
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৬ এএম

হাসনাত আরিয়ান খান
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে তার জীবনী নেই। কোথাও তার জীবন ও কর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। অথচ কোথায় ছিলেন না তিনি! ১৯৪৩ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি আনজুমান মুফিদুল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছিলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে গিয়ে তিনি অভয় দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সংগ্রামে তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৯ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলের সংখ্যালঘু ও উদ্বাস্তুদের আশ্বস্ত করতে এবং তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে তিনি ঐতিহাসিক ‘নেহেরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে সুপ্রিমকোর্টে বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি রেড ক্রসের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি তার মামা অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের জানাজায় অংশ নিয়ে তিনি ও তার মামা দুজনেই আটক হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধানসংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্বের বাধা মোকাবিলা করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি ছয় দফার চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ছয় দফা আন্দোলন তুঙ্গে থাকাকালে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। মূলত মওলানা ভাসানী ও তার কারণেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তরা নিঃশর্ত মুক্তি পেয়েছিলেন। আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতির প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৯ সালের গোলটেবিল সম্মেলনে তিনি ‘এক মানুষ, এক ভোট’ নীতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। এই নীতিতে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠতার যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন আদায় করেছিলেন। এভাবেই তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ীদের জাতীয় সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের অবৈধ সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অবৈধ পাঞ্জাবি শাসকচক্রের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন।
বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়া সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। তিনি ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্মৃতিবিজড়িত মুর্শিদাবাদের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন।
আমরা যখন লড়ছি এবং সংগঠিত হচ্ছি, তখন একজন সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের অভাব আমরা অনুভব করছি। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হাসনাত আরিয়ান খান : লেখক ও গবেষক