-67d7a483d80e1.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
বিদায়। সবসময় মধুর হয় না। আবার সবসময় যে কষ্টের হয় তাও বলা যাবে না। কখনো কখনো বিদায় খুব কঠিন আকার ধারণ করে— এটা আমরা অনুমান করতে পারি। আবার কখনো ভালোবাসায় মুড়িয়ে দেয় জীবন, ছুঁয়ে যায় মন। আনন্দ-হাসির মিশেলে লুকিয়ে পড়ে নীল বেদনার ছাপ। তবে সবকিছু মিলিয়ে বিদায়, এক কথায়— বেদনাবিধূর।
সম্প্রতি আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের অবসর কিংবা বিদায় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে পঞ্চপাণ্ডবের বিদায় নিয়ে। কেন এমন বিদায় পঞ্চপাণ্ডবের? তাদের বিদায় তো বীরের বেশে; টুপিখোলা সম্মান দিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
ক্রিকেটে একটা সময় বয়স হলে বিদায়ের সুর বাজে। সবাই অবসরে যাওয়ার কথা ভাবে। কেউ অবসরে যেতে বলে, আবার কেউ খেলতে বলে। এটা বুঝে নিতে হয়, খরচের খাতায় নাম; তাকে বাতিল বলে গণ্য করা হয়। তখন আর কেউ তার নাম মুখে নিতে চায় না। অথচ সেই ক্রিকেটারই একটা সময় ১৬ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। লাল-সবুজের পতাকাটা সারা দুনিয়ায় ব্র্যান্ড করেছে। নিজেদের জাত চিনিয়েছে। কত হাততালি আর ভালোবাসা পেয়েছে। অথচ আমরা এখনো অনায়াসে বলতে পারি— পঞ্চপাণ্ডব এখনো দেশসেরা ক্রিকেটারই বটে।
পঞ্চপাণ্ডবের খেলার মান তরুণ ক্রিকেটারদের থেকে অনেক ভালো, তারপরও আমরা কেন জানি এটা মেনে নিতে পারি না। এটা শুধু ক্রিকেটপ্রেমী সমর্থকই নয়; সাবেক ক্রিকেটার, ক্রিকেট বিশ্লেষক, সমালোচক থেকে শুরু করে বিসিবির কর্মকর্তা-পরিচালকরা সঠিক কোনো জবাব দিতে না পারলেও নানা মন্তব্য করে থাকেন—মাশরাফির অবসরটা কেমন হয়ে গেল। কবে বিদায় নিচ্ছেন মুশফিক, কবে অবসরে যাচ্ছেন মাহমুদউল্লাহ। কতদিন খেলবেন তামিম ইকবাল। আর সাকিবের কথা বাদই দিলাম; ও তো দেশে নেই... ইত্যাদি।
হোটেল রুমে আড্ডায় মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক ও রিয়াদ
বয়স হলে যে খেলোয়াড়ই হোক, আর যত ভালো খেলেই থাকুক না কেন— আমরা তারপরও সেই খেলোয়াড়ের মুখ থেকে বিদায় শুনতে চাই। অথচ আমরা এক টুকু ভাবি না— আমরা কি একজন মাহমুদউল্লাহর বিকল্প পেয়েছি? আছে আমাদের একজন সাকিব আল হাসান? আমরা কি পেয়েছি একজন তামিম ইকবাল, যে ১৭ বছর ধরে একাই ওপেনিং করে গেছেন? তার কোনো যোগ্য সঙ্গী ওপেনার আমরা খুঁজে পেয়েছি কি? আমরা যে এখনো তামিম ইকবালের ওপেনিং পার্টনার তৈরি করতে পারিনি—এটা কি কখনো ভেবেছি?
অথচ তামিম বিদায় বলার পরও ডিপিএলে পরপর দুটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে জানান দিলেন, সে এখনো ফুরিয়ে যাননি, তাকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছে। তাই আমরা শুধু বারংবার এ কথাই ভেবেছি— তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা আর কতদিন খেলবেন; কবে অবসর নেবেন? কবে নতুনদের জায়গা ছেড়ে দেবেন?
নতুনদের জায়গা। নতুন আর পুরোনো নিয়েই তো এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে উত্তম পন্থা। কিন্তু আমরা যেন পুরোনোদের বিদায় করতে পারলেই বাঁচি। অথচ মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর অবসরের বিষয়ে জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাসুদ পাইলট এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—জাতীয় দলে টিকে থাকার জন্য যে দৌড় হচ্ছে, সেখানে মুশফিক (৩৭)-মাহমুদউল্লাহ (৩৯) ভালোভাবে সামনের সারিতে আছে। আর আশরাফুল বলেছেন—তাদের ছাড়িয়ে যাবেন এমন তরুণ ক্রিকেটারও নেই।
এ ধরনের কথা বোর্ডঘনিষ্ঠরা শুনতে প্রস্তুত নন। তাদের হাবভাব এ রকম যে— মুশফিক-রিয়াদ-তামিম-সাকিবদের বিকল্প তারা পেয়েছেন। তাদের আর প্রয়োজন নেই। তাই চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে খেলতে যাওয়ার আগে বক পাখির মতো গলা উঁচিয়ে বলে গিয়েছিলেন—চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছি; অধিনায়ক শান্ত বললেন— সাকিবকে মিস করবে না। আর শান্ত সাকিবকে মিস না করা প্রসঙ্গে ভারতীয় এক সাংবাদিক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন— সাকিব ৯/১০ বছর তিন ফরম্যাটে ১ নম্বর। এ রকম একটা প্লেয়ারকে মিস করবে না—এটা আমি কখনোই বিশ্বাস করি না। সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিক বলেছিলেন— আমরা কীভাবে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাই, সাকিবের মতো বাংলাদেশের কয়টা প্লেয়ার বিশ্বকাপ খেলেছে।
অথচ আমরা এই চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে যদি তামিম ইকবাল ও সাকিবকে নিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে কেউ হাস্যকর মন্তব্য করতে পারত না; আমি অনন্ত এটুকু বিশ্বাস করি। কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে, কোন মন্ত্রে ক্যারিয়ার থাকা সত্ত্বেও তামিম ইকবাল বিদায় বলে দিলেন, তা বোধগম্য নয়। আর কোন ইগোতে সাকিবকে ফেরানো হলো না, তা বোধগম্য নয়।
চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে খেলতে যাওয়ার আগে থেকেই মুশফিক ও রিয়াদকে নিয়ে যে মন্তব্য, তাতে আর যাই হোক সেই টুর্নামেন্টে তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা মোটেও ঠিক নয়। কারণ মানসিকভাবে তারা বিধ্বস্ত। এমন পরিস্থিতিতে মাঠে গিয়ে ভালো ফল প্রত্যাশা করা যায় না। সে কারণে দুই ভায়রাভাই সুপার ফ্লপ। এটা হতেই পারে। কিন্তু হুট করে আন্তর্জাতিক বিদায় বলে দেওয়ার পর আবার সেই সমালোচকরা তাদের ভূয়সী প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
এখন এতটাই তাদের প্রতি দরদ বেরিয়ে আসছে যে, কিছু কথা না বললেই নয়; তারা এভাবে কেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিদায় বললেন। তারা তো চাইলে মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারত। আর এ বিষয়টি মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়েছে সাবেক ক্রিকেটার ও সাবেক বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনের। তাই তিনি তার ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমে।
সমুদ্র বিলাসে মুশফিক, তামিম, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মাশরাফি
মাঠ থেকে কোনো ক্রিকেটারের বিদায়
এর আগে ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেছিলেন সাবেক স্পিনার মোহাম্মদ রফিক। সেটিই ছিল বাংলাদেশের বড় কোনো ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার সর্বশেষ ঘটনা। তার আগে ২০০৬ সালে বগুড়ায় শ্রীলংকার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে মাঠ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। এই ছিল আমাদের দেড় যুগ আগের বিদায়ী ইতিহাস।
মাশরাফি বিন মুর্তাজার বিদায়
২০২০ সালের ৫ মার্চ সিলেটে দুপুরের পর সংবাদ সম্মেলনে এসেই মাশরাফি বিন মুর্তাজা নাটকীয়ভাবে বললেন, ‘আমার একটা ঘোষণা আছে...।’ উপস্থিত সাংবাদিকদের কান সজাগ হয়ে উঠল। তাহলে কি সত্যি সত্যি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কালকের (৬ মার্চ ২০২০) ওয়ানডেটিই অধিনায়ক মাশরাফির শেষ ম্যাচ? নাকি দেবেন আরও বড় কোনো চমক?
