চান্ডিকা হাথুরুসিংহে
বাংলাদেশের প্রধান কোচ চান্ডিকা হাথুরুসিংহেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানিয়েছে বিসিবি। আগামী চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত হাথুরুর সঙ্গে বিসিবির চুক্তি থাকলেও, দুটি কারণে তাকে বরখাস্ত করেছে বিসিবি।
দুটি কারণের একটি, ওয়ানডে বিশ্বকাপ চলাকালে নাসুম আহমেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার। অপর কারণ, চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত ছুটি কাটিয়েছেন তিনি। তবে এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে বিসিবির সিদ্ধান্তকে পূর্বপরিকল্পিত বলছেন হাথুরু। বিসিবির নেওয়া সিদ্ধান্তকে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন সত্যের জয় হবেই।
চাকরিচ্যুত হয়ে ফারুকের সমালোচনায় মুখর হাথুরু
অর্থাৎ কোচিং থেকে অব্যাহতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এই লংকান কোচ। অথচ, তিনি ভুলে গেছেন ২০১৭ সালে কীভাবে চুক্তির মাঝপথে বাংলাদেশকে ছেড়ে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ, তখন তাকে খুব করে চাইছিল সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকা বাংলাদেশ। যদিও সে সবে কর্ণপাত না করে তখন তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন শ্রীলংকার ক্রিকেটের। এরপর অবশ্য সেখান থেকেও বিতাড়িত হতে হয়েছে তাকে। সেই তিনি পরবর্তীতে আবার বাংলাদেশের কোচ হয়ে এবার নিজেই বিতাড়িত হলেন।
এবার ঘুরে আসা যাক হাথুরুর প্রথম মেয়াদের সময়টাতে। ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন হাথুরু। এই সময়ে ব্যাপক সফল ছিলেন তিনি। তার অধীনে ২০১৫ সালে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড ও ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ। এরপর ২০১৭ সালে খেলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল। যা এ যাবতকাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা সাফল্য। মোটকথা সাফল্যের মালায় গাঁথা ছিল তার প্রথম অধ্যায়।
ক্রিকেটার সাকিব রাজনীতিক হলেন, মানুষের হতে পারলেন কই
এমন একজন কোচকে রাখার পক্ষে তখন সবাই। নিশ্চিতভাবেই আগামী ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ার কথা ছিল তার। যেখানে বাংলাদেশ আসা করছিল দারুণ কিছুর। তবে সে সব পেছনে ফেলে চুক্তির মাঝপথে হঠাৎ দেশে ফিরে বাংলাদেশকে বিদায় জানিয়ে দেন হাথুরু। অনেকটা আকস্মিকভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান তিনি। দায়িত্ব নেন শ্রীলংকার।
যেই দায়িত্ব নিয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট সেই সময়টায় খুবই বাজে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। বোর্ডের দুর্নীতি, ম্যাচ ফিক্সিংসহ নানা ধরণের গুজব ভেসে ভেড়াচ্ছিল। দল জিম্বাবুয়ের সঙ্গেও হেরেছিল সে সময়। অপরদিকে নিজের দেশকে কোচিং করানো ছিলো আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে। বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কোচিং করাতে চাই কিনা এবং আমার মনে হচ্ছিলো এটাই সব থেকে ভালো সময়। এই দুটি কারণেই আমি শ্রীলঙ্কায় কোচিং করাতে গিয়েছিলাম।’
অর্থাৎ লংকান ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশকে মাঝপথে ফেলে যেতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি হাথুরু। এরপরও সাফল্যের আশায় ভারত বিশ্বকাপের আগে তাকে দলে ভেড়ায় বিসিবি। প্রত্যাশা আগের মতোই বাংলাদেশকে সাফল্য এনে দেবেন হাথুরু। তবে এ দফায় সেটি হয়নি। এসেই বাংলাদেশের অধিনায়ক তামিম ইকবালকে নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য করেন হাথুরু। ক্ষোভে অবসরের ঘোষণা দেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই ওপেনার।
এরপর অধিনায়ক করা হয় সাকিব আল হাসানকে। তামিম আবারও অবসর ভেঙে বিশ্বকাপে খেলার সিদ্ধান্ত নেন। তবে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের বিমানে তার চড়া হয়নি। এখানেও বড় ভূমিকা ছিল হাথুরুর। এছাড়ার বিশ্বকাপ চলাকালীন ড্রেসিং রুমের পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক। যেই দলটি বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল ওয়ানডে সুপার লিগের তিন নম্বরে থেকে। প্রত্যাশা করছিল নিজেদের ইতিহাসে সেরা সাফল্য পাওয়ার। সেই দলটি বিশ্বকাপ মিশন শেষ করেছে কোনোরকমে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলা নিশ্চিত করে।
যেখানে আবার হাথুরুর ওপর অভিযোগ, ব্যাটিং অর্ডার নিয়মিত পরিবর্তন করেছেন তিনি। কোনো ব্যাটারকেই নির্দিষ্ট পজিশনে থিতু হতে দেননি। এর চেয়েও গুরুত্ব অভিযোগ, নাসুম আহমেদের গায়ে হাত তুলেছেন তিনি। ব্যর্থ একটা বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে দেশে ফেরে বাংলাদেশ।
এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে যখন সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যখন ঘরের মাঠে সিরিজ জয়ের স্বাদ পাচ্ছিল বাংলাদেশ। দলকে মনে হচ্ছিল সেটেল। তখন সাকিব আল হাসানকে সরিয়ে নেতৃত্ব দেওয়া হয় নাজমুল হোসেন শান্তকে। এখানেও বড় ভূমিকা কোচ হাথুরুর। এরপর ফের আরেকটি বিশ্বকাপে ব্যর্থ বাংলাদেশ। সেমিফাইনালের সমীকরণ মেলাতে যেখানে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১২ ওভারে ১১৪ রান করতে হতো। সেখানে সেই লক্ষ্যে ব্যাট না করে কোনো রকমে জয় পেতে চেয়েছে বাংলাদেশ। হাথুরুর এমন রক্ষণাত্মক মনোভাব নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল তখন।
সেই হাথুরুকে শেষমেশ বিদায় করেছে বিসিবির নতুন প্রধান ফারুক আহমেদ। কোচ হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপজয়ী কোচ ফিল সিমন্সকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে তার সেই নিয়োগ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন হাথুরু। অভিযোগে তিনি বলেন, ‘নতুন কোচ নিয়োগের স্রেফ চার ঘণ্টা আগে ‘কারণ দর্শানোর’ নোটিশ পেয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি, যদিও নোটিশে বলা হয়েছিল নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের ৪৮ ঘণ্টা সময় আমার আছে। এই ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা আমার বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণে আমাকে দ্রুত বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।’
অর্থাৎ কোচ থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর বিসিবির ওপর একগাদা অভিযোগ এনেছেন হাথুরু। প্রশ্ন তুলেছেন নতুন কোচ নিয়োগ নিয়ে। তবে এসব অভিযোগ আনার আগে হাথুরু কি একবারও মনে করতে পারছেন ২০১৭ সালে কীভাবে বাংলাদেশকে মাঝপথে রেখে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেটা মনে করতে পারলেই হয়তো উত্তরটা পেয়ে যাবেন। সেই উত্তরটা- টিট ফর ট্যাট।