Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

আমি তোমার ক্রাচ হব

Icon

ইলিয়াস বাবর

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমি তোমার ক্রাচ হব

আসিফের মন বেশ ফুরফুরা। বহুদিনের গোপন ইচ্ছেটা আজ বাস্তবে ধরা দিচ্ছে হাতে। রেশমার সঙ্গে মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলতে বড় অসুবিধা হয়। যাত্রীরা নানা কথা বলে, ঝুঁকি থেকে যায়। মোবাইল সরঞ্জাম বিক্রের মার্কেট থেকে ব্লুটুথ হেডফোনটা কিনে বের হতে হতে নানা ভাবনা এসে জড়ো হয় আসিফের মনে। রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার গাড়ি, রুটি-রুজির মাধ্যম। সবুজ রঙের সিএনজিটা তার সংগ্রামী জীবনের অকৃত্রিম বন্ধু। ক্রাচে ভর দিয়ে টুপ করে সে ঢুকে যায় ড্রাইভারের নির্ধারিত জায়গায়। অবশ্য অনেকের বিস্মিত চোখ তাক করা থাকে তার দিকে, তার ভর করে চলার দিকে। না, ভাড়ার জন্য আজ দাঁড়িয়ে থাকে না আসিফ। কট করে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। গাড়ির চাকার গতির সঙ্গে ভাবনায় ভিড় করে রেশমার কথা। রেশমা তার কাছে অদেখা এক মানবীর নাম, যাকে ঘিরে আছে অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক বালিয়াড়ি। কত আর? মাস তিনেক হবে রেশমার সঙ্গে ফোনে পরিচয় আসিফের। রেশমার নাম্বার আসিফ পেয়েছে তাও সিনেমার মতো এক ঘটনায়। কথা বলতে বলতে জমে গেছে ভাব, হয়ে গেছে ভালোবাসা। প্রিয় জায়গা সিআরবির সবুজ বুকে গিয়ে থামে আসিফের সবুজ-যান। গাড়ি রেখে কায়দা মতো বসে আসিফ, অনতিদূরে দেখা যায় অনেক যুগলের উপস্থিতি। রিং পড়তেই ওদিকের ঘানিভাঙা সরিষার তেলের সুঘ্রাণ ভরা কণ্ঠে ভেসে আসে-

: কিরে আজ খুশি খুশি লাগছে তোমারে ঘটনা কী?

: তোমাকেও তো খুশি লাগছে আজ। বলে আসিফ।

: আগে তোমারটা বলো, কী হইছে? রেশমার প্রতিউত্তর।

: আমার আর কী, একটা ব্লুটুথ হেডফোন নিচি, এটাই।

: আরেব্বাহ, মজা তো। আমারটা তেমন ঘটনাই না তোমারটার তুলনায়!

: আরে মশকারা করো কেন? আমার কিন্তু তর সইছে না আর!

: আইছে আমার নাগর! তাইলে বলবোই না আর!

: বলো না রেশুসোনা, প্লিজ...

: আগামী শুক্রবার তোমার সঙ্গে দেখা করব, বিকেলে। সূর্য যখন বিকেলের কোলাহলে ক্লান্তির লালিমা নিয়ে ঢলে পড়বে পশ্চিম দিকে, আমরা তখন সিরআরবির সবুজে আড্ডা দেব, কেমন হবে ভাব তো একবার!

: আচ্ছা। এটুক বলার পর যেন কোনো কথাই বের হয় না আসিফের মুখ দিয়ে। জিনে পাওয়া বেকুবের মতো এক দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল। বিস্ময় আর ঘটনার আকস্মিকতায় সে বিমূঢ়। কখন যে রেশমা ওদিক থেকে ফোন কেটে দেয় ঠাহর করতে পারে না আসিফ।

ইনকাম যা হয়েছে আজ মন্দ না, ভাবে আসিফ। মনে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে রেশমার আতকা দেখা করার বাসনা। তার সঙ্গে পরিচয়, ভাব-ভালোবাসা স্বপ্নের ব্যাপার এক্কান, হুট করে ঘটে গেছে। একবার ভাড়া নিয়ে যাচ্ছিল আসিফ আগ্রাবাদে। চোকরাগোছের যাত্রী। নিজের মতো চালাচ্ছিল সে। হঠাৎ হঠাৎ যাত্রীর ফোন বেজে উঠা দেখে বুঝে নেয়, এ-বড় সেয়ান মাল; সাইজ ছোট হলেও কামে জব্বর! ফোনের এ প্রান্ত থেকে যাত্রী বলে, ধর এ নাম্বারটা নে, ভিড়াতে পারলে কেল্লাফতে। ওই ফাঁকে আসিফ নাম্বারটা তুলে নেয় নিজের ফোনে, খুব সন্তর্পণে। আগ্রাবাদে যাত্রী নামিয়ে সাইট করে দাঁড়ায় আসিফ। ফোন দেয় কিছুক্ষণ আগে পাওয়া বেনামি নাম্বারে। মেয়েলি স্বর, বোঝা যায় বোকা কিসিমের। আরেকটা ভাড়া নিয়ে আসিফ চলে আসে বহদ্দারহাটে, কথা তবু শেষ হয় না। নাগরিক হলাহল আর জ্যামের হর্ন শুনে ওদিক থেকে প্রশ্ন ওঠে, এত শব্দ কেন? আসিফও বিজ্ঞের মতো জবাব দেয়, আমার ব্যবসা পথেঘাটে! এরপর কত দিন চলে গেছে, বয়ে গেছে কত জল কর্ণফুলীতে। দুজনের মনের বিন্দু মিলেছে এক সিন্ধুতে। রেশমার দেখা করার প্রস্তাবে কিছুটা ঘাবড়ে যায় আসিফ। প্রথমত তার শারীরিক অক্ষমতা। জগৎসংসারে দুই পায়ের বহু কাবিল পুরুষরে পছন্দ করছে না অনেকে, সেখানে তার মতো এক পায়ের সিএনজিওয়ালাকে দেখে রেশমা দুঃখ পাবে না তো! একে তো বয়স বেড়েছে তার ওপর এক পা নেই, ভাবতেই জ্বর আসে যেন আসিফের। জন্মদুঃখী সে, বাবাকে হারিয়েছে ছোটকালে, বয়সকালে দুর্ঘটনায় গেছে এক পা। সংসারের বড় ছেলে; মা, ভাইবোনসহ চারজনের ভার টানছে সে ছোটকাল থেকে। পা হারানোর পর সিএনজি চালায়, অন্য পেশায় নেবে কে তারে? এককালে চালাত ব্যাটারিচালিত রিকশা, এখন ওটা চালানো দায়, পুলিশে জরিমানা করে, পেটায়। সেই থেকে সিএনজির ড্রাইভার আসিফ। বাসায় গিয়ে রেশমাকে ফোন দেবে সে জো নেই। দুরুমের এক বাসায় চারজনের বাস, প্রাইভেসি আর কই! অগত্যা সিদ্ধান্ত নেয়, রেশমা যখন আসবে, তখনই খুলে বলা যাবে।

ওদিকে রেশমার বিপদ আরও ভারী। জগতের তামাশায় সে ভয়ানক বিরক্ত। তাতে আর না পেরেই আসিফকে বলেছে, দেখা করবে; দেখা করা মানেই এসপার কি ওসপার! আচ্ছা আসিফ কি তাকে পছন্দ করবে? তার যে অতীত আছে, দুষ্টু অতীত! গ্রামে রেশমার বিয়ে হয়েছিল আরও বছর তিনেক আগে। দেখেশুনে বিয়ে অথচ কপাল ভাঙল তার! বিয়ের বয়স সপ্তাহখানেক না যেতেই জামাই তার রাতে বাড়িতে থাকে না। বের হয়ে যায় নানা ছুতোয়। পরে লোকমুখে এবং নিজেও সে আবিষ্কার করে, জামাই তার পেশাদার চোর! জামাইকে সে বোঝায়, পাঠ দেয় মানুষের। যার অভ্যাস আর নিয়তে গণ্ডগোল তাকে বদলাবে কে? পারেনি রেশমা; পাক্কা এক বছরের সাধনায় ঠিক করতে পারেনি সে জামাইকে। চুরি করা গয়না আর টাকা পয়সার লোভ দেখায় বর, তাতে মন দেয় না রেশমা। পরের ধনে পোদ্দারি করা কি চুরির মালে মন ভেজানোর মেয়ে না রেশমা। কাউকে কিছু না বলে মোরগডাকা ভোরে সোজা চলে আসে বাপের বাড়ি। না, বাপ-ভাই তার বিষয় বুঝতে চায় না, এক কথা, চোর হলেও সে মরদ; তার ঘর করা লাগবেই! মুখের ওপর না করে দেয় রেশমা। রিকশাওয়ালারে বিয়ে করবে সে তবুও লোকে বলবে চোরের বউ, এ অপবাদ সহ্য করবে না। চোরের খানাপিনা, সংসারে ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করে তার। তারচে ভালো পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করা, হকহালাল মতো চলা কারও পথপানে চেয়ে থাকা। সেই থেকে বড়রা তেমন ঘাটায় না আর রেশমাকে। চোরজামাই এসেছিল তাকে ফিরিয়ে নিতে, কিরাকসম কেটেছে, তাতে মন গলেনি রেশমার, যাওয়া হয়নি আর চোরের বাড়ি। এখন সে থাকে শহরে, বড় ভাইয়ের বাসায়। বসে থাকেনি অবশ্য, কাজ নিয়েছে গার্মেন্টেসে। গার্মেন্টসকন্যা, প্রথম স্বামীকে ত্যাগ করা রেশমাকে কে তবে পছন্দ করবে ঠেকায় না পড়লে? আসিফ কি বুঝবে মনের পেরেশানি, ভাবে রেশমা। দেখা যখন হবে প্রাণ খুলে সব বলে দেবে, মনে মনে এই প্ল্যান তার। দেখা যাক, ওদিকের মতিগতি। ভাঙা কপালে সুখ না থাকলে কে দিতে পারবে তবে?

শুক্রবারে গাড়ি বের করেনি আসিফ। সেলুনে গিয়ে ক্লিন সেভ করে আসে। মনের দুর্বলতা কাটার যাবতীয় আয়োজন করে সে। মা কিছুটা আঁচ করে বিষয়টা। বলে, আজ কোথাও দাওয়াত আছে নাকি? দাওয়াতে যাবে ভালো, টেনশন করছ কেন? তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে আসিফকে বেশিই স্নেহ করেন মা। স্বামীহীন সংসারে এ আসিফই তো সব করে যাচ্ছে সমানে। আজ ছেলের সাফসুতুরে ভাব দেখে তার বেশ ভালোই লাগে। ক্রাচে ভর দিয়ে মোড়ে যায় আসিফ। পড়ন্ত বিকেলে একটা রিকশায় চেপে সোজা সিআরবি। আজ রেশমার সঙ্গে দেখা করার দিন, জগতে মহাআনন্দের দিন।

রেশমার আজ ছুটি। কোনো কোনো শুক্রবার কাজ করতে হয় ফ্যাক্টরিতে। তখন সপ্তাহে একটা পাওয়া দিন নিজের কাছে রাখতে না পারার দুঃখে নিজেদের হাবিয়া দোজখের বাসিন্দা মনে হয় রেশমাদের। আজ আসিফের সঙ্গে দেখা করার দিন। সাজগোজ আর নতুন জামায় বেশ লাগে রেশমাকে। আয়নায় নিজেকে বারবার দেখে সে। বের হওয়ার আগে গায়ে চাপিয়ে দেয় বোরকা। বোরকা ছাড়া বাইরে যাবে সেই সাহস শহরে এসেও হয়নি তার।

সিআরবি আসার পর মিনিট দশেক বসে আসিফ। বড় শিরিষগাছের তলায়। ক্রাচটা তার পাশেই শুয়ে রাখে। মোবাইল বের করে ফোন দেয় রেশমাকে। রিসিভ করতে একটু দেরিই করে সে। তারপর হাসিহাসি গলায় বলে

: তোমার জন্যই তো বসে আছি সিআরবিতে কতক্ষণ ধরে...

: চাপা আর মেরো না। কই আছো তাই বলো?

: সত্যি, সিআরবিতে। তুমি কোথায় বলো?

: আমি ডানদিকের বড় শিরিষগাছের নিচে বসে আছি।

: তাই? কী রকম জামা পরছ?

: জামা দেখে চিনতে হবে? মন দেখে চিনবে না?

: হেয়ালি করো না তো? বলো না?

: কফি কালারের জামা পরা আমি। চলে এসো কালার মিলিয়ে...

ফোন কেটে দেয় রেশমা। এক মিনিট না যেতেই বোরকাপরা এক নারীর উপস্থিতি পেয়ে আসিফ নিশ্চিত হয়, এই-ই তার রেশমা।

পাশে বসে রেশমা। দুজনের মুখে কথা নেই। কথারা আজ হারিয়ে গেছে সিআরবির সবুজে। নীরবতা ভেঙে টুকটাক কথার ফাঁকে দুজনে বাদাম ভাঙে। ক্রমশ দুজন হৃদয় খুঁড়ে যায় দুজনের। বলে যায় দুজনের গভীরতম দুঃখের কোরাস। দূরে ফুচকাওয়ালার দিকে রেশমার ঘনঘন দৃষ্টি দেখে আসিফ বুঝে নেয়, ফুচকা খেতে চায় প্রাণের সই। উঠতে গিয়ে আসিফ টেনে নেয় ক্রাচ। তারও আগে দুজন শেয়ার করে নেয় অতীতের মরিচাধরা সময়ের কথা। অতীতকে তারা সামনে আনতে চায় না আর। ভবিষ্যতের যে সৌন্দর্য তাতেই রঙিন করতে চায় বর্তমানকে। রেশমার কাঁধে ভর করে ফুচকাওয়ালার স্টলে আসার সময়টাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সময় মনে হয় দুজনের, এজন্যই অপেক্ষা জনম জনমের। সিআরবিতে সন্ধ্যা নেমে এলে একই রিকশায় উঠে পড়ে রেশমা-আসিফ।

সিআরবির অপূর্ব সন্ধ্যা পেরিয়ে কথা বিনিময়ের সপ্তাহখানেক পর রেশমা জানায়, সে আর বড় ভাইয়ের বাসায় থাকবে না। বড় ভাইকে আসিফের কথা বলতেই তেলেবেগুনে আগুন। ওসব শহুরে পোলাপাইনের বিশ্বাস নাই, এরা নেশাপানি করে। এক পা-ওয়ালা সিএনজি ড্রাইভারকে কোন শালায় বোন দেবে, এ্যা? রেশমার এক কথা, মেয়েরা ছেলের চোখ দেখলেই বোঝে; আসিফ ওরকম ছেলে নয়। পা নেই তো কী হয়েছে? তার মন আছে, পরিশ্রম করার চেষ্টা আছে। চাইলে সে ভিক্ষা করতে পারত, তা না করে সিএনজি চালায়, এটা অনেক অনেক বড় সম্মানের। তবুও ওই লুলা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব না, শুনে রাখ কান ভরে, বড় ভাইয়ের কড়া হুঁশিয়ারি। রেশমার এসব শুনে আসিফ সিদ্ধান্ত নেয় বিহিত একটা করেই ফেলবে সে। আর নয়, ওরকম একটা মেয়ের পবিত্র ভালোবাসা আর অবহেলা করা যায় না।

: তো, কী করতে চাও? আসিফের প্রশ্ন

: কাপড়চোপড় নিয়ে সন্ধ্যায় চলে আসব বহদ্দারহাটে। তুমি থাকবে মোড়ে।

: ভেবে দেখো সোনা।

: না, ভাবার আর কিছু নেই। তুমি কি সরে যেতে চাচ্ছ?

: ধুর পাগলি। তা হবে কেন? তবুও যে কোনো কাজ ভেবেচিন্তে করা ভালো।

: ভাববার আর কাম নাই। আমার মোবাইল বন্ধও থাকতে পারে।

: কেন? কেন বন্ধ থাকবে তোমার ফোন?

: সেসব চিন্তা করতে হবে না তোমাকে।

: আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে।

: ঠিক সাতটায় থেক। পারলে পাঞ্জাবি পরে আসবে, মাথায় টুপি। ঠিকাছে?

: ঠিকাছে।

গাড়ি গেরেজে রেখে ঠিক সময়ই এসে যায় আসিফ। কাউকে বলবে সে সময় নেই। ক্রাচে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে আসিফ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জিনের মতো পাশে এসে টুপ করে দাঁড়িয়ে যায় রেশমা। আজ তাকে বেশ সুন্দরই লাগছে। নাকের ডগায় হালকা ঘামের ফোঁটা তাতে জোগাচ্ছে বাড়তি সৌন্দর্য। আচমকা ক্রাচটা টেনে নিয়ে ফেলে রেশমা। ফেলে দেয় ফুটপাতে। বলে, তোমার আর ক্রাচে ভর দেওয়ার দরকার নেই, আমার কাঁধে হাত রাখ। এখন থেকে তিন পা-ই চার পায়ের শক্তিতে চলবে সামনের দিকে। চলো, ওই দিকেই তো কাজী অফিসটা...

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম