Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

কবিতাগুলো চোখের সামনে দৃশ্য তুলে ধরে

Icon

তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একবার বলেছিলাম কবিতা আসে খুব গোপনে প্রেমিকার মতো। ঠিক কেমন গোপন তা হয়তো বলতে পারব না। তবে এটুকু জানি, সেটা স্বচক্ষে দেখা যায় না। কবিতা মূলত রহস্যের ভান্ডার।

ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন, ‘আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব, ইট ইজ নট এ্যন ইমাজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি!’ কবিতা ঠিক এমনই। কবিতা কোনো সস্তা বিনোদনের বিষয় নয়। কবিতা ভেতর থেকে ধাক্কা দেবে। হৃদয়কে স্পর্শ করবে। যখন কোনো কবি তার বাস্তব-অবাস্তব জগৎকে ঘিরে কবিতা লেখেন, তখন তার কবিতায় ফোটে উঠে জীবনের মানে। ভাঙা গড়ার এ পুরো জীবনকে ঘিরেই মূলত কবিতা। জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে যখন কোনো কবি লেখে ফেলেন, ‘স্মৃতি উড়ে গেলে পড়ে থাকে ছায়ার কঙ্কাল’ কিংবা মানুষের মধ্যে এ বিভেদ-বৈষম্য আর বঞ্চনাকে তুচ্ছ করে দিয়ে বলেছেন, ‘মুর্দার অধিকার সমান/বরই পাতায় গরম জল/আতর গোলাপ, সাদা মার্কিন/সাড়ে তিন হাত ভূ-খণ্ড।’ তখন আর বলার উপায় থাকে না জীবনের মানে কী! বলছি কবি আরিফুর রহমানের কবিতার কথা। যার কবিতায় উঠে এসেছে জীবনের নানা অনুষঙ্গ। কবি আরিফুর রহমানের কবিতাগ্রন্থ ‘উর্বশী রোদের ছায়াবাজি’। এ গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘উর্বশী রোদের ছায়াবাজি’ কবিতার নামানুসারেই গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়। এ গ্রন্থে মোট ৭০টি কবিতা আছে। এসব কবিতায় কবি তার নিজস্ব কাব্যভাষায় অল্প কথায় যতটুকু বলা যায় তিনি তা বলেছেন।

কবি আরিফুর রহমান শিক্ষকতার পেশাকে ছাপিয়ে গিয়ে কবিতা ও গল্পের মধ্যেই খুঁজেছেন নিজের আশ্রয়। তার কবিতায় উঠে এসেছে ইতিহাস। তিনি আঞ্চলিক ভাষায় লিখেছেন, ‘ভরা যৈবনে বিধবা হইব এই ছিল কপালে লেহা।’ এখানে সেই বিধবার কথা বলা হয়েছে যার স্বামী ’৭১-এর যুদ্ধের ময়দানে শহিদ হয়েছেন। প্রথম কবিতা পাখি’র উক্ত পঙ্ক্তিই নির্দেশ করে এ বইয়ের কবিতাগুলোর পথ। কবিতাটি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত।

কবিতা হৃদয় স্পর্শ করে চিত্রকল্পের মাধ্যমে। কবি আরিফুর রহমান তার কবিতায় চিত্রকল্পের মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। অবাস্তব ছোট ছোট দৃশ্যকে বাস্তবের মতো সামনে তুলে ধরেছেন কবিতায়। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘ছায়ার কঙ্কাল, হলুদ জমিন, বর্গফুটে মাপা জীবন, তৃষ্ণার রোদ, ধুলোসন্ধ্যা, অভিযোগের সুর, উঠোন ভরা জ্যোৎস্না, মেয়েলি আগুনের ঘুম, জলের বারান্দা, ধানপাতা হাসে, দুরন্ত দুপুর, প্রেমের সূর্য, ইবলিশ ইচ্ছেরা, আলো ডাকছে ইশারায়, নিষ্পাপ রক্ত, বাউরী বাতাস, জ্যোৎস্নার সিঁড়ি, নদীর শ্বাস, শ্রান্ত ডানার ছায়া, স্পর্শের শপথ, ছাড়পত্রহীন অবসর, শস্যবতী খেত, সোহাগী আঙিনা, রোদ্দুরের ঘ্রাণ, ছায়ার মমতা, স্মৃতির পাখি, প্রতিবাদী ঝড়, নিরীহ জ্বরের দাগ, বিষাদের অনুবাদ।

কবি তার শৈশবকে স্মরণ করে লিখেছেন, ‘দাদিমা-র কোলে সোনামুখি সুঁই ভরা কাঁথা/ইশকুলের পথে ছিল ছড়া/অন্যপাড়ায় নামা-আকাশছোঁয়ার ব্যাকুলতা।’ আবার লিখেছেন, ‘ক্লান্ত দিন বাড়ি ফিরে এলে গল্প-হাসিতে ভরে উঠতো উঠোন।’ অতীতের স্মৃতিচারণ করেছেন কবিতার মাধ্যমে। আবার সংসারের ঘানি টানতে থাকা বাবাকে কখনো তিনি অভিনেতা হিসাবে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন, বকরির দুধে লাল ভাত মাখাইলে/আমরা দুই সহোদর হামলে পড়তাম/আব্বা মুখ ফিরাইয়া নিতেন, গন্ধ যেন/মঞ্চের জাঁদরেল অভিনেতা যে।

আবার কখনো লিখেছেন, বিষাদের অনুবাদে পুষ্প ফোটাতে পারতেন আব্বা! প্রেম ও প্রকৃতি একজন কবির আত্মাকে তৃপ্ত করে। প্রেমহীন এ জীবনে প্রেম খুঁজতে গিয়ে মানুষ হয়েছে দেউলিয়া। কেউ কেউ গেয়েছে ভালোবাসার গুণগান। প্রেমকে বুকে ধারণ করতে গিয়ে কবি লিখেছেন, ‘বুকেরই অন্ত্যমিলে তারে করে দেবো ভালোবাসার গান।’ আবার কখনো কখনো চেয়েছেন প্রেম থেকে মুক্তি। প্রেমে বন্দি হয়ে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে এক বুক হাহাকার নিয়ে লিখেছেন, ‘অচল পয়সার মতো বাক্সবন্দি হবো ভাবিনি।’

মুক্তির পথ খুঁজে পেয়ে যখন অতীতের স্মৃতি সামনে এসে নাড়া দেয়। কবির হৃদয়কে আহত করে। তখন সেই আহত হৃদয়ের কথা হয়ে ওঠে, ‘তারপর তুমি কতদিন আমাকে ভুলে আছো?/তোমার সেইসব ভালোবাসা/আমি ভালোবেসেছি।’

প্রকৃতির সঙ্গে কবি যখন মিশে একাকার। প্রকৃতির মাঝে ডুব দিয়ে চিত্রকল্প এঁকেছেন কবিতায়। লিখেছেন, ‘জ্যোৎস্না ভেজা সোহাগী আঙিনা/একতারার সুর ঝরা বাউলের মেঠোপথ।’ কখনো বা নদীকে দেখেছেন নারী রূপে। নদীর প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এক সময় যমুনা শান্ত হয়, প্রেমময়ী হয়/শেষ বিকেলে সে লাল শাড়ি পরে/পূর্ণিমায় স্বচ্ছ জলে তোলে শত চাঁদের জলছবি!’ আবার কখনো তিনি কল্পনা করেছেন পুকুরের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক। তিনি লিখেছেন, ‘পুকুরে নেমে আলতো করে সে/রেখে আসে গতরাতের স্মৃতিচিহ্নগুলো।’

কবি আরিফুর রহমান ঠিক এভাবেই চিত্রকল্পের মাধ্যমে তার কবিতাগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন ‘উর্বশী রোদের ছায়াবাজি’ কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলো বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। মনের বিবেককে নাড়িয়ে তোলে। কবিতাগুলো চোখের সামনে দৃশ্য তুলে ধরে। বুকের মধ্যে ধাক্কা দেয়। অন্য জগতে নিয়ে যায়।

উর্বশী রোদের ছায়াবাজি আরিফুর রহমান

প্রকাশনী ভাষাচিত্র প্রচ্ছদ আহমেদ ইউসুফ

মূল্য ১৭৫ টাকা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম