টাইগারদের প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতায় মাত্র ১০৬ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর প্রোটিয়াদের বড় লিডে চাপা পড়েছিল বাংলাদেশ। ইনিংস হার এড়িয়ে পাল্টা প্রতিরোধে লড়াইয়ে ফেরেন স্বাগতিকরা। বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে ৭ উইকেটে ২৬৭ রান তোলার পর বৃষ্টি শুরু হলে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। মেহেদী হাসান মিরাজ ৭৭, নাঈম হাসান ১২ রানে ব্যাট করছিলেন। বাংলাদেশ এগিয়ে আছে ৬৫ রানে।
ব্যাটারদের ব্যাটিং দৈন্যদশায় বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলাদেশ। এভাবে আর কত? বারবার একই ভুলের কারণ হয়ে উঠছেন কেন ব্যাটাররা? আর কতবার একইভাবে আউট হবেন মুশফিক? সেই আরও একবার কাগিসো রাবাদা। আরও একটা ভেতরে ঢোকা বল। ক্রিকেটের কেতাবি ভাষায় যাকে বলে— ‘ইনসুইং ডেলিভারি।’
মুশফিকুর রহিমের ব্যাট-প্যাডের বিশাল ফাঁকা জায়গায় সেই বল ঢুকে যেতে সমস্যা হয় না। মিরপুরে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই মুশফিক ফিরলেন একইভাবে— ‘ইনসুইং ডেলিভারি।’ অবশ্য শুধু এই টেস্টেই না, ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলো থেকে মুশফিক ভুগছেন এভাবেই।
এর আগে ২০২৩ বিশ্বকাপের ম্যাচে ম্যাট হেনরির বলে মুশফিক সেই দৃষ্টিকটু বোল্ডের কথা স্মরণ করতে পারেন। মুশফিককে ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে নামতে বাধ্য করেছিলেন কিউই এ বোলার। সেই ম্যাচের কথা স্মৃতি থেকে মুছে গেলেও ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথা হয়তো ভুলতে পারবেন না বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রেমীরা।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ সেই ম্যাচ জিতেছিল সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অনন্য দুই সেঞ্চুরির সুবাদে। সেই ম্যাচেও মুশফিকের স্টাম্প অ্যাডাম মিলনে ভেঙেছিলেন এমনই এক ইনসুইং বলে। ক্যারিয়ারের একেবারে প্রথম টেস্টেও মুশফিকুর রহিম ইংলিশ বোলার ম্যাথিউ হ্যাগার্ডের ভেতরে ঢোকা বলেই স্টাম্প খুইয়েছিলেন। ২০০৫ সালের লর্ডস টেস্টের হাইলাইটস দেখতে চাইলে সেই পুরনো মুশফিককে পেয়ে যাবেন আগ্রহী ক্রিকেটপ্রেমীরা।
গত ১৬ বছরে মুশফিক ইনসুইং বলে খেলতে চেয়েছেন একই ঢঙে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে নিজেকে হয়তো পরিবর্তন করার চিন্তাও করেননি কখনই। সামনের পায়ের অবস্থান থেকে শুরু করে ব্যাটের ফেস উন্মুক্ত করা একই ঢঙে বারবার খেলতে চাওয়া। কিন্তু কখনো ভাবা হয় না বিষয়টি। সংবাদ সম্মেলনে সমালোচকদের আয়না দেখতে বলা মুশফিক কি আয়নাতে নিজের ইনসুইং বলের দুর্বলতা দেখতে পান কিনা, সন্দেহ?
২০২৩ বিশ্বকাপের ম্যাচ বিশ্লেষণে দেখা যায় নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড এবং শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচে মুশফিক আউট হয়েছেন ভেতরের দিকে ঢোকা বলে। সেসব ম্যাচের মতো মিরপুর টেস্টেও মুশফিক ইনসুইং ডেলিভারিগুলোতে খেলতে চেয়েছেন কাভার ড্রাইভ। যে কারণে ব্যাড ও প্যাডের মাঝে ছিল বেশ বড় এক ফাঁকা জায়গা।
এর আগে ২০০৪ সালে সিডনিতে অসম্ভব মানসিক জোর দেখিয়ে শচীনের করা ২৪১ রানের ইনিংসটিকে অনেকেই মনে করেন সর্বকালের সেরা টেস্ট ইনিংস। পুরো সিরিজে কাভার ড্রাইভে ভুগতে থাকা শচীন সেদিন ২৪১ করেছিলেন অফসাইডে কোনো বল না খেলেই। সেদিন অজি বোলাররা একের পর এক বল ফোর্থ স্টাম্পের বাইরে খেলেও তার মানসিক জোরে চিড় ধরাতে পারেননি।
কিন্তু ২০২৪-এ এসেও মুশফিকের আউটে বদল আসেনি। মুশফিকের হয়তো পরিকল্পনায় কিংবা মানসিক জোরে কিছুটা পরিবর্তনের দরকার ছিল বিগত বছরগুলোতে। কিন্তু ইনসুইং সেসব ডেলিভারিতে মুশফিকের স্ট্রেট ড্রাইভ কিংবা মিড অফে বল খেলতে চাওয়ার চেষ্টা খুব একটা চোখে পড়েনি কখনই। স্ট্রেট ড্রাইভের ক্ষেত্রে মুশফিকের ব্যাট-প্যাডের ফাঁকা জায়গাটাও কমে আসতে পারত। কমত বোল্ড হওয়ার প্রবণতা।
আপনি যদি স্ট্রেট ড্রাইভের কথা বলেন, তবে ধরে নিন— ক্রিকেটবিশ্বে সবচেয়ে নিখুঁত স্ট্রেট ড্রাইভ শচীন টেন্ডুলকারের। দেখা যাক, তারই একটি শট। যেখানে খুব স্পষ্টভাবে দেখা মিলবে ব্যাট ও প্যাডের মাঝে গ্যাপ ঠিক কতটা কম। মুশফিকের ক্রমাগত বোল্ড হওয়ার প্রবণতা মূলত ব্যাট-প্যাডের গ্যাপের কারণে। আর সেই গ্যাপ কমিয়ে আনার মূল অস্ত্রটা স্ট্রেট ড্রাইভেই সম্ভব।
এর আগে ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে শচীনের স্ট্রেট ড্রাইভ, ব্যাট-প্যাডে পার্থক্য নেই বললেই চলে। সমাধান হতে পারে অন ড্রাইভ শটেও। ইনসুইং বলে মুশফিকের কাভার ড্রাইভ খেলার প্রবণতা বিবেচনায় অনড্রাইভ কিছুটা হলেও সহজ হতে পারে অভিজ্ঞ এ ব্যাটারের জন্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ হাজারের বেশি রান করা ব্যাটারের জন্য সেটি খুব বড় সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
আর এ ভুলের মাসুল বারবার নিজেকে না দিয়ে শোধরানোর দায় কেবলই মুশফিকের। ১৬ বছরে অভিষেকের স্বাদ পাওয়া মুশফিক এখন ৩৭ বছরের অভিজ্ঞ একজন খেলোয়াড়। নামের পাশে অনেক রেকর্ড রয়েছে তার। অনেক ম্যাচ জয়ের সাক্ষী। এককথায় বলতে গেলে— অনেক ম্যাচ জয়ের নায়ক তিনি।
বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ব্যাটার হিসেবে স্পর্শ করেছেন ৬ হাজার রানের মাইলফলক। কদিন আগেই তামিম ইকবালকে পেছনে ফেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক হয়েছেন তিনি।
মুশফিকের অবদান কিংবা কৃতিত্ব বাংলাদেশের ক্রিকেটে খাটো করে দেখতে চাওয়াটা হয়তো অন্যায় হবে। কিন্তু অনুশীলনে তিনিই যে সবচেয়ে বেশি নিবেদিত সেটিও জানেন সবাই। আর ক্রিকেটের ২২ গজে গুডলেন্থের এসব বলে মুশফিক আটকাচ্ছেন বারবারই। টেস্ট ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে ৩৮ বার বোল্ড হয়েছেন মুশফিক। শতাংশের হিসেবে প্রায় ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই হয়েছেন বোল্ড। তার মাঝে ইনসুইং ডেলিভারিতে আউটের সংখ্যাই বেশি। অনেক ক্ষেত্রে স্লিপে ক্যাচটাও দিয়েছেন সেই ভেতরে ঢোকা বলের কারণে।
ক্রিকেটের বড় মঞ্চে নিজের দুর্বলতা বুঝতে পারাটাই হয়তো অনেক ক্ষেত্রে গ্রেটনেসের মাপকাঠি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘গ্রেট’ বনে যাওয়া মুশফিক নিজেও তাত্ত্বিক এসব কথা জানেন নিশ্চয়ই। শুধু প্রায়োগিক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। তার সমসাময়িক সবাই ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন খেলছেন এমন তারকাদের মাঝে মুশফিকের চেয়ে লম্বা ক্যারিয়ার নেই আর কারোরই। মুশফিক ক্যারিয়ারের শেষের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের ভুলটা শোধরাবেন কিনা তাই-ই এখন বড় প্রশ্ন।