হ্যাঁ ঠিক তাই, কাগজে লিখে আনা সেই ঘোষণায় মাশরাফি বললেন— ‘কালকে আমার শেষ ম্যাচ, অধিনায়ক হিসেবে। আমার প্রতি এত দীর্ঘ সময় আস্থা রাখার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই আমার সঙ্গে যত ক্রিকেটার খেলেছে, সবাইকে। আমি নিশ্চিত প্রক্রিয়াটা এত সহজ ছিল না, শেষ পাঁচ-ছয় বছরের যে-ই সফর ছিল। আমি ধন্যবাদ জানাই, টিম ম্যানেজমেন্টে যারা ছিল, যাদের অধীনে আমি অধিনায়কত্ব করেছি। তারা সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন।
হাথুরুসিংহে দিয়ে শুরু হয়েছিল। তার আগেও পেয়েছিলাম অধিনায়কত্ব। কিন্তু চোটের কারণে করতে পারিনি। মূলত (অধিনায়কত্ব) শুরু হয় হাথুরুসিংহে দিয়ে। খালেদ মাহমুদ, স্টিভ রোডস ও ডমিঙ্গো দিয়ে শেষ হচ্ছে। নির্বাচক-কর্মকর্তা যারা আছেন, প্রত্যেক বোর্ড কর্মকর্তা থেকে শুরু করে যারাই ক্রিকেট বোর্ডে আছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানাই সহযোগিতার জন্য।
আমি ধন্যবাদ জানাই আপনারা যারা আছেন মিডিয়ায়। অত্যন্ত সহযোগিতা করেছেন। সবশেষে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমর্থক যারা আছেন, আপনারাই ক্রিকেটের প্রাণ। আপনাদের সমর্থন ছাড়া এত দূর আসা সম্ভব ছিল না। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
এটাই ছিল মাশরাফি বিন মুর্তাজার অধিনায়কত্ব ছাড়া শেষ ম্যাচ। কিন্তু ২০২০ সালের ৬ মার্চ সিলেটে অনুষ্ঠিত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচটিই যে মাশরাফির জীবনে শুধু অধিনায়কত্ব ছাড়া নয়, ওয়ানডে ক্যারিয়ারেও শেষ ম্যাচ হয়ে থাকল, তা ভাবতে বেশ কষ্ট লাগে।
সেদিনের মাশরাফির অধিনায়কত্ব ছাড়ার বিদায়ী বক্তব্যে প্রাণ ছুঁয়ে গেছে মুশফিক-তামিম-মাহমুদউল্লাহদের। কিন্তু এটা কি কোনো বিদায়ের সংজ্ঞা বলা যাবে। আমরা কেন দেশের ১৬ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো একজন জীবন্ত কিংবদন্তির বেলাশেষে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখব। কেন তারা লজ্জা আর নিভৃতে মুখ লুকিয়ে নীরবে প্রস্থান করতে বেশি পছন্দ করছেন? কেন তারা দিনশেষে আহত ডানাভাঙা পাখির মতো নিড়ে ফিরে যাচ্ছেন? এই কেনোর কোনো উত্তর আমাদের মতো নগন্য ক্রিকেটপ্রেমীদের মন বুঝতে পারে, কিন্তু কোনো বোর্ডের কর্মকর্তা-পরিচালকের হৃদয়ে দোলা দেয় না। তারা বুঝতে পারেন না। যেমন বুঝতে পারেননি সাবেক বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন।
মাঠ থেকে বিদায় না বলার এই সংস্কৃতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ সুজন বলেছেন, আমি যখন অবসর নিয়েছি, তখন বলেছি— এটা আমার শেষ ম্যাচ। যখন কেউ এটা বলে, তখন একটা আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনার ব্যবস্থা করতে পারে বোর্ড। বোর্ড কি কাউকে পুশ করতে পারে— আপনি অবসর নেন? ওরা যদি বলত যে পরের সিরিজে অবসর নেব। তাহলে বিসিবি প্রস্তুতি নিতে পারে। ওরা যদি না বলে, বিসিবি বুঝবে কীভাবে। বিসিবিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।’
আমরা নিজেকে স্বতন্ত্র রেখে বোর্ডের জয়গান গাওয়া সাবেক পরিচালক সেই দোষ চাপালেন খেলোয়াড়দের ওপর। তারা যদি না বলে কীভাবে বিসিবি বুঝবে? মাঠে গিয়ে অবসর না নেওয়ার সংস্কৃতির দায় খেলোয়াড়দের ওপর না চাপিয়ে নিজেকে একবার প্রশ্ন করা উচিত— কেন আমরা খেলোয়াড়দের মনোভাব বুঝতে পারছি না, আমাদের সমস্যা কোথায়?
তামিম ইকবাল সম্প্রতি জাতীয় দলে আর না খেলার কথা বলেছেন। কোনো ধরনের ঘোষণা না দিলেও মাশরাফি বিন মুর্তজার ক্যারিয়ার এখানেই শেষ বলে ধরে নেওয়া যায়। আর মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকেরও একপ্রকার ক্যারিয়ার শেষ। এরপর ফেসবুক পোস্টে মুশফিক ওয়ানডে থেকে আর মাহমুদউল্লাহ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন। আর সাকিব আল হাসানও আর কখনো বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই।
আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বললেন তামিম ইকবাল
তামিম ইকবাল জাতীয় দলের বাইরে দীর্ঘ সময়। কখনো শোনা গেছে তিনি ফিরতে পারেন, আবার কখনো শোনা গেছে ফিরবেন না। তবে সব কিছুই ছিল গুঞ্জন আর আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অবশেষে তামিম নিজেই জানালেন— আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফিরছেন না তিনি।
১০ জানুয়ারি ২০২৫ শুক্রবার সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে আবেগঘন একটি স্ট্যাটাস দিয়ে অবসরের ঘোষণা দেন এ জাতীয় দলের ওপেনার। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো—
‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে আছি অনেক দিন ধরেই। সেই দূরত্ব আর ঘুচবে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার অধ্যায় শেষ। অনেক দিন ধরেই এটা নিয়ে ভাবছিলাম। এখন যেহেতু সামনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বড় একটি আসর, আমি চাই না আমাকে ঘিরে আবার অলোচনা হোক এবং দলের মনোযোগ ব্যাহত হোক।
এটা অবশ্য আগেও চাইনি। চাইনি বলেই অনেক আগে নিজেকে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়েছি। যদিও অনেকেই বলেছেন, অনেক সময় মিডিয়ায় এসেছে, আমিই নাকি ব্যাপারটি ঝুলিয়ে রেখেছি। অবসর নেওয়া বা খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একজন ক্রিকেটার বা যে কোনো পেশাদার ক্রীড়াবিদের নিজের অধিকার। আমি নিজেকে সময় দিয়েছি। এখন মনে হয়েছে, সময়টা এসে গেছে।
অধিনায়ক শান্ত আন্তরিকভাবেই আমাকে ফেরার জন্য বলেছে। নির্বাচক কমিটির সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। আমাকে এখনো উপযুক্ত মনে করার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে আমি নিজের মনের কথা শুনেছি। ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে যা হয়েছে, আমার জন্য তা বড় ধাক্কা ছিল, যেহেতু ক্রিকেটীয় কারণে আমি দলের বাইরে যাইনি। তারপরও আমি যেখানেই গেছি, ক্রিকেট ভক্তদের অনেকেই বলেছেন— আমাকে আবার জাতীয় দলে দেখতে চান। তাদের ভালোবাসার কথা ভেবেছি আমি। আমার ঘরেও একজন অনুরাগী আছে। আমার ছেলে কখনো আমাকে সরাসরি বলেনি, কিন্তু তার মাকে বারবার বলেছে, বাবাকে আবার দেশের জার্সিতে খেলতে দেখতে চায়। ভক্তদের হতাশ করার জন্য আমি দুঃখিত। ছেলেকে বলছি— ‘তুমি যেদিন বড় হবে, সেদিন বাবাকে বুঝতে পারবে।’
মাঠ থেকে অবসরের সুযোগ হয়নি তামিম ইকবালের। এর পর তামিমকে বিদায়ী সংবর্ধনা দিয়েছে বিসিবি, যা হাস্যকর বটে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সফল এই ব্যাটারকে বিপিএলের ফাইনাল মঞ্চে বিদায়ি ক্রেস্ট ও উপহার দিয়েছে বিসিবি। অথচ বিসিবি বুঝতে পারেনি তামিম ইকবাল ছেলেকে যে কথা বলেছে, সেটা কোন কষ্টের কথা বলেছে, যা বড় হলে বাবাকে বুঝতে পারবে?
মুশফিকুর রহিমের বিদায়ি ভাষণ
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যাওয়া-আসার মাঝে সমালোচনার মুখে বুধবার (৫ মার্চ ২০২৫) সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া অবসর ঘোষণায় মুশফিকুর রহিম বলেছেন, ‘আমি আজ ওয়ানডে ফরম্যাট থেকে অবসর ঘোষণা করছি। সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের অর্জন সীমিত হতে পারে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, যখনই আমি আমার দেশের জন্য মাঠে নেমেছি, নিষ্ঠা ও সততার সাথে ১০০ ভাগের বেশি দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহ আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে, এটাই আমার নিয়তি।’ অবসরের সিদ্ধান্তের ঘোষণায় পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতও উদ্ধৃত করে মুশফিক বলেছেন— ‘ওয়া তুইজ্জু মান তাশা' ওয়া তুযিলু মান তাশা'– এবং তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন।’
এই ছিল মুশফিকুর রহিমের বক্তব্য। মুশফিক ভাগ্যকে দোষারোপ করে ছেড়ে দিলেন। কখনো বিসিবির ওপর দায় চাপিয়ে দেয়নি। যদিও এটা কখনই মুশফিকুর রহিমের প্রাপ্য ছিল না। এটা নিশ্চয়ই আমাদের ক্রিকেটের জন্য, বিসিবির ভবিষ্যতের জন্য ভালো কোনো উদাহরণ হতে পারে না। টেস্টে অবসর ঘোষণা না দিলেও তা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে সে ক্ষেত্রে বিসিবি একটা বিদায় দেওয়ার সুযোগ পেতে পারে বলে আমি আশা করছি।
মাঠে একসঙ্গে সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক ও রিয়াদ
মাহমুদউল্লাহর বিদায়
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খারাপ পারফরম্যান্স করে আসার পর সমালোচনা যেন নৃত্যসঙ্গী হয়েছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের জীবনে। সে ভার যেন বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই সামাজিক মাধ্যমে বুধবার (১২ মার্চ ২০২৫) একটি ফেসবুক পোস্টে স্ট্যাটাস দিয়ে রিয়াদ লিখেছেন— সমস্ত প্রশংসা একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর জন্য। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আমার সকল সতীর্থ, কোচ এবং বিশেষ করে আমার ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা সবসময় আমাকে সমর্থন করেছেন।
বিশেষ ধন্যবাদ আমার বাবা-মা, শ্বশুরবাড়ির সবাইকে, বিশেষ করে আমার শ্বশুরকে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে আমার ভাই এমদাদ উল্লাহকে, যিনি শৈশব থেকেই আমার সাথে ছিলেন আমার কোচ ও মেন্টর হিসেবে।সবশেষ আমার স্ত্রী ও সন্তানদের অসীম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাই, সুখে-দুঃখে আমার শক্তি হয়ে যারা সবসময় আমার পাশে থেকেছেন। আমি জানি, রায়েদ আমাকে লাল-সবুজের জার্সিতে মিস করবে।
অনেকটা আক্ষেপের সুরেই মাহমুদউল্লাহ লিখেছেন—সবকিছু সবসময় নিখুঁতভাবে শেষ হয় না, কিন্তু জীবন এগিয়ে নিতে হয়। শান্তি… আলহামদুলিল্লাহ। আমার দল ও বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য রইল শুভকামনা।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের এই আক্ষেপের সুর হয়তো সাবেক বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন বুঝতে পারেননি। তাদের ক্ষোভ কোথায়। আমরা পাঠক হিসেবে তা অনুমেয়।
এদিকে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ এক বিবৃতিতে মাহমুদউল্লাহর বিদায়কে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ‘বিষাদের মুহূর্ত’ উল্লেখ করে বলেছেন, দীর্ঘ দুই দশক সে ছিল জাতীয় দলের অন্যতম ভরসার প্রতীক। চাপের মুখে দুর্দান্ত পারফর্ম করার ক্ষমতা তাকে অমূল্য সম্পদে পরিণত করেছিল। তার খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা ও নেতৃত্বগুণ আগামী প্রজন্মের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে।
দলের জন্য নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক হয়ে ওঠা মাহমুদউল্লাহকে ‘আড়ালের নায়ক’ বলা হতো প্রায়ই। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ব্যাট হাতে দলকে রক্ষা করার অসংখ্য গল্প আছে তার নামের পাশে। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও মাঠে ঠান্ডা মাথায় খেলে যাওয়া এবং দলকে ভরসা দেওয়ার ক্ষমতা তাকে বাংলাদেশের অন্যতম সম্মানিত ক্রিকেটারে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি তার অসামান্য অবদান আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। তার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আগামী প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে।
শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার গল্পগুলো বারবার এভাবেই চলে আসে। ঠিক তেমনি ঘুরেফিরে বিসিবির দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের এই বিদায় আজ লাখ লাখ ক্রিকেটপ্রেমীকে কাঁদিয়েছে। আমরা তাকে এভাবে কখনো বিদায় বলতে চাইনি। কিন্তু এই চ্যাম্পিয়ন ট্রফির মাঝে যেভাবে ঝড় বয়ে গেছে, তাতে আমি একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসাবে লজ্জিত।
আমরা জানি, তামিম ইকবাল আর জাতীয় দলে খেলবে না। কোনো ধরনের ঘোষণা না দিলেও মাশরাফি বিন মুর্তাজার ক্যারিয়ার এখানেই শেষ। মুশফিক টেস্টে চালিয়ে গেলেও মাহমুদউল্লাহর বিদায়। বাকি থাকল সাকিব আল হাসান। সাকিব আর কখনো বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন কিনা—এ নিশ্চয়তা সাকিব যেমন নিজে দিতে পারবে না, তেমনি বিসিবিও বলতে পারবে না। যদিও সাকিবের খেলা না খেলার দায় বিসিবির ওপরই বর্তায়।
সাকিব আল হাসানের বিদায়
ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে (কানপুরে ২৭ সেপ্টেম্বর-০১ অক্টোবর ২০২৪) মাঠে নামার আগে টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। টেস্ট ক্রিকেট থেকে তিনি বিদায় নিতে চান ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। তবে দেশে ফেরা এবং নিরাপদে দেশের বাইরে যাওয়ার নিশ্চয়তা পেলেই এমনটা করবেন বলে জানিয়েছিলেন তারকা এ ক্রিকেটার। কিন্তু সাকিবের এ ঘোষণার পর থেকেই তার নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে ক্রিকেটাঙ্গনে আলোচনা শুরু হয়। মূলত বিসিবিকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করেন সাকিব। তবে বিসিবিপ্রধান বল ঠেলে দেন সরকারের কোর্টে—কোনো ক্রিকেটারকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা বিসিবির নেই। এটার করতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে এলো সেই গ্রিন সিগন্যাল। সবকিছু ঠিক থাকলে অক্টোবরের ২১ তারিখ শুরু হতে যাওয়া মিরপুর টেস্ট দিয়ে অবসর নেবেন সাকিব। কিন্তু সেই প্ল্যানও ভেস্তে যায়।
এমন বিদায় সাকিব নিজে চেয়েছিলেন তো?
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি?—কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই চরণটির বাস্তব উদাহরণ হয়ে রইলেন সাকিব আল হাসান। নয়তো দীর্ঘ ক্যারিয়ারজুড়ে পারফরম্যান্সে উজ্জ্বল সাকিব কেন এভাবে বিদায় বলবেন? তার তো মাথা উঁচু করে বীরের বেশে বিদায় নেওয়ার কথা।
দেশকে বিশ্বমঞ্চে সম্মানিত করা সাকিব কখন যে দেশের হয়ে তার ক্যারিয়ারের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি খেলে ফেলেছেন তিনি নিজেই জানেন না। জানেন না তার ভক্তরাও। অথচ সবশেষ বিশ্বকাপেও দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলার রেকর্ড গড়েছেন একসময়ের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেটও তার। রেকর্ড ৫০টি।
অলরাউন্ডার হিসেবে দীর্ঘ সময় শীর্ষস্থানে ছিলেন সাকিব। সেই তিনি তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলবেন, অথচ মাঠে গার্ড অব অনার পাবেন না! তাকে ঘিরে সংবর্ধনা জানাবে না ক্রিকেটাররা। মাঠে জড়ো হবে না হাজারো ক্রিকেট ভক্ত— এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। যদিও দিনশেষে সবই হয়েছে। আর এর পেছনে দায়টা কি শুধু সাকিবের একার?
যদি দায়টা শুধু সাকিবের একারই হয়, তাহলে প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ লিপু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল ঘোষণার দিন সাকিব আল হাসানকে কেন দলে নেওয়া হলো না তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন— ব্যাটিংয়ের দিক থেকে হিসাব করলে সাকিবের চেয়ে বেটার ব্যাটসম্যান এ মুহূর্তে বাংলাদেশ দলে আছে। কে ছিল সেই ব্যাটার, যার কারণে সাকিবকে বিবেচনা করা হয়নি?
প্রশ্ন থেকেই যায়—
আরেক নির্বাচক আবদুর রাজ্জাকইবা কেন এভাবে বলবেন— সাকিবের থেকে ভালো বলার আছে, ব্যাটার আছে, ক্যাপ্টেন আছে; কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে একজন মানুষের মধ্যে আরেকজন সাকিব— আমি দেখি না।
তাহলে কেন চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে বিবেচনা করা হলো না সাকিবকে—?
নির্বাচক হান্নান সরকারইবা কেন এভাবে বলবেন— সাকিবের বিদায়টা মিরপুর থেকে হলে ভালো হতো। সেটার জন্য আমি আক্ষেপ করেছি। এখানে তাকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে রাখা না রাখার বিষয় নিয়ে আমি কিছু বলিনি। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুরে খেলে সাকিবের অবসরে যাওয়ার যে বিষয়টি ছিল, সেই দলটি আমি ঘোষণা করেছিলাম। সাকিবের বিষয়টি আমিই মিডিয়ার কাছে জানিয়েছিলাম। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই আমার একটা প্রত্যাশা ছিল— মিরপুর থেকে সে বিদায় নেবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা যখন পূরণ হয়নি, তখন আমি সেটি নিয়ে আমার আক্ষেপ জানিয়েছে। গত এক বছর আমি সিলেক্টর হিসেবে থাকাবস্থায় সেটি একটি অপূর্ণতা বলা যেতে পারে।
তা হলে হান্নান সরকারের এ আক্ষেপ কার ওপরে ছিল—সাকিবের ওপর না বোর্ডের ওপর?
তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা নয়; বিবেক দিয়ে কাজ করা উচিত, বাঁকা চোখে নয়। আমি আশা করি— বিসিবি চাইলে পঞ্চপাণ্ডবকে নিয়ে একটি বৃহত্তর বিদায়ি সংবর্ধনার আয়োজন করতে পারে, যা বৈষম্যবিরোধী ৩৬ জুলাই ২৪ আন্দোলনে ইতিহাস সৃষ্টি করবে বলে আমি মনে করি।