দুই ইনিংসে ৮৭২ রান
ক্রিকেটে সেদিন এলোমেলো হয়েছিল অনেক কিছু
স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:২৭ পিএম
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দিনটিকে ইতিহাস বানিয়ে ফেলেছে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ক্রিকেটাররা— ছবি: সংগৃহীত
যারা জিতবে তাদের ঘরেই ট্রফি— সমীকরণ যখন এমন, তখন কে কাকে ছাড় দেবে! অস্ট্রেলিয়া যেমন দক্ষিণ আফ্রিকাকে ছাড় দেয়নি, তেমনি এন্ড্রু সিমন্সদের পাত্তা দেননি হার্শেল গিবসরা। রিকি পন্টিংদের ওপর চড়াও হওয়ার আগে সেদিন হাড়ির হাল ছুঁটেছে গ্রায়েম স্মিথদের। বোলারদের সেই দুর্দাশার দিনটি ইতিহাস হয়ে আছে আজও। ক্রিকেটের সেই সময়কার খেরোখাতায় কাটাকুটিও হয়েছিল বেশ! এতটা বেশি যে, কেউ কেউ ম্যাচটিকে ‘মিরাকল’ ভেবে বসেছিল।
২০০৬ সাল। তখনও কুড়ি কুড়ির ক্রিকেট সংস্করণ এতটা আলোর মুখ দেখেনি। সেই সময় তাণ্ডব চালিয়েছিলেন পন্টিং-স্মিথরা। এদিক-সেদিক উড়িয়ে ঘুরিয়ে মেরেছেন বল। বোলারদের ঘাম ছুঁটিয়ে জমা করেছেন পাহাড়সম রান। বছরের ১২ মার্চ দিনটি এখনও বিখ্যাত—জোহানেসবার্গের নিউ ওয়ান্ডার্স স্টেডিয়াম সেদিন দেখেছিল ওয়ানডে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান। ওইদিনের আগে একদিনের ক্রিকেটে এক ইনিংসে ৪০০ রান ভাবাও যায়নি। অথচ ওইদিনই হয়েছিল দুবার। আরও অনেক কিছু ‘প্রথমের’ সাক্ষী ম্যাচটি।
হর্ষ-বিষাদের ম্যাচটি নিয়ে শুরু থেকেই উত্তেজনা। যারা জয় পাবে, তারাই জিতবে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ। ট্রফি নির্ধারণী অমন ম্যাচের আগে হুংকার ছুড়েছিল অস্ট্রেলিয়া, পাল্টা দুকথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার প্রোটিয়াদের অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। মাঠেও পড়েছিল সেই ঝাঁজ। ব্যাটিংয়ে নামার পর থেকেই প্রোটিয়া বোলারদের ওপর চড়াও হয় পন্টিংয়ের দল। সময় গড়াতে বাড়ে তাণ্ডব। চওড়া হতে হতে ঠোঁটের হাসি মুখ ছাড়িয়ে যায় সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার।
হবেই বা না কেন! অস্ট্রেলিয়া সেদিন প্রথমবার ৪০০ রানের বেশি জমা করে। তাদের আগে ওয়ানডেতে কোনো দলই পায়নি সেই স্বাদ। মাখায়া এনটিনি, গ্রায়েম স্মিথ, জ্যাক ক্যালিসদের তখন কান্না পাবার জোগাড়। ওপেনিংয়ে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট করেন ৫৫ রান, সিমন কাটিস ফেরার আগে খেলেন ৭৯ রানের ঝলমলে ইনিংস। অধিনায়ক পন্টিং ব্যাট চালান দেড়শ স্ট্রাইক রেটে। ফেরার আগে ১০৫ বলে ৯ ছক্কা ১৩ চারে জমা করেন ১৬৪ রান। এরপর মাইক হাসির তাণ্ডব।
৮১ রান করতে সেদিন মাত্র ৫১ বল খরচ করেছিলেন হাসি।
শেষদিকে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস ও ব্রেট লি’র ছোট্ট ঝড়ে ৪৩৪ রান জমা করে অস্ট্রেলিয়া।
হারায় মোটে ৪ উইকেট। এরআগে কখনও ৪০০ রান করতে পারেনি অজিরা। ওয়ানডেতেও তখনও কেউ পায়নি
চারশর দেখা। মাঠ ছাড়ার সময় তাই বুকভরা আত্মবিশ্বাস নিয়েই তখন মাঠ ছাড়েন লি-সাইমন্ডস।
কিন্তু কে জানে তাদের এই আনন্দ বিষাদে
রূপ নেওয়া বাকি।
ওয়ান্ডার্স স্টেডিয়ামের দর্শকরাও ততক্ষণে বিরক্ত। প্রিয় দলকে সমর্থন দিতে আসা প্রোটিয়ানরা ততক্ষণে মাঠ ছাড়তে শুরুও করে দিয়েছেন। স্কোরবোর্ডের সংখ্যা দেখেই তো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। চোখ বুঝে যেকেউ বাজি ধরে বসত অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে। ধারণা বদ্ধমূল হয় দক্ষিণ আফ্রিকা স্কোরবোর্ডে ৩ রান তুলতে উইকেট হারালে। ওপেনার বোয়েটা ডিপপিনার থামেন ১ রানে। এরপরই প্রোটিয়া তাণ্ডব।
অধিনায়ক স্মিথ নড়বড়ে নম্বইয়ে
থামার আগে ৫৫ বলে চালান ঝড়। ব্যাট করেন ১৬৩ স্ট্রাইকরেটে। তিনে নামা হার্শেল গিবস করেন
বসেন আরেক কাণ্ড। ১৫৭ স্ট্রাইকরেটে ২১ চার
ও ৭ ছক্কা হাঁকিয়ে দেন। ব্রেট লি-নাথান ব্রাকেনদের বিপক্ষে দোর্দণ্ডপ্রতাপ খাটানো গিবস
করেন ১৭৫ রান। ভিত গড়ে সেখানেই। পরে আবার নাজেহাল অবস্থা স্বাগতিকদের। ২৯৯ রানে গিবস
ফেরার পর দলের হাল ধরেন মার্ক বাউচার। মাঝে দলকে দ্রুত অনেকটা পথ এগিয়ে দেন জন ভ্যান
ডার ওর্থ।
রোমাঞ্চচড়ানো ম্যাচে শেষ ওভারে জমে
বড় নাটক। জিততে ৬ বলে ৭ রান প্রয়োজন দক্ষিণ আফ্রিকার, হাতে মোটে দুটি উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার
বোলার ব্রেট লি আসেন আক্রমণে। প্রথম বল কোনোরকমে ঠেকিয়ে এক রান নেন বাউচার। পরের বলে
হল খেলেন দুর্দান্ত ব্যাকফুট ড্রাইভ। চার রান। পরের বলে আবারও ড্রাইভ খেলতে গিয়ে ফাঁদে
পড়েন হল। তীরে এসে তরী ডোবার শঙ্কায় তখন দক্ষিণ আফ্রিকা। উইকেট তুলতে পারলে জিতে যাবে
অস্ট্রেলিয়া, রান নিলে ম্যাচ হবে ড্র। এমন সমীকরণে ভুল করেননি এনটিনি। এক রান নিয়ে
ম্যাচে সমতা আনেন। পরের বলে সজোরে হাকিয়ে ফিফটি পূরণ করেন বাউচার, নিশ্চিত করেন জয়ও।
এবার আসি ক্রিকেটের খেরোখাতা এলোমেলো করার গল্পে।
ওয়ানডেতে সেবারই প্রথমবার ৪০০ প্লাস রান করে কোনো দল। এবং হারেও। দুদলের আনা ৮৭২ রান এখনও ওয়ানডে ইতিহাসে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রান।
দ্বিতীয় অব্স্থানে আছে ভারত-শ্রীলঙ্কার ৮২৫ রান। ওই ম্যাচে প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ ৪৩৮ রান আনে কোনো দল। দক্ষিণ আফ্রিকা পাশ কাটায় আগের সর্বোচ্চ শ্রীলঙ্কার ৩৯৮ রান। যদিও সেদিনই লঙ্কানদের পাশ কাটিয়ে ৪৩৪ রান করে অস্ট্রেলিয়াও। ওই ম্যাচে সেরা ক্রিকেটার বাঁছাইয়েও মধূর সমস্যায় পড়তে হয় ম্যাচ পরিচালনাকারীদের।
সবশেষ সিদ্ধান্ত হয় হার্শেল গিবসের পাশাপাশি রিকি পন্টিংও পাবে সেরার
পুরস্কার। ওইদিন পন্টিং ছাড়িয়ে যায় তাদের স্বদেশি সাইমন্ডসের বাউন্ডারি ছাড়া রানের
রেকর্ড। গিবসও চার-ছক্কায় আনা রানে পেছনে ফেলেন স্বদেশি কালাঘানকে।
ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের ম্যাচটি অস্ট্রেলিয়াকে সেদিন শিরোপা ছাড়া করে। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটি ৩-২ ব্যবধানে হারে অস্ট্রেলিয়া।
দিনটি গিবস কিংবা পন্টিং— দুদলের জন্যই ছিল হরিষে বিষাদের মতো।