স্থপতি রবার্ট লুইস প্রাউডলক। দেশি-বিদেশি বৃক্ষের সমন্বয়ে এমন এক ঢাকা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন প্রাউডলক, যেখানে কিনা বছরের বারো মাস পুষ্প শোভা দেবে। রমনাতে তিনি দেশি-বিদেশি দুধরনের গাছই লাগিয়েছেন; কৃষ্ণচূড়া, জারুল, নাগলিঙ্গম, তাল, তেঁতুল, অরাকেরিয়া, ব্ল্যাকবিন প্রভৃতি। মীজানুর রহমান তার ঢাকা পুরাণে জানিয়েছেন, ‘...ঢাকাবাসীর ভাগ্য ভালো, নতুন ঢাকার নিসর্গ-স্থপতি প্রাউডলক সেগুনবাগিচা সংলগ্ন রেসকোর্স ও রমনা গ্রিনের দুপাশে বুনে দিয়েছিলেন সেগুনের চারা।’ তার ল্যান্ডস্কেপিংয়ে ঢাকা কীভাবে মনোমুগ্ধর হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় কবি বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথায়, ‘স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়াদিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি।’ মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যায় ছাপা হওয়া এক তরুণ মার্কিন অধ্যাপকের স্মৃতিচারণ এ প্রসঙ্গে তুলে ধরা যায়, ‘... আর একটা জিনিস আমার খুব ভালো লেগেছে; তা হলো এখানকার গাছপালা। এত সুন্দর, আর এত রকমের, আর এত সবুজ গাছপালা আমি আর কোথাও দেখিনি। আর এত ফুল, কোথাও না কোথাও ফুল ফুটে আছেই, একটা শেষ হতে না হতেই আরেক রকমের ফুল এসে হাজির।’

সিভিল সার্জন জেমস টেলার তার গ্রন্থে ঢাকাকে ক্ষুধার্ত ও রোগাক্রান্ত মানুষের শহর বলেছেন। এখানে ম্যালেরিয়া, প্লিহাস্ফীতি ও পেটের ব্যামো অন্য শহরের চেয়ে বেশি ছিল। হাতুড়ে ডাক্তারি আর কবিরাজির চল ছিল সবচেয়ে বেশি। ঈশ্বর গুপ্তের ভ্রমণকাহিনি থেকে জানা যায়, ‘...ডাক্তারটি উপযুক্ত নহে, মিডিকেল কলেজের শিক্ষা করে নাই। লেখাপড়া জানে না।...ফোঁড়া কাটা ও পটি বসানো প্রভৃতি কর্মই তাহার চূড়ান্ত কর্ম।’

ঢাকার প্রথম আধুনিক হাসপাতাল মিটফোর্ড হাসপাতাল। এটি ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত ঢাকাবাসীর তখন আশ্রয় বলতে ছিল কবিরাজি চিকিৎসা। ফলে আধুনিক হাসপাতালের জন্য জমির দখল পেতে ঢাকার তৎকালীন প্রশাসককে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ঢাকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেই সমাজে শল্যচিকিৎসা নিয়ে ব্যাপক আতঙ্ক তো ছিলই, তার সঙ্গে শুরু হয় জীবিকা হারানোর ভয়ে ভীত কবিরাজদের তুমুল অপপ্রচার। ফলে জন্মলগ্ন থেকেই মিটফোর্ডের পথচলা কঠিন হয়ে ওঠে। প্রথম বছর হাসপাতালটি মাত্র পঞ্চাশটি চৌকি নিয়ে আরম্ভ হয়েছিল। এ হাসপাতালে বহির্বিভাগও চালু হয়েছিল। রক্ষণশীল সমাজে নারীরা সবচেয়ে অবহেলিত ও চিকিৎসাবঞ্চিত। এ অবস্থায় হাসপাতালের অর্থায়নে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রসূতি নারীদের চিকিৎসা চালু করা হয়েছিল।

ঢাকা অনেক আগে থেকেই ছিল বাংলার রাজধানী। এর ওপর দিয়ে অনেককাল অতিক্রম করে গেছে। তবুও ঢাকা টিকে আছে। ঢাকাই বজরাসহ আরও অনেক কিছুর খ্যাতি ছিল এক সময়, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। কর্নেল ডেভিডসন ঊনবিংশ শতাব্দীতে বুড়িগঙ্গার তীরে এসে দেখেছিলেন নৌকার সালতি, কাঠের পিলার সারি সারি করে রাখা। ঐতিহাসিক কিংবা ভ্রমণোৎসুকদের বিবরণ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ঢাকাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় বারবার। দুঃখের বিষয় ঢাকার জৌলুস এখন কেবল পুরোনো ইতিহাস কিংবা সাহিত্যেই পাওয়া যায়, বর্তমানে যার ছিটেফোঁটাও পাওয়া ভার।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম