Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহসী শিল্পোদ্যোক্তা নুরুল ইসলাম

মৃত্যু নয়, জীবনই যার শেষ কথা

Icon

সাইফুল আলম

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মৃত্যু নয়, জীবনই যার শেষ কথা

দৈনিক যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা, যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বস্তুত যে কোনো মানুষই মৃত্যুকে সঙ্গী করে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে যে সময়টা আমরা পাই, মহান আল্লাহর কৃপায় সেটা জীবন। মানুষকে তার যাপিত জীবনের সেই সময়ের কৃতকর্ম নিয়েই আমরা মূল্যায়ন করি। খুব প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে-

‘জন্মিলে কাঁদিবে তুমি হাসিবে ভুবন,

মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’

যার অর্থ এমন-একটি শিশুর জন্মের সময় যেমন স্বজনরা হাসিতে উচ্ছল হয়, তেমনই যেদিন সেই মানুষটির মৃত্যু ঘটে, সেদিন যেন সবার চোখে অশ্রু থাকে। আরও সংক্ষিপ্ত করে যদি এই অনুভূতিটাকে ব্যক্ত করি, তা এমন দাঁড়ায়-কাঁদতে কাঁদতে আসা এবং হাসতে হাসতে যাওয়া-এটাই সত্যিকার মানুষের পরিচয়ের চিহ্ন।

যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশের প্রথম প্রজন্মের সাহসী শিল্পোদ্যোক্তা নুরুল ইসলাম এই যথার্থ মানুষেরই একজন। তারুণ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করতে। শত্রুসেনার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরই আবার দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। সাহসী শিল্পোদ্যোক্তা হিসাবে একের পর এক গড়ে তুলেছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেশের মানুষের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার সংগ্রামে ব্রত হয়েছেন। নিরন্তর কর্মপ্রেরণায় নিবেদিত ছিলেন তিনি। কাজের মধ্যেই যেন ছিল তার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য। সব সময় তিনি কর্মোদ্দীপ্ত থাকতে ভালোবাসতেন বলেই আমার অভিজ্ঞতা। কর্মমুখরতায় তিনি তার চারপাশকে উদ্দীপ্ত করতেন, উজ্জীবিত করতেন। শুধু আমার অভিজ্ঞতা নয়, যুগান্তর ও যমুনার অনেক সহকর্মী তাকে দেখেছেন আড়ম্বরহীনভাবে পদচারণা করতে এই যমুনা ফিউচার পার্ক কমপ্লেক্সের আঙিনায়; কোনো সিকিউরিটি ছাড়া, সঙ্গী ছাড়া একাকী তিনি তার স্বপ্নের এ প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াতেন এমন সাদামাটা পোশাকে যে, যে কেউ তাকে দেখলে এমনটা ভাবতেই পারত না যে তিনি দেশের এত বড় একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি, এত বড় একজন শিল্পোদ্যোক্তা। যে দেশে যার একটি যানবাহন আছে, তিনি কখনো যানজটে আটকালে দরজার গ্লাস পর্যন্ত খোলেন না-সে দেশে সাহসী শিল্পোদ্যোক্তা এ মানুষটি যানজটে পড়লে গাড়ি রেখে অনেক দূর থেকে স্বচ্ছন্দে হেঁটে হেঁটে যথাসময় অফিসে পৌঁছে গেছেন। এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি-এমন উদাহরণ খুবই বিরল। সময়ের বিষয়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। ছিলেন সাহসী-সত্য প্রতিষ্ঠায়-আমরা যুগান্তরের লোগোর সঙ্গে একটি স্লোগান লিখি ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক’। হ্যাঁ সাহসী ছিলেন-সত্যের বিষয়েও। আমাদের এ স্লোগানটি শুধু কথার কথা নয়-সেটার ভালো সাক্ষ্য দিতে পারবেন আমাদের পাঠকরা। আমাদের ভেতরে এ সাহসটি সঞ্চারিত করেছিলেন তিনি-তার কাজে এবং তৎপরতায়।

২.

যুগান্তরের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথচলায় অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে আমাদের। সেসব সংকট, সমস্যাকে পেরিয়ে আসতে আমাদের পাশে সব সময় তিনি হাল ধরে দাঁড়িয়েছেন পরম নির্ভরতার, আস্থার, সাহসের প্রেরণা হয়ে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই সংকটের সময়গুলোর কথা যখন একটার পর একটা স্মরণ করি, তখনও অভয়মন্ত্রদাতা একটি মুখচ্ছবি আমার চোখে ভেসে ওঠে হাস্যোজ্জ্বল নুরুল ইসলামের, তথা যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যানের।

৩.

‘সেচনকারী প্রবাহিত করে পানিকে

তীর নির্মাতা ঋজু করে তীরের বাণকে

ছুতার মূর্তি দেয় কাঠকে

বিজ্ঞজন কব্জা করে আপনাকে’’

-গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধের বাণী। পৃ. ৫১

কোনো কোনো মানুষ এবং তার সাফল্য সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ‘ছাই ধরলে তা সোনা হয়ে ওঠে’। অর্থাৎ, তার ছোঁয়ায় সাধারণ পরিত্যক্ত বস্তু হয়ে ওঠে মহামূল্যবান। আমাদের সমাজে এরকম মানুষের সংখ্যা খুবই মুষ্টিমেয়। যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ছিলেন সেই মুষ্টিমেয়দের অন্যতম। তার বিশ্বাস, সাহস, সততা ও পরিশ্রমী মানসিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যা জড়িত ছিল, তা হচ্ছে অসাধারণ দূরদর্শিতা। দেশের সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের চতুর্থ বৃহৎ শপিংমল ‘যমুনা ফিউচার পার্ক’ নির্মাণের কাজ যখন মাঝামাঝি, তখন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের এক তরুণ সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন সংশয় নিয়ে-‘অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগতে পারে এ সুবৃহৎ শপিংমলের ৪৩ হাজার দোকানের ক্রেতা পাওয়া যাবে কি?’ উত্তরে তিনি গভীর আস্থা নিয়ে বলেছিলেন, ‘যখন আমি কোনো বড় কিছু চিন্তা করি, আমি সেই স্থান এবং তার আশপাশের এলাকার সার্বিক বিষয়াবলি সবিশেষ বিবেচনা করি। যমুনা ফিউচার পার্কের আশপাশের এলাকা থেকে পর্যাপ্তসংখ্যক ক্রেতার আগমন ঘটবে এখানে। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত এবং আমি মনে করি, আমার স্বপ্নের শপিংমলটির জন্য এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান আমি নিশ্চিত করেছি। এটি মহানগরীর সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত। গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, ডিওএইচএস এবং বনানীর খুব সন্নিকটে।’ দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এটি শুধু একটি বৃহৎ শপিংমলই নয়, একটি শহরও, যেখানে আপনি দিনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাটাতে আগ্রহী হবেন।’ এ দূরদর্শী স্বপ্নবান মানুষটিই যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা।

৪.

যখন ব্যবসা মানেই ঋণখেলাপি হওয়া, বিদেশে পুঁজি স্থানান্তর, দেশের মানুষকে কষ্টে ফেলে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা আহরণের সংঘবদ্ধ প্রতিযোগিতা, তখনও তিনি অনন্য দেশপ্রেমে নাম তোলেননি ঋণখেলাপির তালিকায়, অর্থ পাঠাননি বিদেশি হিসাবে। তার ভাবনায় ছিল দেশ, দেশের মানুষ।

স্বাধীনতা-উত্তর দেশে ফিরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিধ্বস্ত বাংলায় নিঃস্বতার মধ্যে ব্যক্ত করেছিলেন এক অসাধারণ প্রত্যয়, তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তানি বর্বরেরা ‘গণহত্যা আর পোড়ামাটি নীতি’তে জ্বালিয়ে ছাইয়ে পরিণত করে আমাদের দেশকে। কিন্তু বাংলার মানুষ আর মাটি আছে-এ দুটি সম্পদকে নিয়েই ধ্বংসস্তূপের ওপর আমরা গড়ে তুলব দেশ।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম স্বাধীনতার স্থপতির এ আকাঙ্ক্ষা, এ প্রত্যয়ের ভেতরে পেয়েছিলেন তার জীবনের পথনির্দেশনা। তাই বাংলাদেশের গতানুগতিক শিল্পোদ্যোক্তাদের মতো দেশের অর্থ বিদেশে পাঠানোর চিন্তা করেননি কখনো। শুধু যুদ্ধের বীরত্বে নয়, দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি অটুট অঙ্গীকারে, নৈতিকতার বীরত্বেও তিনি স্মরণীয় মানুষ। এখানেই তার ব্যক্তিত্বের অনন্যতা।

৫.

আমি মনে করি, শুধু যমুনা ফিউচার পার্কের স্থাপত্য নয়, দেশ, দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীদের অন্যতম পথিকৃৎ এ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আগামী প্রজন্ম স্মরণ করবে তার অনন্য দেশপ্রেমের জন্য, সাহস, সততা ও দূরদর্শিতার জন্য। তিনি দেশের মাটি এবং মানুষের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তার সেই দায়বদ্ধতাকেই আমরা যুগান্তরের কর্মীরা আমাদের কাজে স্মরণ করি, বহন করি।

৬.

শুরুতে যে কথা বলেছিলাম, জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে যে জীবন, যে সংগ্রাম; সে জীবন এবং সংগ্রামকে যথার্থ করে তোলা মানুষের একজন নুরুল ইসলাম, যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অসাধারণ সংগীতে তিনি বলেছেন-‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?

জীবনে ফুল ফুটলে পরে মরণে ফল ফলবে।’

জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে সংশয়াকুল মানুষের মনে যে দ্বিধা, যে প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান নিরন্তর চলমান, সে সংশয়ের ভেতরেও আমরা নিঃসংশয়ে এ কথা বলতে পারি-তিনি জীবনে ফুল ফোটানোর কর্মেই ব্রত ছিলেন, তার মতো করে। এটাই তার সাফল্য-তাতে সন্দেহ নেই।

আমরা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর ও সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা

saifulalameditor.jugantor@gmail.com

 
 
Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম