Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

হানি ডেটিং

Icon

মনজুর শামস

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হানি ডেটিং

‘কী করছ সৃ?’

‘আমার আর কী কাজ, সু! বস আমাকে এই স্পেস স্টেশনে বসিয়ে রেখেছেন যে খই ভাজতে, সেই খই-ই ভাজছি দিন-রাত।’

‘মানে?’

‘আহ্, ন্যাকা! যেন কিছুই জানো না? জানো না, বস আমাকে এই মহাকাশ স্টেশনে ছ মাস ধরে লাগিয়ে রেখেছেন এই অ্যান্ড্রোনিডা ছায়াপথে নতুন যে গ্রহগুলোতে আমাদের কোম্পানির স্পেস প্রোব পাঠানো হয়েছে সেগুলো থেকে পাঠানো তথ্য মনিটর করে এক্সট্রা অরডিনারি কিছু পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানাতে?’

‘আরে, সে তো আমি জানি। জানতে চাচ্ছি ঠিক এখন কী করছ?’

‘রুটিন ওয়ার্ক। ইভা করছিলাম মিনিট দুয়েক আগে (মহাকাশ স্টেশনের বাইরের কোনো অংশ মেরামতের জন্য স্টেশনের বাইরে গিয়ে এক্সট্রা-ভেহিকুলার অ্যাকটিভিটি, সংক্ষেপে ইভা)। ফিরে এসে সবে সুপার মনিটরের সামনে বসব, তক্ষুনি তুমি কল করলে। তা কী ব্যাপার বলো তো, এত জরুরি তলব?’

‘বিপদে পড়েই কল করলাম। খুব বড় বিপদ। আর এই বিপদ থেকে তুমি ছাড়া কেউ আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না।’

‘প্রীত হলাম! তুমি যে আমার শ্রেষ্ঠাংশ! তোমাকে উদ্ধার করা মানে তো আমার নিজেকেই উদ্ধার করা। যাকগে, কী হয়েছে? জলদি বলো!’

‘তুমি তো জানো কী জটিল অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমার ওপর আস্থা রেখেই আমাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কাজে সফল হলে আমাদের কোম্পানিই শুধু লাভবান হবে না, এই গুড প্ল্যানেট (জিপি) জিরো নাইনও অনেক নিরাপদ ও উন্নত গ্রহ হয়ে উঠবে। আমাদের অন্যান্য বাসযোগ্য গ্রহের তুলনায় এ গ্রহটির জীবনযাপন হয়ে উঠবে সবচেয়ে আরামদায়ক ও সুখের। আরও জানো, এ অ্যাসাইনমেন্টের থিসিস ওয়ার্ক শেষ করতেই আমার দুবছর লেগে গেছে। তবে কাজে নেমে অবিরাম লেগে থেকে অনেকটা গুছিয়ে আনতে পেরেছি বলে সব কষ্ট ভুলে গেছি। আমি কখনো আত্মতৃপ্তিতে আচ্ছন্ন হই না, তবে বেশ স্বস্তিতে কাটছিল সময়...’

‘এই সবই আমার জানা। এখন কী হয়েছে তাই বলো।’

‘হয়নি, তবে সময়মতো ঠেকানো না গেলে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার এত দিনের পরিশ্রমতো পণ্ড হবেই, জিপি জিরো নাইনেও মহাপ্রলয় ঘটে যাবে।’

‘আমার কিন্তু সময় নষ্ট হচ্ছে। তোমারও। চট করে বলে ফেলতো ব্যাপারটা কী!’

‘বিশাল একটা গ্রহাণু ধেয়ে আসছে জিপি জিরো নাইনের দিকে। আয়তনে গ্রহটির প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। তার চেয়েও বিপদের কথা হচ্ছে, সুপার টেলিস্কোপের ক্যালকুলেটিভ মনিটর জানাচ্ছে এটি এসে আঘাত হানবে আমার প্রোজেক্টেই, মানে পান্নামুক্ত দ্বীপে।’

‘হিটিং টাইম বলো।’

‘দুদিন পর, রাত তিনটে থেকে তিনটে পাঁচের মধ্যে।’

‘তুমি এক্ষুনি এ সংক্রান্ত সমস্ত ডাটা পাঠাও আমাকে। আর বসকে ফোন করে অনুমতি নিয়ে নাও।’

‘বসের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিয়েই তোমাকে কল দিয়েছি। বস হয়তো এক্ষুনি ফোন করে তোমাকে দরকারি নির্দেশনা দেবেন। তোমার প্রস্তুতির জন্য আগেভাগে তোমাকে জানিয়ে রাখলাম। রাখছি। মেলা কাজ। এই টেনশন তো আছেই, তার ওপর জিপি জিরো এইটের ইনটেলেকচুয়াল ডিভাইস ইন্ডাস্ট্রি থেকে আনা দুই মিলিয়ন এআই সার্ভিস রোবোট সামলানো-বুঝতেই পারছ কী হ্যাপা সামলাচ্ছি। এবার বিপদ চুকিয়ে ফেলতে পারলে হানি ডেটিং করব, ঠিক আছে?’

‘ওকে! ভালো থেকো। টেনশন করো না। আশা করছি বরাবরের মতো এবারও তোমাকে বিপদমুক্ত করতে পারব। বাই!’

অ্যান্ড্রোনিডা ছায়াপথের বিভিন্ন গ্রহে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-মনন ও বোধে এখন সবচেয়ে উন্নত যে মানব জাতি বসবাস করছে তাদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিল মিল্কিওয়ে ছায়াপথের পৃথিবী গ্রহ থেকে। লোভ-লালসা-বৈষম্য-হানাহানি আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সেই গ্রহটা যখন ধ্বংসের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময় সেখানকার একদল বিজ্ঞানী অতিগোপনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবিরাম নিরলস চর্চায় সারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে খুঁজে বেড়াচ্ছিল নিরাপদ গ্রহ, যেখানে গিয়ে তারা বৈষম্যহীন মানবিক সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে। অবশেষে এ অ্যান্ড্রোনিডা ছায়াপথে তারা পৃথিবীর মতোই প্রাণীর বাসযোগ্য এক সবুজ-সতেজ গ্রহের সন্ধ্যান পেয়েছিল। কিন্তু তখন তাদের যে প্রযুক্তির দৌড় তাতে অন্যসব বিপত্তি বাদ দিলেও তাদের তখনকার সর্বোচ্চ গতির নভোযানে চড়ে বিঘ্নহীনভাবে সেখানে পৌঁছাতেই কয়েকশ হাজার কোটি বছর লেগে যেত। এমনকি আলোকের গতিতে রকেট ছোটাতে পারলেও কয়েকশ কোটি বছর লেগে যেত। প্রায় বছর পঞ্চাশেক এ ব্যাপারে নিবিড় গবেষণা করে অবশেষে তারা মনোবেগ আবিষ্কার করার পর অবশেষে তারা এ অ্যান্ড্রোনিডা ছায়াপথের জিপি জিরো ওয়ান গ্রহে পৌঁছাতে পেরেছিল। এখনো পর্যন্ত মনোবেগ হচ্ছে সর্বোচ্চ গতিবেগ। মনোবেগ হচ্ছে, এখানে বসে আমি মনে করলাম যে আমি দাদুবাড়ি চলে গেছি, অমনি আমি সেখানে পৌঁছে গেলাম, এ ধরনের একটা ব্যাপার। তবে সে গতি অর্জনের জন্য তাদের আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। দেহের প্রতিটি কোষ বিচ্ছিন্ন এবং পুনরেকত্রিকরণ করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে হয়েছে; যাতে করে দেহের সব কোষ বিচ্ছিন্ন হয়ে মন যেখানে চায় সেখানে ছুটে গিয়ে আবার একত্র হয়ে আগের অবয়ব ও প্রাণ ফিরে পায়।

প্রথম যে দলটি অ্যান্ড্রোনিডা ছায়াপথের গুড প্ল্যানেট জিরো ওয়ানে পৌঁছেছিল তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল, তারা তাদের এ নতুন গ্রহের জীবনযাপনে কিছুতেই শ্রেণিবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, আধিপত্যবাদকে প্রশ্রয় দেবে না। তাদের জগৎটা হবে শতভাগ মানবিক। বরং তারা দৃঢ়ভাবে এ মানবিকতার ক্রম-উন্নতি ঘটিয়ে চলবে। শুধু মানুষ নয়, গ্রহের প্রতিটি প্রাণীর সার্বিক বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে তারা ছিল বদ্ধপরিকর। নির্ভয় বিকাশের নিশ্চয়তা পেয়ে গ্রহের জীববৈচিত্র্য ও মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলায় কয়েকশ বছর পরই তারা বুঝতে পারল, শুধু এ গ্রহে বসে থাকলেই চলবে না। বাড়তে থাকা এসব প্রাণিকুল আর মানুষের বিচরণক্ষেত্রও বাড়াতে হবে। আর সেজন্য আরও কয়েকটি প্রাণিবান্ধব গ্রহে ঠিকানা গড়তে হবে তাদের।

সেভাবনা থেকেই এ মানবগোষ্ঠী ঠিক করেছে তারা কোনো রাষ্ট্র গঠন করবে না। তার বদলে তাদের নানামুখী চাহিদা মেটাতে গঠন করা হবে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানি। এ কোম্পানিগুলোতে এ ছায়াপথের সব মানুষের কর্মসংস্থান করা হবে। একেক কোম্পানি মানুষের একেক রকমের চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব পালন করবে। আর এসব কোম্পানির ভেতর পাল্লাপাল্লি চলতে থাকবে কোন কোম্পানির মানুষের মানবিক মান কতটা উন্নত। সৃ ও সু যে কোম্পানির কর্মী সেটি এ জিপি জিরো নাইন গ্রহটা নিয়ন্ত্রণ করে এবং এ অ্যান্ড্রোনিডা ছায়াপথের পুরো মানবজাতির জন্য খাবার পানি ও লবণ সরবরাহ করে। এ ছাড়া নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে থাকে। তেমনি এক গবেষণার কাজেই সৃ তাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডলের একটু বাইরে এ মহাকাশ স্টেশনে কাজ করছে মাস ছয়েক ধরে।

এদিকে সু এখন যে কাজের দায়িত্বে আছে সেটি সফলভাবে শেষ করতে পারলে তাদের গ্রহ ও কোম্পানি তো লাভবান হবেই, গ্রহের মানুষেরাও একটা পরম সুখের ঠিকানা খুঁজে পাবে। তাদের কোম্পানির সব মানুষ কোম্পানির সমৃদ্ধির জন্য তাদের সাধ্যমতো শ্রম দেয়, বিপরীতে কোম্পানিও তাদের প্রয়োজনীয় সব চাহিদা পূরণ করে। ছোট্ট এ গ্রহটিতে মহাসাগরের মাঝখানে বিশাল এক দ্বীপ রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং মাটির উর্বরা শক্তিতে দ্বীপটি গ্রহসেরা। কিন্তু বিপত্তিটা হচ্ছে, দ্বীপটি ভীষণ ভূমিকম্পপ্রবণ বলে এটি মানুষের বাসযোগ্য নয়। তাই তাদের কোম্পানি বিশাল এক প্রকল্প নিয়েছে পুরো দ্বীপটিকে ভূমিকম্পরোধী করতে। সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিরই দায়িত্বে রয়েছে সু।

সৃ ও সু এখনো কোনো সন্তান নেয়নি। অপেক্ষায় আছে হানি ডেটিংয়ের। এ ডেটিং থেকেই তারা সন্তান নেবে। এর জন্য তারা বেছে নিয়েছে জিপি জিরো ফাইভ গ্রহকে। সেই গ্রহ যে কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে তারা এ ছায়াপথের শ্রেষ্ঠ। এদিন সু লাইন কেটে দেওয়ার একটু পরই তাদের কোম্পানিচিফ সৃকে কল করে এ গ্রহাণু ধেয়ে আসার বিপদটি জানিয়ে এক্ষুনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মূল ভূখণ্ডে ফিরে গিয়ে সুকে সাহায্য করতে বলল। সৃ আর দেরি না করে তখনই শাটল ক্যাপসুলে করে রওয়ানা হয়ে গেল। মহাকাশে তারা কোনো স্পেস জাঙ্ক জমতে দেয় না। কয়েকটা সুইপার স্যাটেলাইট সব সময় পুরো ছায়াপথে চক্কর দিতে দিতে স্যাটেলাইট পাঠানো রকেট বা অন্যান্য মহাকাশ বর্জ্য পরিষ্কার করতে থাকে। সৃ এর আগেও মহাকাশ থেকে ছুটে আসা বেশ কয়েকটা গ্রহাণুকে মহাশূন্যেই দিক বদল করিয়ে দিয়েছে বা মাঝপথে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। এ কাজের জন্য অন্যান্য কোম্পানিও তাকে ডেকে নিয়ে যায়। পৌঁছেই সু-এর সঙ্গে কাজে লেগে পড়ল সে।

মনিটর থেকে সু চোখ সরাচ্ছে না। গ্রহাণুটির ধেয়ে আসা পর্যবেক্ষণ করছে আর সৃকে তা জানিয়ে দিচ্ছে। সৃ বুস্টার রকেটে ক্যাচার সেট করছিল। এত বড় গ্রহাণুকে পুড়িয়ে দিয়ে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি নিতে চাইছে না সে। সে বরং মহাশূন্যে থাকতেই গ্রহাণুটিকে ক্যাচার দিয়ে আঁকড়ে ধরে দিক বদলে এটিকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছে। গ্রহের সবচেয়ে শক্তিশালী টাগিং রকেটটাতে গ্রহাণুটির মাপমতো ক্যাচার সে এরই মধ্যে জুড়ে নিয়েছিল। সে একাই যাচ্ছে এ অভিযানে, অন্য কারও জীবনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। সব প্রস্তুতি শেষ করে লাঞ্চিং প্যাডে রকেটে উঠে সুর গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় থাকল সে। রকেট মনিটরে সবুজ বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হেডফোনে সু-এর গলা শুনতে পেল-

‘সৃ, স্টার্ট। মুভ!’

‘ওকে।’

রকেটটা আকাশে উঠে যেতেই চোখ দুটিকে মনিটরে আঠার মতো লাগিয়ে রাখল সু। রকেটটি মহাকাশে গিয়ে গ্রহাণুটির দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। এটির কাছাকাছি চলে যেতেই তার চোখ দুটি পলকহীন হয়ে পড়ল। টেরও পেল না কখন তাদের বস এসে ঠিক তার পেছনের চেয়ারটিতে বসে মনিটরে চোখ রেখেছে।

চার হাত-পা এবং মগজ সমান তালে চলছে সৃর। গ্রহাণুটির কাছাকাছি নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়েই সে রকেটের গতিবেগ এটির সঙ্গে সমন্বয় করে নিল। এরপর ক্যাচার ছুড়ে মারল। ক্যাচারের থাবাগুলো গ্রহাণুর গায়ে সেঁটে যেতেই প্রচণ্ড বেগে রকেট ছুটিয়ে দিল সে যেদিকে এটিকে নিয়ে যেতে চায় সেদিকে। বেশ কিছুক্ষণ প্রবল ঝাঁকি খেয়ে খেয়ে অবশেষে তার রকেটটা গ্রহাণুটিকে টেনে নিতে থাকল নির্দিষ্ট অভিমুখে।

নিশ্বাস বন্ধ করে মনিটরে সব লক্ষ করছিল সু। গ্রহাণুটা তাদের গ্রহের কক্ষপথ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে সৃ এটিকে ছেড়ে দিয়ে ক্যাচার তুলে নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করতেই লাফিয়ে উঠে হাততালি দিয়ে উঠল সু। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সবাই। ঠিক কানের পেছনে তালি বেজে ওঠায় পেছন ফিরেই সে তাদের বসকে দেখতে পেল। আনন্দ-উত্তেজনায় খেই হারানো তার চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। বস তার সঙ্গে খুব ঝাঁকিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল-

‘কনগ্রাচুলেশন, দ্য হ্যাপিয়েস্ট কাপ্ল অব দ্য প্ল্যানেট। হ্যাপি হানি ডেটিং ফর ইউ।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম