Logo
Logo
×

খেলা

শিরোপার স্বপ্ন দেখা আর না দেখার বয়ান

Icon

দুলাল মাহমুদ 

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ০৬:২০ পিএম

শিরোপার স্বপ্ন দেখা আর না দেখার বয়ান

দুলাল মাহমুদ সম্পাদক ক্রীড়াজগত

একেকটি বিশ্বকাপ মানেই তো মুগ্ধতার হাতছানি। কতভাবেই না তাকে অবলোকন করার সুযোগ হয়। যদিও ফুটবল আর ক্রিকেট বিশ্বকাপের মধ্যে রাতদিন তফাৎ। ফুটবলে যে টগবগে উত্তেজনা আর আনন্দের পসরা নিয়ে আসে, ক্রিকেটে তেমনটা আশা করা যায় না; কিন্তু ক্রিকেটে যে আবেগ আর অনুভূতি হৃদয়কে ভরিয়ে দেয়, তা তো অমূল্য। তাতে আছে প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাকুলতা।

এর একমাত্র কারণ, ফুটবল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা বাংলাদেশের জন্য সুদূরের স্বপ্ন; কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপে নিয়মিতই খেলছে আমাদের মাতৃভূমি। এটা নিশ্চয়ই গর্ব ও আনন্দের। আর সব কিছু বাদ দিলেও বাংলাদেশ খেলতে নামলে বুকের মধ্যে অনুরণিত হয়, 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী' অর্থাৎ মা ও মাতৃভূমি গৌরবের। নিজের দেশকে গৌরবের আসনে কে না দেখতে চায়? প্রতিবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ আসে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে। যদিও বারবারই সইতে হয় স্বপ্ন ভঙের বেদনা। তারপরও আশায় বুক বেঁধে থাকেন ক্রিকেটানুরাগীরা।

শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া প্রতিটি দেশই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নিয়ে অংশ নিয়ে থাকে। শক্তিশালী দলগুলোর টার্গেট থাকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আর অপেক্ষাকৃত  দুর্বল দলগুলো চায় নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে। কারও লক্ষ্য পূরণ হয়, অধিকাংশের হয় না। আশা আর নিরাশার দোলাচল নিয়েই বিশ্বকাপ। আর আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ তো অনেকটা ফাটকা খেলার মতো। এক একটি ম্যাচ যেন নতুন নতুন বাজি।

সে কারণে একটু এদিক-সেদিক হলেই ফাঁদে পা পড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কোনো দলের পক্ষে নিরঙ্কুশ আধিপত্য দেখানো খুবই কঠিন। কারও পক্ষেই দিব্যি দিয়ে বলা সম্ভব নয়, পুরো মাত্রায় তাদের লক্ষ্য অর্জন করার সক্ষমতা ও সামর্থ্য আছে। কোনও দলের একাধিপত্য না থাকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে থাকে। ছয়টি দেশ আটবার চ্যাম্পিয়ন হলেও কোনও দেশই উপর্যুপরি চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। 

এবার নবম আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজিত হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রে। অংশ নিচ্ছে সর্বাধিক ২০টি দেশ। যে কারণে শিরোপার লড়াই আরও খানিকটা বিস্তৃত হয়েছে। যদিও শিরোপার দাবিদার না বাড়লেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। ছোট দলের কাছে বড় দলের পা হড়কানোর সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনিতেই নবাগত দলগুলো পাত্তা পাওয়ার মতো না হলেও অভিবাসী ক্রিকেটারদের ভিড়িয়ে বাড়িয়েছে শক্তিমত্তা। এই পুঁজি নিয়ে হয়তো চমক দেখাতে পারে। 

ওয়ানডে ক্রিকেটের একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথম দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অস্তমিত হয়ে যায় তাদের গৌরবরশ্মি। এরপর শিরোপা জয় তো দূরে থাক, ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সেই সুষমা ও সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। তৃতীয় ফাইনালে ভারতের কাছে হারার পর আর কখনও ফাইনালে উঠতে পারেনি; কিন্তু বিস্ময়করভাবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।

অবশ্য দলে নেই মাঠকাঁপানো ক্রিকেটারদের উপস্থিতি। তারকাবিহীন দলটিতে ব্যাটার হিসেবে নিকোলাস পুরান, ব্রেন্ডন কিং, জনসন চার্লস, আন্দ্রে রাসেল, শিমরন হেটমেয়ার এবং বোলার হিসেবে জেসন হোল্ডার, শেরফান রাদারফোর্ড, আকিল হোসেনরাই হয়ে উঠেছেন ভরসা। এবার দলটি খেলছে নিজের মাটিতে। যদিও আজতক কোনো স্বাগতিক দেশই চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। সেক্ষেত্রে ক্যারিবীয়রা কি পারবে নতুন মাইলফলক গড়তে?

ক্রিকেটের মাতৃভূমি হিসেবে ইংল্যান্ডের পরিচয়। অথচ এই দলটি এই সেদিন একবারই শিরোপা জিতেছে ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে। তদুপরি নিজেদের মাটিতে অনেক জটিল হিসাব-নিকাশের পর তাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। আর এই দলটি কিনা সব সমীকরণ উল্টে দিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শিরোপা জয় করেছে দুইবার। বর্তমান চ্যাম্পিয়নও ইংলিশরা। এবার পরপর দুইবার শিরোপা জয়ের নজির কি তারা স্থাপন করতে পারবে? জস বাটলারের অধিনায়কত্বে জনি বেয়ারস্টো, মঈন আলী, ফিল সল্ট, লিয়াম লিভিংস্টোনরা ব্যাটিংয়ে এবং আদিল রশিদ, ক্রিস জর্ডান, স্যাম কারেন, মার্ক উডরা বোলিংয়ে হাল ধরবেন। এই দলের সামর্থ্য নিয়ে কোনো সংশয় নেই। 

এবারের বিশ্বকাপে টপ ফেবারিট দলের একটি ভারত। যদিও এই দলটি প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলেও এরপর আর হতে পারেনি। দলে আছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, সূর্যকুমার যাদব, যশস্বী জয়সোয়াল, হার্দিক পান্ডিয়ার মতো ব্যাটার। যাদের ব্যাটে প্রবাহিত হয় পাহাড়ি ঝর্ণার মতো রানের স্রোতস্বিণী। বল হাতে আছেন যুজবেন্দ্র চাহাল, যশপ্রীত বুমরা, অর্শদীপ সিং, কুলদীপ যাদবরা। র‌্যাঙ্কিংয়ে সবার উপরে ভারত। বর্তমান দলের রোহিত ছাড়া আর কেউ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপার স্বাদ পায়নি। দলের প্রধান দুই নির্ভরতা রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলির বেলা ফুরিয়ে আসছে। এই দুজন চলে যাওয়ার আগে বিশ্বকাপকে কি রাঙিয়ে দিতে পারবেন?

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অলটাইম ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া। ওয়ানডে বিশ্বকাপে ছয়বারের চ্যাম্পিয়নরা টি-টোয়েন্টিতে একবারই শিরোপার নাগাল পেয়েছে। ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, মিচেল মার্শের মতো মারকুটে ব্যাটার আর বল হাতে অ্যাডাম জাম্পা, মিচেল স্টার্ক, জস হ্যাজেলউডরা থাকলেও এ দলের কে যে কখন জ্বলে উঠবেন, তা কোনো অনুমানের ওপর নির্ভর করে না। দলের বিপদের গন্ধ পেলে যে কেউ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান। অভিজ্ঞ ও পরিণত এই ক্রিকেটারদের শিরোপা জয়ের কলাকৌশল মোটেও অজানা নয়।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে একবারই; কিন্তু আনপ্রেডিক্টেবল দল হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানকে কখনই হিসেবের বাইরে রাখা যায় না। যে দলে বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ান, ফখর জামানের মতো ব্যাটাররা আছেন, তাদের গল্প দ্রুত সমাপ্তি টানার সুযোগ নেই। বল হাতে আছেন শাদাব খান, হ্যারিস রউফ, শাহিন শাহ আফ্রিদিরা। যে কোনো অবস্থায় এ দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ও সক্ষমতা আছে।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আরেক চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা। দলে আগেকার সেই ঔজ্জ্বল্য নেই। সেই প্রতাপও নেই। ব্যাটে কুশল মেন্ডিস, দাসুন শানাকা, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসরা আর বলে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, দুষ্মন্ত চামিরা, মহীশ তিকসানারা কতটা আলো ছড়াতে পারবেন, সে নিয়ে কৌতূহল রয়েছে।

নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা কি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শোপিস? ক্রিকেটের অভিজাত ঘরানার এই দুই দেশ ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কখনও শিরোপা জিততে পারেনি। নিউজিল্যান্ড ফাইনালে উঠলেও আফ্রিকানরা সেটাও পারেনি। কিউইদের গেরো খুলি খুলি করে খুলছে না। তবে আশার কথা, দুই সংস্করণের বিশ্বকাপে সাম্প্রতিককালে তিনবার ফাইনালে উঠেছে নিউজিল্যান্ড। জট অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। এখন চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে তাদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হবে। কেন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে ব্যাটিংয়ে আছেন গ্লেন ফিলিপস, ডেভন কনওয়ে, ড্যারিল মিচেল, মার্ক চাপম্যান, ফিন অ্যালেন আর বোলিংয়ে টিম সাউদি, ইশ সোধি, মিচেল স্যান্টনাররা। এই দল নিয়ে বড় কিছু করার সাধ্য আছে ব্ল্যাক ক্যাপসদের। এবার কী পারবে শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ ঘুচাতে?

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আনলাকি টিম হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো তুলনা হয় না। এই দলটির শক্তি ও সামর্থ্য  নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন ছিল না। বরং বিধ্বংসী দল হিসেবে যে কোনো প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা ছিল; কিন্তু কেন যেন কখনই ব্যাটে-বলে সংযোগ হয়নি। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার হিসেব মেলেনি। সেমিফাইনালের বেশি দলটি উঠতে পারেনি। সম্ভবত ফাইনাল কথাটি শুনলে দলটির হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায়। যে কারণে বিশ্বকাপে ফেবারিট দল হিসেবে প্রোটিয়াদের বিবেচনা করা হয় না। এবারে দলে আছেন পোড়খাওয়া ব্যাটার কুইন্টন ডি কক, রেজা হেনড্রিকস, ডেভিড মিলার, এইডেন মার্করাম আর বোলার তাব্রেইজ শামসি, কেশব মহারাজ, আনরিখ নর্কিয়ারা। দলটি কি পারবে তাদের বদনাম থেকে বের হয়ে আসতে?

শিরোপা লড়াইয়ে ফেভারিট দলগুলোর বাইরে আফগানিস্তান দলটিকে হালকা চালে দেখার সুযোগ নেই। দলটিকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলা যায়। বড় কোনো অঘটন ঘটানোর সক্ষমতা ও সাহস রাখে। দলে আছেন মোহাম্মদ নবী, নাজিবউল্লাহ জাদরান, রহমানউল্লাহ গুরবাজ, ইব্রাহিম জাদরানের মতো ব্যাটসম্যান আর রশিদ খান, মুজিব-উর-রহমান, ফজলহক ফারুকীর মতো বোলাররা। অন্তত তাদের তাগদ নিয়ে দ্বিধা নেই। 

এখন কথা হলো, এবার চ্যাম্পিয়ন হবে কে? ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে ঘুরেফিরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ছয়টি দল। এর বাইরে নতুন কোনো দল চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না, এমনটা বলার সুযোগ নেই। মুশকিল হলো, চ্যাম্পিয়নদের যে ঘরানা গড়ে উঠেছে, এর বাইরে নতুন ঘরানা প্রতিষ্ঠা করা মোটেও সহজ নয়। এই অচলায়তন ভাঙতে হলে যে আত্মবিশ্বাস, যে দৃঢ়তা ও যে সাহসিকতার প্রয়োজন, তা কি অন্য কোনো দলের পক্ষে সম্ভব? 

আর বাংলাদেশ? এই দলটি বিশ্বকাপের সবচেয়ে রহস্যময় দল। ছোট-বড় বলে কোনো প্রতিপক্ষ নেই, কখন যে কার বিপক্ষে হারবে কিংবা কার বিপক্ষে জিতবে, এটা কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। এমনিতেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দলের সুনাম নেই। আর এবার তো বিশ্বকাপের অভিযান শুরুর আগেই অনেকটা কাহিল হয়ে পড়েছে। প্রস্তুতিও ভালো হয়নি। ভাটা পড়েছে খেলোয়াড়দের উদ্যম ও উদ্যোগে। ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে টিম স্পিরিটে। এমন একটা নাজুক অবস্থা থেকে বাংলাদেশ কি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে? এর সঠিক উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তো গত্যন্তর নেই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম