
একটা সময় পাকিস্তান হকির জগতে ছিল এক পরাশক্তির নাম। কালের খেয়ায় সে দাপটটা এখন আর নেই দেশটির হকির। একই দৃশ্য হকির পর দেখাচ্ছে ক্রিকেটও। টানা তিন আইসিসি ইভেন্টে প্রথম পর্বের বৈতরণী পার করতে পারলেন না বাবর আজমরা। বিষয়টা নিয়ে দলটার সাবেকরা হতাশাই প্রকাশ করেছেন বেশ।
পাকিস্তানের হকি ও ক্রিকেট একসময় বিশ্বমঞ্চে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসে দিল্লির মাঠে পাকিস্তান ৭-১ গোলে ভারতকে হারিয়েছিল, যা ভারতের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক পরাজয় ছিল। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান হকি বিশ্বে শাসন করেছে। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে তারা আর ভারতকে হারাতে পারেনি। একই চিত্র পাকিস্তানের ক্রিকেটেও দেখা যাচ্ছে। একসময় তারা ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছিল, কিন্তু এখন ধারাবাহিক ব্যর্থতায় নিমজ্জিত। এই দুই খেলারই পতন ঘটছে, তবে এর কারণ কী?
’৪৭ এর দেশ ভাগের পর থেকে চার দশক পাকিস্তান হকিতে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এ সময় তারা তিনটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকসহ মোট আটটি পদক, চারটি হকি বিশ্বকাপ, আটটি এশিয়ান গেমস জিতেছে। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকে তাদের পারফরম্যান্স ক্রমশ নিম্নমুখী হতে থাকে। পাকিস্তানের হকির পতনের বড় কারণ ১৯৮৬ সালে বিশ্ব হকি ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত, যেখানে খেলাটি ঘাসের মাঠের পরিবর্তে অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলার নিয়ম চালু করা হয়। নতুন পরিবেশে পাকিস্তান আর খাপ খাওয়াতে পারেনি।
১৯৯০-এর পর যখন পাকিস্তানের হকির পতন শুরু হয়, তখনই দেশটিতে ক্রিকেট জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয়ের পর ক্রিকেটের প্রতি মানুষের উন্মাদনা বেড়ে যায়। স্পনসর ও মিডিয়ার আগ্রহ হকির থেকে সরে গিয়ে ক্রিকেটে চলে যায়। অর্থ আসতে শুরু করে, তরুণ খেলোয়াড়েরা হকি ছেড়ে ব্যাট-বল হাতে তুলে নেয়। কিন্তু এখন পাকিস্তান ক্রিকেটও একই সমস্যার সম্মুখীন।
২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পর থেকে পাকিস্তান আর কোনো বড় টুর্নামেন্ট জিততে পারেনি। ২০২৩ সালের বিশ্বকাপে তারা গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান পাঁচবার মুখোমুখি হয়েছে, প্রতিবারই ভারত জিতেছে। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্বলতা। একসময় পাকিস্তানে জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি চালু হয়েছিল, কিন্তু এখন সেটি কার্যকর নয়।
সাবেক অলরাউন্ডার মুদসসর নজর মনে করেন, পাকিস্তানের ক্রিকেট এখন হকির পথেই হাঁটছে। তিনি বলেন, ‘সত্তর-আশির দশকে পাকিস্তানে হকি খুব জনপ্রিয় ছিল। দল যখন হারতে শুরু করল, তখন সাবেক খেলোয়াড়েরাই সমালোচনা শুরু করলেন এবং নিজেদের স্বার্থ দেখলেন। এখন ক্রিকেটেও সেটাই হচ্ছে।’
ভারতীয় ক্রিকেট এখন বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষে, যার বড় কারণ বোর্ডের আর্থিক শক্তি ও আইপিএল। এই লিগ থেকে বিপুল অর্থ আসে, যা ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নয়নে ব্যয় হয়। পাকিস্তানে সেই বিনিয়োগ নেই। জাভেদ মিয়াঁদাদ বলেন, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটের মান উন্নত করতে হবে। যতদিন না তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাকিস্তান ভালো করবে না।’
এছাড়া পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের অব্যবস্থাপনাও বড় সমস্যা। গত চার বছরে বোর্ডের চেয়ারম্যান চারবার বদল হয়েছে। কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে অধিনায়ক, সবাইকে বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে, যার ফলে ধারাবাহিকতা নেই। দল ব্যর্থ হলেই কোচ কিংবা অধিনায়ককে দোষ দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সংস্কৃতি পাকিস্তানের ক্রিকেটকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে।
একসময় পাকিস্তান হকিতে বিশ্বসেরা ছিল, কিন্তু ক্রিকেটের উত্থানের ফলে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। এখন ক্রিকেটও সেই একই পথে হাঁটছে। খেলাধুলার প্রতি আবেগ ও বিনিয়োগের অভাব, প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনীতির প্রভাব পাকিস্তানের দুই ঐতিহ্যবাহী খেলাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একসময় বিশ্বকাপজয়ী দেশটি কি শুধুই অতীতের স্মৃতি হয়ে থাকবে, নাকি তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? উত্তর সময়ই দেবে।