
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৬ এএম

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী মমতাজ বেগম ১৯২৩ সালের ২০ মে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শিবপুরে এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম ছিল কল্যাণী রায়চৌধুরী। এবং ডাক নাম ছিল মিনু। তার বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রায়বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং মা মাখনমতি দেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা।
অত্যন্ত রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের মেয়ে হওয়ায় মমতাজ বেগম পড়াশোনার তেমন সুযোগ পাননি। তবুও নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৩৮ সালে কলকাতা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপরেই তার পরিবার থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। নিজের অনড় সিদ্ধান্তের কারণে তার পরিবার অবশেষে তাকে কঠিন পর্দাঘেরা নিয়মের মধ্যে পড়াশোনার সুযোগ দেয়। তিনি ১৯৪২ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিএড পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে এডুকেশন ওয়ার্কশপ ফর টিচার্স কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ১৯৬৩ সালে এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও সিভিল সাপ্লাই অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নাফের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তিনি মমতাজ বেগম নাম গ্রহণ করেন।
মমতাজ বেগম ’৪৭-এর দেশভাগের পর ময়মনসিংহে চলে আসেন এবং শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা পদে সাত মাস শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের মর্গ্যান হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে আনন্দময়ী গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা পদে এবং পরে কিছু সময়ের জন্য আহমদ বাওয়ানী জুট মিল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পদে চাকরি করেন। তাছাড়া তিনি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ‘শিশু নিকেতন’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলোনের সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার মর্গ্যান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রহমতুল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে মর্গ্যান স্কুলের ছাত্রীসহ মহিলাদের প্রথম মিছিল নিয়ে উপস্থিত হন মমতাজ বেগম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। বিক্ষুব্ধ জনতা সারা দেশে সভা-সমাবেশের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিশাল মিছিল বের করে। এতে নারীদের নেতৃত্ব দেন মমতাজ বেগম। নারীদের একত্রিত করে মিছিলে অংশগ্রহণ করা এবং ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে গোপন কার্যক্রম চালানোর দায়ে পুলিশ তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তাকে গ্রেফতার করে হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কোর্ট তার জামিন নামঞ্জুর করে। সংবাদ পাওয়ামাত্র ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জবাসী। উত্তেজিত জনতা থানা ঘেরাও করে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মমতাজ বেগমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু চাষাড়া পর্যন্ত যেতেই জনতার বিশাল বাধার মুখে পড়ে পুলিশ। শুরু করে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু উত্তেজিত জনতার বিশাল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ। ঢাকা থেকে আসে পুলিশ এবং ইপিআরের আরও ফোর্স। এদিকে উত্তাল নারায়ণগঞ্জবাসী চাষাড়া থেকে পাগলা পর্যন্ত রাস্তার প্রায় ১৬০টি গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পুলিশ-জনতার তীব্র সংঘর্ষে আহত হন শত শত ব্যক্তি। গণগ্রেফতার ও লাঠিচার্জের মুখে রাতে একটি ট্রাকে করে মমতাজ বেগম এবং তার সঙ্গে গ্রেফতারকৃতদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে মমতাজ বেগমকে চরম লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হতে হয়। এমনকি তার সংসারও ভেঙে যায়। মমতাজ বেগম ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।