
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৬ এএম

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী একইসঙ্গে ছিলেন ভাষা গবেষক, রাজনীতিবিদ এবং ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শীর্ষ কলমযোদ্ধা। ১৯১৯ সালে মাসিক পত্রিকা ‘সাধনা’ সম্পাদনা দিয়ে তার সাংবাদিক জীবনের শুরু। ওই পত্রিকায় লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ তৎকালীন খ্যাতিমান সব কবি-সাহিত্যিক। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কিছুকাল ওই পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ২ বছর পর ১৯২১ সালে আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচালনায় প্রকাশ পায় ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম নারী সম্পাদিত বাংলা পত্রিকা ‘আন্নেসা’। পত্রিকাটিতে সম্পাদক হিসাবে লেখা থাকত স্ত্রী সফিয়া খাতুনের নাম। কিন্তু কার্যত আবদুর রশিদ সিদ্দিকীই পত্রিকাটি সম্পাদনা ও পরিচালনা করতেন। পরের বছর ১৯২২ সালে তার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশ পায় বিখ্যাত পত্রিকা ‘মোসলেম জগত’। ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকার জন্য পত্রিকাটি বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। ওই পত্রিকায় ‘সময় থাকিতে সাবধান, বুঝে চল ব্রিটিশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধের জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন এবং গ্রেফতার হন; যা ছিল ওই সময় ব্যাপক আলোচিত ঘটনা। পরবর্তীকালে তার সম্পাদনার তালিকায় যুক্ত হয় ‘সাপ্তাহিক রক্তকেতু’, ‘সাপ্তাহিক কক্সবাজার হিতৈষী’ (কক্সবাজারের প্রথম পত্রিকা) ইত্যাদি পত্রিকা।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ ও রম্যরচনাসহ সাহিত্যের সব শাখায় ছিল আব্দুর রশিদ সিদ্দিকীর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তার গ্রন্থের সংখ্যা ২৮। তার মধ্যে উপন্যাস-উপেন্দ্রনন্দিনী (১৯১৯), জরিনা (১৯২৬), প্রণয়-প্রদীপ, নুরুন্নেহার ও মেহেরুন্নেছা (১৯১৮); কাব্য-রোস্তম সোহরাব (১৯১৬), কলির বাঙ্গালা (১৯১৭), চিন্তার ফুল (১৯১৮) যবনবধ কাব্য (১৯৪৪); পঞ্জিকা ‘মোসলেম জগৎ পঞ্জিকা’ (১৯৩৮) উল্লেখযোগ্য। তার রচিত ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব (ব্যাকরণসংবলিত)’ এবং ‘চট্টগ্রামের ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রামী ও রোমাইতত্ত্ব’ গ্রন্থ দুটি ছিল চট্টগ্রামের ভাষার ওপর রচিত প্রথম গবেষণা গ্রন্থ। বই দুটিতে তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। তার অন্যান্য গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘উষাতারা’ (পৃথিবীর জীবনী), হিন্দু মোসলমান (ধর্ম সম্পর্কে তর্ক) ইত্যাদি।
সিদ্দিকী ছিলেন প্রচণ্ড রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও লেখালেখির জন্য তিনি তিনবার কারাবরণ করেন। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৭ ও ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়ে কক্সবাজার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
আবদুর রশিদ সিদ্দিকী একইসঙ্গে ব্যবসা ও সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ‘বেগম খোশ’ নামক একটি পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধ বের করে তিনি প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক হন। অন্যদিকে গ্রাম রক্ষক সমিতি, পল্লী মঙ্গল সমিতি প্রতিষ্ঠাসহ বিচিত্র সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এই বিস্মৃতপ্রায় মনীষীর জীবনের ওপর বাংলা একাডেমি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক জীবনী গ্রন্থ। তার জীবন ও কর্ম নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। হয়তো আগামীতেও হবে। মাত্র ৫৬ বছর আয়ু পাওয়া এই গুণী মানুষটির প্রতি সম্মান জানিয়ে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে বিশেষ স্মারকগ্রন্থ ‘আবদুর রশিদ সিদ্দিকী, বহুপ্রজ লেখক সাংবাদিক’।
১৮৯৪ সালে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার কাকারা গ্রামে জন্ম নেওয়া এই গুণী মানুষটি ১৯৫১ সালের ২৬ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। (আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব)