Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সাক্ষাৎকার: জসিম উদ্দিন

স্থানীয় শিল্পে ‘বিশেষ’ নজর দিতে হবে

Icon

সাদ্দাম হোসেন ইমরান

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্থানীয় শিল্পে ‘বিশেষ’ নজর দিতে হবে

এফবিসিসিআই নবনির্বাচিত সভাপতি জসিম উদ্দিন। ফাইল ছবি

করোনার প্রথম ঢেউ প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার বিকল্প নেই। এজন্য বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ থাকা উচিত। রাজস্ব আদায়ে ছাড় দিয়ে হলেও স্থানীয় শিল্পকে টিকে থাকার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। শিল্প টিকে থাকলে রাজস্ব বাড়বেই। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের নামে চাপ দিয়ে শিল্প মেরে ফেললে কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতা বাড়বে। যুগান্তরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি, বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা বলেছেন এফবিসিসিআই নবনির্বাচিত সভাপতি জসিম উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদ্দাম হোসেন ইমরান

যুগান্তর : এফবিসিসিআই সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন।

জসিম উদ্দিন : ধন্যবাদ।

যুগান্তর : এফবিসিসিআই নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

জসিম উদ্দিন : এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের অ্যাপেক্স বডি। দেশের সব খাতের প্রতিনিধিত্ব করে। আমার প্রথম কাজ হবে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট পলিসি তৈরিতে সহায়তা দেওয়া। সরকারের মহাপরিকল্পনা যেমন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন, জিএসপি পাশ সুবিধা, ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন, রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অথচ পলিসি বানাচ্ছে আমলারা। পলিসির সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ততা না থাকায় পলিসি করার পর বাস্তবায়নের সময় নানা ধরনের ঝামেলা হয়। ব্যবসাবান্ধব বাস্তবায়নযোগ্য পলিসি করার লক্ষ্যে কাজ করব।

যুগান্তর : নতুন উদ্যোগ কী থাকবে?

জসিম উদ্দিন : এফবিসিসিআইকে গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরে জোর দেব। আমাদের অনেক খাতভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন আছে, সেগুলো অর্থনীতিতে কী অবদান রাখছে-তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারবে না। এসব শিল্প বিকাশের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী, সেসব চিহ্নিত করতে গবেষণা করা হবে। সঠিকভাবে গবেষণা করা গেলে ভবিষ্যতে নীতি গ্রহণে সুবিধা হবে।

যুগান্তর : করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি কেমন?

জসিম উদ্দিন : প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে উঠতে সক্ষম হয়েছি। অনেক দেশে যখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তখন বাংলাদেশে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এত তীব্র হবে; সেটা কেউ চিন্তা করেনি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী বেকায়দায় আছে। গত বছর তারা বৈশাখ, রোজার ঈদ ও কুরবানির ঈদে ব্যবসা করতে পারেনি। এ বছরও লকডাউন ছিল। যদিও সরকার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে মার্কেট খুলে দিয়েছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।

যুগান্তর : রাজস্ব বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

জসিম উদ্দিন : প্রতিবছর রাজস্ব আয়ে ৪০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ধরে বাজেট দেওয়া হয়। অর্থবছর শেষে ১৭-১৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয় না। কিন্তু দেখা যায়, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে এনবিআর ব্যবসায়ীদের ওপর কঠিন চাপ দেয়। এতে শুধু হয়রানিই বাড়ে। যেহেতু ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয় না, তাই বাজেটও ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে করা উচিত। তাহলে হয়তো চাপ কিছুটা কমবে।

যুগান্তর : শিল্পের বিকাশে রাজস্ব সংক্রান্ত কী কী সমস্যা আছে?

জসিম উদ্দিন : আমদানি শুল্ক সংক্রান্ত সমস্যা অনেক। অনেক শিল্পের কাঁচামালে ডিউটি ৩০ শতাংশের বেশি বিধায় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেসব খাতে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, বাচ্চাদের খেলনাসামগ্রী শিল্পে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এ শিল্প দাঁড় করাতে চাইলে খেলনার কম্পোনেন্ট আমদানিতে কাঁচামালের মতো শুল্কছাড় দিতে হবে। কিন্তু এখন কম্পোনেন্টের ওপর ফিনিশড গুডসের মতো ডিউটি দেওয়া আছে। এত ডিউটি দিয়ে কেউ তো আর শিল্প করতে চাইবে না। শিল্প গড়ে উঠলে ভবিষ্যতে দেশে কম্পোনেন্ট শিল্পও গড়ে উঠতে পারে। এ ধরনের আরও অনেক ছোট ছোট সেক্টর আছে, যেগুলোর কাঁচামাল দেশে পাওয়া যায় না। এগুলোর শুল্ক কাঠামো সমন্বয় এখন সময়ের দাবি। যেহেতু শিল্পায়ন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ সরকারের মূল লক্ষ্য, সেহেতু প্রতিটি সেক্টরের সঙ্গে আলোচনা করে পলিসি বানানো দরকার।

যুগান্তর : আমদানি পর্যায়ে আগাম কর ফেরত পেতে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। এটি সমাধানের উপায় কী?

জসিম উদ্দিন : কাঁচামালে আগাম কর (আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট) নেওয়া হচ্ছে। যদি আগাম কর ফেরতই দেওয়া হয়, তাহলে নেওয়ার দরকার কী? এনবিআরের নেওয়ার মধ্যে আর ফেরত পাওয়ার মধ্যে অনেক ‘কিন্তু’ আছে। এ সিস্টেম থাকায় ব্যবসায়ীদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল আটকে যাচ্ছে, যা এ মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন।

যুগান্তর : রপ্তানি খাতে কেমন প্রণোদনা প্রয়োজন?

জসিম উদ্দিন : যেহেতু তৈরি পোশাক আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত, সেহেতু এ খাতের বিকাশ সহায়ক পলিসি নিতে হবে। সেই পলিসি যেন দীর্ঘমেয়াদি হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘনঘন পলিসি পরিবর্তন করা হলে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতে চাইবে না। যেমন রপ্তানি খাতকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হলেও হিসাব-নিকাশ রাখতে হচ্ছে। আবার রপ্তানি উৎসে কর ৫ বছরের জন্য ফিক্সড করে দেওয়া প্রয়োজন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, রপ্তানি বহুমুখীকরণ সহায়ক পলিসি গ্রহণ। সরকারসহ সবাই বলছে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। কিন্তু সেখানেও বৈষম্য আছে। গার্মেন্টসের করপোরেট ট্যাক্স ১২ শতাংশ। আর অন্য খাতের জন্য ২৫ শতাংশ। এটা অযৌক্তিক। সব রপ্তানি যদি বিদেশ থেকে ডলার আয় করে থাকে তাহলে সবার করহার একই হওয়া প্রয়োজন। বরং রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে নতুন নতুন খাতে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়া দরকার।

যুগান্তর : এনবিআরের কেমন সংস্কার প্রয়োজন?

জসিম উদ্দিন : এনবিআরের পলিসি শাখাকে আলাদা করে দেওয়া দরকার। এখন যিনি পলিসি বানাচ্ছেন, তিনিই আবার বাস্তবায়ন করছেন এবং বাস্তবায়নের সময় নিজের মনমতো পলিসি ব্যাখ্যা করছেন। এটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বড় বাধা।

যুগান্তর : করোনায় স্থানীয় শিল্পের কী ধরনের প্রণোদনা বা সুরক্ষা প্রয়োজন?

জসিম উদ্দিন : স্থানীয় শিল্প অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কিন্তু করোনায় অনেকে ওয়াশআউট হয়ে যাচ্ছে। দেশি দশ, সাদাকালোর মতো দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ড অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এ করোনা পরিস্থিতিতে তাদের টিকিয়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে অর্থ দেওয়া উচিত। পাশাপাশি এসএমই খাতে ভ্যাট আদায়ে আরও কৌশলী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। এ খাতে বড়জোর বছরে ২০০-৩০০ কোটি টাকা আদায় হয়। কিন্তু এ টাকা আদায় করতে এনবিআরের আরও বেশি টাকা খরচ করতে হয়। আবার এনবিআরের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনভিপ্রেত প্রতিযোগিতাও হয়। দেখা গেছে, একটা শপিংমলে ২০০ দোকান থাকলে ১০-২০টার মধ্যে ইএফডি মেশিন বসানো হয়েছে। যাদের মেশিন বসানো হয়নি, তারা ভালো আছে। আর যাদের ওখানে বসানো হয়েছে, তাদের বেচাবিক্রি কমেছে। মেশিন বসালে একসঙ্গে পুরো মার্কেটে বসানো উচিত।

যুগান্তর : বাজেটে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

জসিম উদ্দিন : করোনাকালীন স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার বিকল্প নেই। কারণ শিল্পায়ন ছাড়া আমাদের ভিশনগুলো (রূপকল্প-২০২১, ডেল্টা প্ল্যান) বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ লক্ষ্য অর্জন করতে বিদ্যমান শিল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে তো নতুন শিল্প আসবে না। স্থানীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু এনবিআর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে ইচ্ছামতো শুল্ক আরোপের পক্ষে নয়। এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম আমরা মানছি; কিন্তু যারা এসব নিয়ম তৈরি করেছে, তারাই মানছে না। যেমন, ভারত সবই মানে; কিন্তু নন-ট্যারিফ অনেক ব্যারিয়ার দিয়ে রেখেছে। এন্টিডাম্পিং ডিউটি, কাউন্টারভেইলিং ডিউটি ইত্যাদি। অথচ আমরা কিন্তু একটা পণ্যেও এন্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপ করতে পারিনি। এসব জায়গায় পারদর্শী না হওয়া পর্যন্ত যেভাবেই হোক স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে হবে।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

জসিম উদ্দিন : ধন্যবাদ।

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম