জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের বন্ধ দুয়ার খুলবে কবে?
ক্রীড়া প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫১ এএম
জট লেগেছে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে। চার বছর ধরে বন্ধ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান। ২০২১-২৩ তিন বছরের জন্য ৩০ জনের নাম ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সেই তালিকা ফাইলবন্দি হয়ে রয়েছে। কবে নাগাদ পুরস্কার ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের হাতে তুলে দেওয়া হবে, তা জানেন না সংশ্লিষ্টরা। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার বাছাই কমিটি নতুন করে করতে হবে। কেননা, আগের কমিটির অধিকাংশ সদস্যই আর স্বপদে বহাল নেই। এখন নতুন কমিটি গঠনের পর কাজ শুরু হবে।
২০২১ ও ২০২২ সালে ১০ জন করে ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়াব্যক্তিত্বকে ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য নাম চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ২০২১ সালের জন্য মনোনীতরা হলেন-প্রয়াত ফুটবলার একেএম নওশেরুজ্জামান, ভলিবল ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী বাবু, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বর্তমান সভাপতি ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ, সাবেক টেবিল টেনিস তারকা আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ কিসলু, ভলিবল তারকা ইয়াদ আলী, ব্যাডমিন্টন তারকা রাসেল কবির সুমন, অ্যাথলেটিক্স কুইন নাজমুন নাহার বিউটি, তারকা সাঁতারু জুয়েল আহম্মেদ, জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ ও বর্তমানে ঢাকা আবাহনীর কোচ একেএম মারুফুল হক এবং জাতীয় নারী কাবাডি দলের সাবেক অধিনায়ক ও সহকারী কোচ শাহনাজ পারভীন মালেকা।
২০২২ সালের জন্য মনোনীতরা ছিলেন-সাবেক অ্যাথলেট ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ এবং বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সভানেত্রী মাহবুব আরা বেগম গিনি এমপি, পৃষ্ঠপোষক ও ক্রিকেট সংগঠক মির্জা সালমান ইস্পাহানী, জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ আলফাজ আহমেদ, সাবেক অ্যাথলেট মেরিনা খানম মেরি, জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার জিএস হাসান তামিম, সাবেক হকি তারকা রফিকুল ইসলাম কামাল, ২০১৬ গুয়াহাটি এসএ গেমসে জোড়া স্বর্ণজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা, সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন শাটলার এনায়েত উল্লাহ খান এবং সাবেক জাতীয় আরচার ইমদাদুল হক মিলন।
২০২৩ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য বাছাই করা ১০ জন হলেন-এসএ গেমস ও কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণজয়ী শুটার শারমিন আক্তার রত্না, অলিম্পিয়ান সাঁতারু ডলি আক্তার, জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার রুমি রিজভী করিম এবং মাহফুজুল মামুন বাবু, তারকা ভারোত্তোলক ফাহিমা আক্তার ময়না, ক্রিকেটার মাইনুল হক, এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী তায়কোয়ান্দোকা মিজানুর রহমান, পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার, স্পেশাল অলিম্পিক অ্যাথলেট বিবি ফাতেমা, ফ্লোর হকি ও বৌচি খেলোয়াড় এসএম ফেরদৌস ইকরাম। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৭৬ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের প্রবর্তন করেন। ওই বছর আটজনকে দেওয়া হয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ছয় বছর নিয়মিত দেওয়ার পর ১৯৮২ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই পুরস্কার। ১৯৯৬ সালে আবার শুরু হয় পুরস্কার প্রদান। ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩১৪ জন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক পান এই পুরস্কার। তবে ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জেনারেল (অব.) মঈন ইউ আহমেদকে পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তার অনুপস্থিতির কারণে ওই পুরস্কারটি দেওয়া হয়নি। পুরস্কার পাওয়াদের একটি করে স্বর্ণপদক, সনদপত্র, নগদ এক লাখ টাকা ও একটি ব্লেজার দেওয়া হয়।
অতীতে কীর্তিমানদের সঙ্গে ক্রীড়া পুরস্কার বাগিয়ে নিতেন অখ্যাতরাও। মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ক্রীড়া পুরস্কারের তালিকায় নিজেদের নাম যুক্ত করেছিলেন কয়েকজন। তাই অনেকে ক্রীড়া পুরস্কারকে ‘তদবির পুরস্কার’ নামে আখ্যায়িত করতেন। অনেক প্রথিতযশা ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক উপেক্ষিত হয়েছেন। একসময়ের মাঠ কাঁপানো ফরোয়ার্ড মামুন জোয়ার্দার ১৯৯৭ পর্যন্ত টানা আট বছর জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবল মাঠের এ শিল্পীকে মূল্যায়ন করা হয়নি। ৭০, ৮০ ও ৯০ দশকে সংগঠক হিসাবে মনিরুল হক চৌধুরী ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বাফুফের সদস্য ও সহসভাপতি ছিলেন। পাইওনিয়ার ফুটবল লিগের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বছরের পর বছর সেবা দিয়ে যাওয়া মনিরুল হক চৌধুরীও পাননি ক্রীড়া পুরস্কার।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাংগঠনিক সাফল্যের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে রয়েছে সাবের হোসেন চৌধুরীর নাম। এদেশের ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তুলতে তিনি অবদান রেখেছেন। তিনিও পাননি স্বীকৃতি। প্রয়াত ক্রিকেটার শেখ দৌলতুউজ্জামান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত-এটা দেখে যেতে পারেননি। একই দশা আসাফউদ্দৌলারও। ছিলেন সেরা সাঁতারু। হয়েছিলেন সেরা সংগঠক। কিন্তু সেরা সংগঠকের পুরস্কার আজও পাননি।
জলকন্যা মনিরা বেগম ডালিয়া জাতীয় প্রতিযোগিতায় ২৬টি রেকর্ড গড়েছেন। ১৯৯১ সালে কলম্বো সাফ গেমসে দুটি ব্রোঞ্জ জেতেন। দেশসেরা এই সাঁতারুর ভাগ্যেও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার জোটেনি।
ক্রীড়া পুরস্কার পাননি একসময়ের কৃতী ফুটবলার ও তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় বজলুর রহমান। যিনি জীবনের শেষ ৫০ বছর কাটিয়েছেন ফুটবলার গড়ার কারিগর হিসাবে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তুখোড় ফুটবলার আনজাম হোসেন কিংবা ফুটবলার বড় নাজিরের ভাগ্যেও জোটেনি পুরস্কার। জীবদ্দশায় ক্রীড়া পুরস্কার দেখে যেতে পারেননি জাতীয় ফুটবল দলের প্রয়াত কোচ ওয়াজেদ গাজীও।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বাস্কেটবলের কাজী কামাল, বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক মণি, যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদুল হক মানু, মোহামেডান ও বিসিবির ডাকসাইটে সংগঠক তানভীর হায়দার, বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শেখ আকমল হোসেন, প্রথিতযশা ক্রীড়া সংগঠক সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুর নাম বিবেচনায় আনেনি ক্রীড়া পুরস্কার কমিটি। প্রয়াত এসব সংগঠককে মূল্যায়ন করা হয়নি।
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার নিয়ে যখন তদবির-লবিং চলে, তখন নিভৃতচারী ক্রীড়া সংগঠকরা আড়ালেই থেকে যান। বাংলাদেশের খ্যাতিমান ও আলোকিত ক্রীড়াব্যক্তিরা নিজেদের জীবনবৃত্তান্ত কখনোই জমা দেন না ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার আশায়। যারা পুরস্কার দেন তারাও বিবেচনায় আনেন না উজ্জ্বল নক্ষত্রদের। তাদেরই একজন চট্টগ্রামের মরহুম ইউসুফ গনি চৌধুরী। ক্রীড়া পুরস্কারের তালিকায় ওঠেনি তার নাম। ক্রীড়াঙ্গনে সফল সংগঠক হিসাবে পরিচিত মুখ মনজুর হোসেন মালু। প্রথিতযশা এই সংগঠকের নাম ক্রীড়া পুরস্কার বাছাই কমিটি ধর্তব্যেই আনেনি।
অধ্যাপক মো. আবদুর রহমান ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন, সাইক্লিং ও শুটিংয়ের মতো অনেক খেলাতেই সংগঠক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিনেও জাতীয় পুরস্কার পাওয়া হয়নি খুলনার এই ক্রীড়া সংগঠকের। ফুটবল মাঠে ছিলেন ত্রাস। দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ কামরুজ্জামান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান দলে অপরিহার্য কামরুজ্জামান খেলেছেন ইস্ট পাকিস্তান সফটবল লিগে। ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের যুগ্ম সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ছিলেন সোনালী অতীত ক্লাবের সহসভাপতি। কিন্তু জাতীয় পুরস্কার পাননি তিনি। ফুটবল খেলেছেন কলকাতা মোহামেডানেও।
ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে। কালের বিবর্তনে এই অসাধারণ কীর্তি চাপা পড়ে গেছে নূর আহমেদের। ছিলেন ধারাভাষ্যকার। বর্ণময় জীবনের অধিকারী নুর আহমেদ ক্রীড়া পুরস্কার না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই ইহলোক ত্যাগ করেন। অ্যাথলেটিক্সে দূরপাল্লার দৌড়ে কাজী আলমগীর ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ষাটের দশকজুড়ে ছিল তার আধিপত্য। পেয়েছেন রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্লু। কিন্তু পাননি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার।
২০২২ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য মনোনীত সাবেক তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি খেলা ছেড়েছি ২৫ বছর আগে। অথছ আমারও আগে এই পুরস্কার পেয়েছে জুনিয়ররা। আর আমাকে দেওয়া হচ্ছে পরে। আসলে বাধ্য হয়েই আমাকে দেওয়া হচ্ছে বলে শুনেছি। আমি জেনেছি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন, সাব্বিরকে এখনো তোমরা ক্রীড়া পুরস্কার দাওনি? পরে শেষ পর্যন্ত আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। আসলে বাংলাদেশের এগুলো পরিবর্তন হওয়া দরকার। যোগ্যদের সময়মতোই পুরস্কারটা দিয়ে দেওয়া উচিত।’