ছবি : সংগৃহীত
মেটার মালিকানাধীন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপ। প্রতিনিয়ত মেসেজ, ছবি, ভিডিও, ফাইল আদান-প্রদান চলছে হোয়াটসঅ্যাপে। প্রতিদিন প্রায় তিনশো কোটির বেশি মানুষ ব্যবহার করছেন এই প্ল্যাটফর্মটি। ব্যক্তিগত তো বটেই অফিসের জরুরি কথাবার্তাও চলে এখন হোয়াটসঅ্যাপে। এই প্ল্যাটফর্মটিতে সব মেসেজই এন্ড টু এন্ড এনক্রিপটেড সুবিধা আওতাভুক্ত। যার ফলে নিরাপদভাবেই এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যায়। তবে এত সব সুবিধা দেওয়ার পরও অ্যাপটি বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায়। এটি কোনো বিজ্ঞাপনও সরাসরি দেখায় না। তাহলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মালিক কোম্পানি মেটা কীভাবে আয় করে–এমন প্রশ্ন মনে আসাই স্বাভাবিক।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০০ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে। প্ল্যাটফর্মটির শক্তিশালী কম্পিউটার সার্ভারগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ডেটা সেন্টারে রাখা হয়েছে। এগুলো চালানোর জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। তবে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ সরাসরি অর্থ নেয় না।
ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে দেয় হোয়াটসঅ্যাপের মূল কোম্পানি মেটা। মূলত বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টাকা আয় করে হোয়াটসঅ্যাপ। কোম্পানিগুলো পণ্য বা পরিষেবার প্রচার বা গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে।
গত বছর থেকে কোম্পানিগুলো বিনা মূল্যে হোয়াটসঅ্যাপে চ্যানেল তৈরি করতে পারছে। চ্যানেলের মাধ্যমে সমস্ত সাবস্ক্রাইবারদের কাছে শুধু বার্তা পাঠানো যায়। তবে হোয়াটসঅ্যাপে প্রিমিয়াম সংস্করণ কেনার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো সরাসরি গ্রাহকদের সঙ্গে চ্যাট করতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, পণ্য বা সেবা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারে। এমনকি লেনদেন বা বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। যেমন: যুক্তরাজ্য থেকে ভারতের কোনো শহরে ভ্রমণের জন্য বাসের টিকিট কেনা যায়।
মেটার বিজনেস ম্যাসেজিং এর ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকিলা শ্রীনিবাসন বলেন, ব্যবসায়িক কোম্পানি ও গ্রাহক যেন চ্যাট থ্রেডে সবকিছু ঠিকভাবে করতে পারে তাই কোম্পানির লক্ষ্য। তিনি বিষয়টি আরও বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ টেনে আনেন। শ্রীনিবাসন বলেন, কোনো টিকিটের পেমেন্ট থেকে শুরু করে ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া সবই যেন চ্যাট থ্রেডের মাধ্যমে করা যায় তা হোয়াটসঅ্যাপ চেষ্টা করছে।
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো লিংকের জন্য হোয়াটসঅ্যাপকে অর্থ দিতে পারে। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের অনলাইন বিজ্ঞাপনে থাকা এসব লিংকে ট্যাপ করলে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে নতুন হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট শুরু হয়। আর এই এক সেবা থেকেই মেটা কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করে। এটি মেটার জন্য অত্যন্ত লাভজনক।
তবে অন্যান্য ম্যাসেজিং সেবা ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার জন্য জনপ্রিয় ‘সিগন্যাল’ আরেকটি প্ল্যাটফর্ম। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্ল্যাটফর্মটি কখনোই বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নেয়নি বলে দাবি করে কোম্পানিটি।
সিগন্যাল বিভিন্ন অনুদানের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০১৮ সালে হোয়াটসঅ্যাপের অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা বায়ার্ন অ্যাকটনের কাছ থেকে ৫ কোটি ডলার অনুদান সংগ্রহ করে টেলিগ্রাম।
তরুণ গেমারদের মধ্যে জনপ্রিয় ম্যাসেজিং অ্যাপ ডিসকর্ড। এতে বিনা মূল্যে সাইন আপ করা যায় এবং অ্যাপটির বিভিন্ন ফিচার বিনা মূল্যেই ব্যবহার করা যায়। তবে বিশেষ কিছু ফিচার যেমন: কোনো গেমের অ্যাকসেস পেতে ডিসকর্ডে অর্থ ব্যয় করতে হয়। এতে একটি ‘পেইড মেম্বারশিপও’ রয়েছে যার নাম ‘নিট্রো’। এই মেম্বারশিপ পেতে ব্যবহারকারীদের প্রতি মাসে ৯ দশমিক ৯৯ ডলার খরচ করতে হয়।
স্ন্যাপচ্যাটেও এই ধরনের বিভিন্ন পেইড মডেল রয়েছে। প্ল্যাটফর্মটিতে বিজ্ঞাপনও দেখানো হয়। স্ন্যাপচ্যাটে বর্তমানে ১ কোটি ১০ লাখ পেইড সাবস্ক্রাইবার রয়েছে (আগস্ট ২০২৪ অনুযায়ী)। এর পাশাপাশি স্ন্যাপচ্যাট স্পেকট্যাকেলস নামে অগমেন্টেড রিয়্যালিটি (এআর) চশমাও বিক্রি করে কোম্পানিটি।
ফোর্বস ওয়েবসাইটের মতে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত শুধুমাত্র সুদ থেকেই প্রায় ৩০ কোটি ডলার উপার্জন করেছে। তবে স্ন্যাপচ্যাটের এর প্রধান আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্ন্যাপচ্যাট প্রতি বছরে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করে।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কোম্পানি ‘ইলিমেন্ট’ও নিরাপদ ম্যাসেজিং সুবিধা দেয়। এই সিস্টেম ব্যবহারের জন্য সরকার এবং বড় সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অর্থ নেয় কোম্পানিটি।
কোম্পানিটি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথিউ হডসন বলেন, ম্যাসেজিং অ্যাপগুলো জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজনেস মডেল এখনো সেই ডিজিটাল বিজ্ঞাপন। অনেক ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্ম মানুষ কী করছে, কাদের সঙ্গে কথা বলছে, এসব পর্যবেক্ষণ করে এবং এরপর তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বিজ্ঞাপন দেখায়।
ম্যাসেজিং সেবাগুলোতে এনক্রিপশন এবং গোপনীয়তার ফিচার থাকলেও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে। এ জন্য মেসেজের মূল বিষয়বস্তু দেখার প্রয়োজন নেই। ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন ডেটা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে।
ম্যাথিউ হডসন বলেন, যদি আপনি ব্যবহারকারী হিসেবে কোনো প্ল্যাটফর্মকে টাকা না দেন, তবে সম্ভাবনা রয়েছে যে, আপনি নিজেই পণ্য।
তথ্যসূত্র: বিবিসি