Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মাদ্রাসাছাত্র থেকে ইয়াবা গডফাদার

মাদক ব্যবসায় বাধা দিলেই পুঁতে রাখত জীবন্ত

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাদক ব্যবসায় বাধা দিলেই পুঁতে রাখত জীবন্ত

স্বপন হোসেন ওরফে স্বপন (৩৫)। ভয়ংকর এক মাদক সম্রাটের নাম। তার মাদক ব্যবসায় কেউ বাধা দিলেই তিনি তাকে তুলে নিয়ে হাত-পা বেঁধে মারধর করে মাটির নিচে জীবন্ত পুঁতে রাখতেন। সাভার এলাকার অন্যতম ত্রাস এ মাদক গডফাদারের বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতেন না এলাকাবাসী। ফলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি করে তিনি বনে গেছেন একাধিক বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক।

সম্প্রতি বিরুলিয়ার খনিজনগরে সীমা আক্তার নামে এক নারীকে ধরে নিয়ে জীবন্ত পুঁতে রাখার ঘটনায় ১১ জুন বিদেশি অস্ত্র, গুলি এবং হেরোইনসহ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন স্বপন। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তার অপরাধ জগতের লোমহর্ষক সব তথ্য। স্বপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাভারের আনন্দপুর সিটিলেন এলাকায় তার নির্মাণাধীন বাড়ির নিচতলার মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় এক যুবকের হাড়গোড় ও মাথার খুলি। এসব ঘটনার দায় স্বীকার করে সম্প্রতি আদালতের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন স্বপন।

সুঠাম দেহের অধিকারী স্বপন অনেকটাই স্বাস্থ্য সচেতন। জিমে গিয়ে নিয়মিত শরীরচর্চাও করতেন। চা-সিগারেট এবং মাদক তাকে স্পর্শও করতে পারেনি। অথচ তিনি ওই এলাকার মাদকের গডফাদার। এলাকার মানুষ তাকে মাদক সম্রাট হিসাবেই চিনতেন। কিন্তু কেউ তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দও করার সাহস পেতেন না। মাদক ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে স্বপন দিনে দিনে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন। কেউ তার ব্যবসায় বাধা দিলে তুলে এনে তার হাত-পা বেঁধে মারধর করে জীবন্ত পুঁতে রাখতেন মাটির নিচে। এটা যেন এক রকম তার নেশায় পরিণত হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাভার পৌরসভার ইমান্দিপুরের মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়ার একমাত্র ছেলে স্বপন হোসেন। ছোটবেলা থেকে খুবই চতুর স্বভাবের ছিলেন। পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে ভর্তি করা হয় হাফেজি মাদ্রাসায়। কিন্তু ২৫ পারা কুরআন মুখস্থ করার পর মাদ্রাসায় পড়া ছেড়ে দেন স্বপন। অসচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় পরে তিনি পোশাক কারখানায় চাকরি, ড্রাইভিংসহ নানা কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। একপর্যায়ে ৫-৬ বছর আগে সাভারের গেন্ডা এলাকায় এক মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই মাদক ব্যবসায়ীর সেলসম্যান হয়ে মাদক বিক্রি শুরু করেন স্বপন। এরপর কৌশলে মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিজের কব্জায় নিয়ে নেন। নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে বনে যান মাদকের গডফাদার। কক্সবাজার ও উখিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা এবং অন্যান্য মাদকের চালান আসতে থাকে স্বপনের ডেরায়। স্থানীয় মাস্তানদের ম্যানেজ করে স্বপন চালিয়ে যান মাদকের বড় কারবার। বেশ কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সাভারের পাকিজা, তালবাগ, রেডিও কলোনি, গেন্ডা, কলমা এবং বিরুলিয়ার আকরাইন, খনিজনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় মাদক বাণিজ্য চালান স্বপন। মাদকের ডেরা হিসাবে ব্যবহার করতেন বিরুলিয়ার খনিজনগর ও সাভারের আনন্দপুরের বাড়ি। মাদক বিক্রির টাকায় স্বপন গত ৫ বছরে বিপুল বিত্তভৈববের মালিক বনে যান।

মাদারীপুরের শিবচরের সৌদি প্রবাসী জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী সীমা আক্তার সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের খনিজনগরে বোনের বাসায় ভাড়া থাকতেন। তিনি একটি এনজিওতে কাজের পাশাপাশি পুলিশের সোর্স হিসাবে কাজ করতেন। ২ জুন সীমা আক্তার নিখোঁজ হলে তার মেয়ে তানিয়া আক্তার সাভার মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় মাদক ব্যবসায়ী স্বপন ও তার সহযোগী আসিফ, সাইফুল ইসলাম ও রেজাউলকে। এই মামলায় ৬ জুন স্বপনের সহযোগী সাইফুলকে গ্রেফতার করে ডিবি ঢাকা উত্তরের একটি টিম। তার দেওয়া তথ্যমতে বিরুলিয়ার খনিজনগরে স্বপনের বাড়ির মাটি খুঁড়ে সীমার অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, স্বপন ও তার সহযোগীদের মাদক কারবারে বাধা দেওয়ায় সীমাকে তারা এর আগেও মারধর করে। নিহতের মেয়ে তানিয়া আক্তার বলেন, নিখোঁজ হওয়ার ২ দিন আগে সীমা আক্তার তাকে জানিয়েছিলেন, ১৩ মে স্বপনের খনিজনগরের বাড়ি থেকে ৩০০ পিস ইয়াবাসহ বিরুলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হামিদ মিয়া ও স্বপনের কথিত স্ত্রী পপি আক্তারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। স্বপন ও তার সহযোগীদের ধারণা সীমা পুলিশকে দিয়ে তাদের ধরিয়ে দিয়েছেন। এজন্য ক্ষিপ্ত হয়ে স্বপন ও তার সহযোগীরা খুন করে লাশ গুম করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন সীমাকে।

সীমা অপহরণ ও হত্যা মামলায় ডিবি ঢাকা উত্তরের একটি দল ১১ জুন ধামরাইর কুল্লা ইউনিয়নের রূপনগর তিন রাস্তার মোড় থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ৫ রাউন্ড গুলি ও হেরোইনসহ মাদক সম্রাট স্বপনকে গ্রেফতার করে। সীমা অপহরণ ও হত্যা মামলায় ডিবি এ নিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারের পর স্বপন আদালতকে জানান, কথিত স্ত্রী পপি এবং সহযোগী আব্দুল হামিদকে (বিরুলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি) ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সীমার ওপর খুব রাগ ছিল তার। ২ জুন তার সহযোগী আসিফ ইয়াবা বিক্রি করতে কলমা এলাকায় যায়। ইয়াবা বিক্রি শেষে ফেরার পথে আসিফের সঙ্গে ছিল স্বপন, সাইফুল ও রেজাউল। খনিজনগরে সামছুর দোকানের সামনে এলে সীমার সঙ্গে দেখা তাদের। সীমা তাদের দেখে গালি দেন। এ সময় তারা চারজন সীমাকে ধরে নিয়ে স্বপনের বাড়ির দিকে যান। সীমা যেতে না চাইলে সাইফুলের গায়ের শার্ট খুলে তার হাত বাঁধা হয়। এরপর তারা সীমাকে মাথায় তুলে স্বপনের বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়ির কাছে গেলে সীমা আত্মরক্ষার্থে স্বপন এবং সাইফুলের আঙুলে কামড় বসিয়ে দেন। এরপর সীমার হাত খুলে গলায় গামছা প্যাঁছিয়ে টান দেন রেজাউল। এতে সীমা জ্ঞান হারান। এরপর বাড়ির দক্ষিণ পাশে টয়লেটের লাইন দেওয়ার জন্য গভীর গর্ত খুঁড়ে রাখা ছিল। পানি ভর্তি ওই গর্তে সীমাকে ফেলে দেন স্বপন। ওই গর্ত থেকে সীমা আর উঠতে পারেননি। পরে তাকে তারা জীবন্ত মাটিচাপা দেয়।

এর আগে গত বছরের ১৯ এপ্রিল নিখোঁজ হন সাভার পৌর এলাকার ইমান্দিপুরের সালামত মিয়ার ছেলে পোশাক শ্রমিক তোফাজ্জল হোসেন টুনু (২৬)। ওই ঘটনায় টুনুর স্বজনদের সন্দেহের তির ছিল স্বপনের ওপর। মামলাটি তদন্ত করছিল ডিবি। ওই মামলায় ডিবি স্বপনকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে ৪ দিনের রিমান্ডে আনে। রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন স্বপন। স্বপন জানান, তার মাদক ব্যবসার সহযোগী রমজানের কাছ থেকে ৫০ পিস ইয়াবা জোর করে নিয়ে যান টুনু। এই ঘটনার জের ধরে টুনুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্বপন। ২০২৩ সালের ১৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে স্বপন, রমজান, রাব্বি, হৃদয়সহ কয়েকজন মিলে টুনুকে আনন্দপুর বক্করের বাড়ির কাছ থেকে ধরে নিয়ে যান। এরপর পাশের খোলা মাঠে নিয়ে তাকে বেঁধে মারধর করে আধমরা অবস্থায় আনন্দপুরে স্বপনের নির্মাণাধীন বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে একটি রুমের মধ্যে ৭ ফুট গর্ত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এরপর এর ওপর সিমেন্ট ঢালাই দেওয়া হয়।

স্বপন জানিয়েছেন, যে বাড়িতে টুনুকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বসেই তিনি মাদক ব্যবসা করতেন। আর ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন করতেন মাদক বিক্রির টাকা।

এদিকে স্বপনের সহযোগী কালুর সঙ্গে মারামারি হওয়ার পর থেকে ইলিয়াস হোসেন নামের আরেক যুবক নিখোঁজ রয়েছেন। তার ভাই শাহ-আলম বলেন, ২০২৩ সালের ৯ মে সকালের নাস্তা করে বের হওয়ার পর ইলিয়াস আর ফিরে আসেনি। ইলিয়াসের স্বজনদের সন্দেহের তিরও স্বপনের দিকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান, কয়েক বছর আগেও আড়াই হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন স্বপন। বাসা ভাড়ার টাকা না দিতে পারায় এলাকায় সালিশ করে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। মাদক ও ইয়াবা বিক্রি করে সেই স্বপন রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। আনন্দপুরের ৫ শতাংশ জমির ওপর দুইতলা বাড়ি, বিরুলিয়া ও মজিদপুরসহ অন্য স্থানে আরও চার-পাঁচটি বাড়ি রয়েছে।

এই চাঞ্চল্যকর মামলার তদারকি কর্মকর্তা ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) মোবাশশিরা হাবীব খান যুগান্তরকে বলেন, স্বপন মাদক সম্রাট এবং এক ভয়ংকর খুনি। তার ভয়ে এলাকার মানুষজন তটস্থ ছিলেন। সীমাকে লোকজনের সামনে তুলে নিয়ে গেলেও তাকে কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পায়নি। টুনুর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম পর্যায়ে সে জানায়, লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে সে লাশ নিজের বাড়িতে পুঁতে রেখেছে। তিনি বলেন, মানুষকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা আমার চাকরি জীবনে আর একটিও পাইনি। তিনি বলেন, ইলিয়াস গুমের বিষয়টিও আমরা তদন্ত করে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করব।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম