ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক ড. মুহাম্মদ এনামুল হক ১৯০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বখতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আমিনউল্লাহ ছিলেন একজন আলেম। এনামুল হক বাংলা, ফারসি, আরবি ও উর্দু ভাষা শিক্ষা লাভ করেন বিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই। পরবর্তী সময়ে তিনি রাউজান আর.আর.এ.সি. মডেল সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নকালে তিনি প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৩ সালে এ প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি এন্ট্র্যান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং মোহসীন বৃত্তি অর্জন করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯২৫ সালে এফএ এবং ১৯২৭ সালে আরবিতে সম্মানসহ স্নাতক পাশ করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচ্যদেশীয় ভাষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করায় তিনি জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অধীনে বাংলায় সুফিবাদের ইতিহাসের ওপর প্রায় ছয় বছর গবেষণা করেন এবং ১৯৩৫ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ১৯৪৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজে বাংলার অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে দৌলতপুর কলেজের এবং ১৯৫৪ সালে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ওই বছরের ২৭ নভেম্বর পূর্ব বাংলা স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলা সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক পদে যোগদান করেন। অতঃপর বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক হিসাবে ১৯৬৮ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সুপারনিউমারারি প্রফেসর হিসাবে পুনরায় কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৭৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দেন। এত দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারের ফাঁকে ড. মুহম্মদ এনামুল হক এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলা ভাষা সমিতি, বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির মতো সংস্থারও স্থপতির ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে আমৃত্যু ঢাকা জাদুঘরের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ছিলেন।
তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো ‘বঙ্গে সুফী প্রভাব’ (১৯৩৫), ‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য’ (আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সহযোগে ১৯৩৫), ‘চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য ভেদ’ (১৯৩৫), ‘বাঙলা ভাষার সংস্কার’ (১৯৪৪), ‘পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম’ (১৯৪৮), ‘ব্যাকরণ মঞ্জরী’ (১৯৫২), ‘মুসলিম বাঙ্গালা সাহিত্য’ (১৯৫৭), ‘মনীষা মঞ্জুষা’ (১৯৭৫-১৯৮৪), ‘বুলগেরিয়া ভ্রমণ’ (১৯৭৮) এবং ‘বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ (১৯৭৪)।
সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখায় ড. মুহম্মদ এনামুল হক ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, ১৯৬৮ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (পরবর্তীকালে প্রত্যাখ্যান), ১৯৭৯ সালে একুশে পদক, ১৯৮০ সালে শেরে বাংলা সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮১ সালে মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮৩ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৮২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।