Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

গল্প

অভেদ্য

Icon

মামুন আজাদ

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অভেদ্য

সকালে আমার ঘুম ভাঙত না। প্রতিদিন আমাকে জাগিয়ে দিত হাসমত। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে থাকতাম, মমিন চাচার দোকানে নাশতা করে তড়িঘড়ি ছুটতাম ক্লাসে।

খালাতো বোন জান্নাতের ক্যাডিলাক গাড়িটা পৌঁছাত কাঁটায় কাঁটায়। আমার সঙ্গে প্রায় ঝগড়া লাগত জান্নাতের।

আমার মতো স্মার্ট একটা ছেলে কীভাবে হাসমতের মতো বোকা-পাঁঠার সঙ্গে মিশি এই নিয়ে ওর যত অভিযোগ।

আমরা একই ক্লাসে পড়তাম; আমি, জান্নাত আর হাসমত, সবাই ওকে ডাকত হাবা হাসমত বলে।

জান্নাতকে কখনো হাসমতের সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। আর এটা অস্বাভাবিকও ছিল না, চোস্ত ইংরেজি বলা জমিদারের মেয়ে জান্নাত ছিল হলিউডের নায়িকা ‘অর্ডে হেপবার্ন’-এর মতো দেখতে, হাসমতের মতো ‘প্রডাকশন বয়কে’ ও কেন পাত্তা দেবে!

সময়টা উত্তাল ছিল খুব।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে।

আসাদকে গুলি করা হলো মোহাম্মদপুরে, ওর রক্তে ভেজা শার্টে ক্যাম্পাস তখন অগ্নিগর্ভ। মিছিলে মিছিলে উত্তাল জনসমুদ্র।

অথচ হাসমত নির্বিকার। মিছিল-মিটিং-এ ভীষণ ভয় পায়, বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হাসমত কুরআন ছুঁয়ে শপথ করেছে, কোনো রকম ফ্যাসাদে যাবে না।

এসব শুনে আরও বিরক্ত হতো জান্নাত! এমন কাপুরুষের সঙ্গে আমি কেন যে মিশি?! আবার অভিযোগ জান্নাতের।

শুনে আমি হাসতাম।

সত্তরে নির্বাচন হলো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা ছাড়বে না। চারদিকে আন্দোলন, আগ্নেয়গিরির গুড়গুড় শব্দ।

৭১-এর পঁচিশ মার্চের রাত। আমরা হলে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ হাসমত চিৎকার করে উঠল। সারা শহরে আগুন জ্বলছে, ঠাস ঠাস গুলির শব্দ।

আতঙ্কের রাত শেষ হলো অথবা শুরু!

চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ।

২৬ র্মাচ চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা এলো।

রক্তে তখন ‘বিপ্লবের’ নেশা।

যুদ্ধে যেতে হবে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে।

হাসমতকে বলতেই ও কেঁপে উঠল, ‘না না আমার ভীষণ ভয় করে, আমি যুদ্ধে যেতে পারব না, তাছাড়া মায়ের আদেশ।’

এই প্রথম বিরক্ত হলাম ওর প্রতি! জান্নাত হয়তো ঠিকই বলে!

শেষ পর্যন্ত আমার যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। আমার হবু শ্বশুর পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব। সে হিসাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ সম্ভব না!

‘চে’ আর ‘ফিদেল ক্যাস্ত্রো’র চেতনা পরাজিত হলো যুক্তির কাছে।

আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ, হঠাৎ দেখা হলো হাসমতের সঙ্গে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গামছায় মুখ ঢাকা, হাতে এসএমজি।

আমার অবাক দৃষ্টি বুঝতেই ও বলল ‘সবুজকে ওরা মেরে ফেলেছে!’

সবুজ মানে ক্যান্টিনের ওই এতিম ছেলেটা, যে পিচ্চিটা আমাদের খাবার এগিয়ে দিত!

আমি বিস্মিত হলাম!

‘হাবা হাসমত! ওর নামটাই তো ভাঁড়ের, ও করবে যুদ্ধ!’ জান্নাতকে বলতেই ঠোঁট উলটাল সে।

অক্টোবরের শেষের দিকে, ঢাকার অবস্থা তখন ক্রমশ খারাপের দিকে, প্রায়ই গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী।

হঠাৎ একদিন গামছায় মুখ ঢাকা হাসমত হাজির। চেহারা চেনা যায় না।

‘কী দোস্ত, নায়িকা কেমন আছে?

তা দোস্ত! চানখাঁরপুলে কেমন মাইর দিলাম শালাদের?!’

হাসমতের কথায় আমি আকাশ থেকে পড়লাম!

‘তুই ছিলি ওই দলে? তুই!!’

আরে তোমার কাছ থেকেই তো শিখেছি ‘হিট অ্যান্ড রান’। হাসমতের কথায় আমার রক্তে তুফান উঠল!

আমার বন্ধু, আমার রুমমেট, আমাদের হাবা হাসমত!

জান্নাতকে শোনালাম ‘হাসমতের কথা’ সত্যিকারের ‘জেমস বন্ডে’-এর কথা। এই প্রথম কোনো বিরূপ মন্তব্য করল না ও!

‘হাসমতে’র শেষ খবর পাই, আমার শ্বশুর পক্ষের থেকে, হানাদারদের হাতে বন্দি, শত অত্যাচারেও মুখ না খোলা আমার বন্ধু হাসমত, হাবা হাসমত, সত্যিকারের বীর।

যুদ্ধ শেষ হলো।

সময়ের সিঁড়িতে প্রচণ্ড ব্যস্ত আমি তখন বিলেতে। জান্নাতের বিয়ে হয়েছে এক জার্মানের সঙ্গে। অনেকদিন পর, প্রায় সাত বছর হবে, রিচার্সের কাজে জার্মানি যেতে হলো, জান্নাতের কাছে ফোন করতেই ও খুব করে ধরল ওর বাসায় যাওয়ার জন্য।

কলিংবেল টিপলাম, দরজা খুলল পাঁচ-ছয় বছরের ফুটফুটে এক রাজপুত্র। চেহারায় জার্মান রক্তের ছাপ। তবে চোখ দুটো ভীষণ কালো, ভীষণ চেনা! দেখলেই বোঝা যায়, এ চোখ বাংলার, এ চোখ আমার রুম মেট...!

‘হাসমত এই হাসমত কোথায় তুই!’

পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল জান্নাত।

আমার চোখের সামনে জান্নাত, আমার কাজিন, আমার বন্ধু, আমাদের ‘অর্ডে হেপবার্ন’।

পরম মমতায় ছেলেটিকে বুকে নিল জান্নাত। আমি তাকালাম ওর চোখের দিকে। জান্নাতের চোখে জল। পুরুষ মানুষের চোখে জল আসা ভীরুতার লক্ষণ, তবু দু’ফোঁটা জল কখন জানি গড়িয়ে পড়ল আমার গাল বেয়ে...

মুহূর্তে চোখে চোখে আমাদের অনেক কথা হয়ে গেল।

সৃষ্টিকর্তা এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এক বিপুল রহস্যে কিন্তু প্রতিদিন প্রতিক্ষণ পৃথিবীর কোনো না কোনো স্থানে কেউ না কেউ আবিষ্কার করছে মহাবিশ্বের কোনো না কোনো রহস্য।

কিন্তু সৃষ্টির আদি থেকে যে রহস্যের শুরু, সে নারী মনের রহস্য ভেদ হয়নি কখনো!

হয়তো নারী মন দুর্ভেদ্য নয় ‘অভেদ্য’।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম