ডিবিএ’র আলোচনা সভায় বক্তারা
পুঁজিবাজারে ১৫ বছরের দুঃশাসনের প্রভাব
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৬ পিএম
গত ১৫ বছরে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ও পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল পুরো দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি। সর্বত্র দুর্নীতি, দুঃশাসন ও বিচারহীনতার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।
শনিবার ঢাকা ক্লাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আয়োজিত আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনার বিষয় ছিল ‘পুঁজিবাজার বর্তমান প্রেক্ষিত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকা স্টক একচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম।
ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. সাইফুদ্দিনের সঞ্চালনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা বক্তব্য রাখেন। তাদের মতে, বাজারে সংস্কারে চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো- সদিচ্ছা, জ্ঞান, চাপমুক্ত থাকা এবং গুণগতমানের নেতৃত্ব। এ সময়ে বর্তমান কমিশনের নেতৃত্বের গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ।
মমিনুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের এই আজকের পরিস্থিতি কারণ দুর্নীতি ও অদক্ষতা। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং রাজনীতির একটি প্রতিচ্ছবি পুঁজিবাজার। এটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। অন্যান্য খাতে দুর্নীতি, বিচারহীনতা, অদক্ষতা ও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পুঁজিবাজারে তার প্রভাব পড়েছে। অনেকে মনে করেন এক রাতে এখান থেকে বড়লোক হওয়া যাবে। তাদের বাজার সম্পর্কে বুঝাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেও ওই প্রতিযোগিতায় নেমেছিল।
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আমরা বুঝেছি, কালচার (সংস্কৃতি) পরিবর্তন না হলে নীতি দিয়ে বেশি দূর আগানো যাবে না। তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজারের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক বা রেফারি হলো ডিএসই। কিন্তু বাজারের প্রাথমিক বিষয়গুলোও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) চলে আসে। কিন্তু দৈনন্দিন বিষয় দেখা তাদের কাজ নয়।
ডিএসই চেয়ারম্যান বলেন, আমি স্বীকার করছি ডিএসইর অনেক ভুল আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবাই এক সঙ্গে কাজ করছি। তবে বর্তমানে ডিএসইতে শীর্ষ পদগুলো ফাঁকা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডিএসইর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা এবং সক্ষমতা বাড়াতে আমরা কাজ করছি।
ডিবিএ’র সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে আমরা অনেক নির্যাতিত হয়েছি। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। সাবেক একজন অর্থমন্ত্রী সবসময় পুঁজিবাজারকে ফাটকাবাজার বলতেন। এ ধারণা থেকে বর্তমান নীতিনির্ধারকরাও বের হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে না। তার মতে, অর্থনীতির ভিত্তি রচনা জন্য পুঁজিবাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এ খাতে সংস্কারে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।
অর্থসূচকের সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ১৫ বছরের দুঃশাসনের ফসল বর্তমান পুঁজিবাজার। দুঃশাসন সব ক্ষেত্রেই ছিল। নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ও পরিবার সবসময় দেশ চালাবে। দেশের সম্পদ লুট করবে আর সাধারণ মানুষ গিনিপিগের মতো তাদের এই রসদ জোগাবে।
শেয়ারবাজারের সাংবাদিকদের সংগঠন সিএমজিএফের সভাপতি এস এম গোলাম সামদানি ভুইয়া বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে নতুন কমিশনের কাছে প্রত্যাশা ছিল, পুঁজিবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু হয়েছে উলটো। প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুঁজিবাজার সামাল দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার আহসান হাবিব বলেন, পুঁজিবাজারে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর মূলত ক্যাপিটাল গেইনের দিকেই নজরটা থাকে। লভ্যাংশের দিকে নজর আছে এ ধরনের বিনিয়োগকারী হাতেগোনা। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে সূচক কমলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চিন্তা থাকে সরকারের পক্ষ থেকে সাপোর্ট দিয়ে বাড়ানো হবে। এটি ঠিক নয়। তাই বিনিয়োগকারীদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।
প্রথম আলোর বিজনেস এডিটর সুজয় মহাজন বলেন, বিনিয়োগ সুরক্ষায় কোম্পানিগুলোর সুরক্ষা তহবিল করা উচিত। এ ছাড়াও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। নতুন বিনিয়োগকারী আনতেও উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বিও অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়াটা আরও সহজ করা উচিত।
যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার মনির হোসেন বলেন, পুঁজিবাজারে দুটি শব্দ খুব পরিচিত। একটি হলো আস্থার সংকট। অপরটি সমন্বয়হীনতা। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আরও দুটি শব্দ যোগ হয়েছে। তা হলো বৈষম্য এবং সংস্কার। তিনি বলেন, ব্রোকারদের বক্তব্যে অনেক সময় বিনিয়োগকারী বিভ্রান্ত হয়। তার মতে, এই বাজারে সংস্কারে চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো- সদিচ্ছা, জ্ঞান, চাপমুক্ত থাকা এবং গুণগতমানের নেতৃত্ব। বর্তমান কমিশনের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকেও চাপ নেই। তবে জ্ঞান ও নেতৃত্বের ঘাটতি আছে।
সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, এই বাজার ব্রোকারদের। তারা চাইলে সব সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো যখন ব্রোকারেজ হাউজের মালিকানায় এসেছে, তখন থেকেই সমস্যা শুরু হয়েছে।
একাত্তর টেলিভিশনের বিজনেস এডিটর সুশান্ত সিনহা বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এটি দূর করতে হবে। এখানে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জরুরি।