Logo
Logo
×

আইটি বিশ্ব

কম্পিউটিংয়ে বাংলার উন্মুক্ত আকাশ

বিজয়ের দখলদারি ভেঙে অভ্রর বিপ্লবী জয়যাত্রা

সাইফুল আহমাদ (সাইফ)

সাইফুল আহমাদ (সাইফ)

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৮ এএম

বিজয়ের দখলদারি ভেঙে অভ্রর বিপ্লবী জয়যাত্রা

ছবি: সংগৃহীত।

একসময় ইন্টারনেটে বাংলা লেখার চ্যালেঞ্জ ছিল দুঃসহ। বিজয় সফটওয়্যার থাকলেও তা ইউনিকোড সমর্থন না করায় ই-মেইল বা ওয়েবে বাংলা লেখা কঠিন ছিল। ঠিক সেই সময়, ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ, এক তরুণ উদ্ভাবক মেহদী হাসান খান নিয়ে আসেন অভ্র প্রথম ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা লেখার সফটওয়্যার। বাংলা ভাষার ডিজিটাল বিপ্লবের অন্যতম প্রধান ভিত্তি এ অভ্র। এটি শুধু একটি বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার নয়, বরং বাংলা ভাষার জন্য উন্মুক্ত প্রযুক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। 

তবুও পথচলা সহজ হয়নি অভ্রর। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিজয় সফটওয়্যারের নির্মাতা মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়। মোস্তাফা জব্বার অভ্রকে ‘পাইরেটেড সফটওয়্যার’ আখ্যা দিয়ে কপিরাইট লংঘনের অভিযোগ করেন। ২০১০ সালে তিনি অভ্রর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে লিখিত অভিযোগ করেন। তবে পরবর্তীকালে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় এবং অভ্র থেকে ইউনিবিজয় লে-আউট সরিয়ে নেওয়া হয়।

২০১৫ সালে মোস্তাফা জব্বারের অভিযোগের ভিত্তিতে গুগল প্লে স্টোর থেকে রিদমিক কী-বোর্ড (অভ্রভিত্তিক অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ) সরিয়ে ফেলা হয়। যদিও পরবর্তীকালে নতুন লে-আউট দিয়ে রিদমিক কী-বোর্ড আবার প্লে স্টোরে আসে।

দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পর চলতি বছরের ‘একুশে পদক ২০২৫’-এর জন্য জন্য মনোনীত করা হয়েছে ডা. মেহদী হাসান খানকে; যা অভ্রর অবদানের স্বীকৃতি।

অভ্রর জন্ম: প্রয়োজন থেকে উদ্ভাবন

২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বইমেলায় গিয়েছিলেন মেহদী হাসান খান। সেখানে তিনি ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা লেখার একটি ওয়েবসাইট দেখেন, যা তাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু সমস্যা ছিল, সেই সময় উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে বাংলা লেখার জন্য কোনো কার্যকর সফটওয়্যার ছিল না। বিজয় তখন বাংলা টাইপিংয়ের জনপ্রিয় সফটওয়্যার হলেও এটি ইউনিকোড সমর্থন করত না, ফলে ইন্টারনেটে বাংলা লেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এ সংকট থেকেই জন্ম নেয় অভ্র।

মেহদী হাসান খান নিজের উদ্যমে ভিজ্যুয়াল বেসিক ডটনেট ব্যবহার করে ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার তৈরি করেন। তিনি ফোনেটিক পদ্ধতিতেও বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেন, যা নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসে, অভ্রর প্রথম সংস্করণ মুক্তি পায়।

অভ্রর বৈশিষ্ট্য ও জনপ্রিয়তা

অভ্র মূলত ওপেন সোর্স এবং বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য একটি সফটওয়্যার। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো-

১. ফোনেটিক টাইপিং: ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বাংলা উচ্চারণ লিখলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলায় পরিবর্তিত হয়।

২.বিভিন্ন লে-আউট: অভ্রতে প্রভাত, মুনীর অপটিমা, অভ্র ইজি, জাতীয়সহ বিভিন্ন বাংলা কী-বোর্ড লে-আউট রয়েছে।

৩. প্ল্যাটফর্ম-স্বাধীনতা: এটি উইন্ডোজ, লিনাক্স, ম্যাক, অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস প্ল্যাটফর্মে কাজ করে।

৪. ফ্রি ও ওপেন সোর্স: অভ্রর সোর্স কোড উন্মুক্ত, তাই এটি সহজেই উন্নয়ন করা সম্ভব।

এ সফটওয়্যার দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে ফেসবুক, ব্লগ এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বাংলা লেখার সুবিধা থাকায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

অভ্র বাংলা ভাষার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজে এটি ব্যবহার করে। এতে সরকারের প্রায় ৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। অভ্রকে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম, মাইক্রোসফট এবং সফটপিডিয়া স্বীকৃতি দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, অভ্র শুধু একটি সফটওয়্যার নয়, এটি একটি আন্দোলন-বাংলা ভাষাকে মুক্ত করার আন্দোলন। এটি প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি শুধু ব্যবসার জন্য নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। মেহদী হাসান খানের একক প্রচেষ্টা বাংলা ভাষার ডিজিটাল রূপান্তরে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’-এ দর্শন নিয়েই অভ্র এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের পথে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম