Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

প্রাণ প্রকৃতির সুরক্ষা ও অসুস্থ পৃথিবীর নিরাময়

Icon

এম জাকির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:১৭ পিএম

প্রাণ প্রকৃতির সুরক্ষা ও অসুস্থ পৃথিবীর নিরাময়

একবার ভাবুন তো, গাছপালা-লতাগুল্ম সব তামার, ফুলগুলো সব প্লাস্টিকের, পাখি সব কাগজের, লোহা ও কংক্রিটে মোড়ানো নিরেট ও নিস্তব্ধ সব অবকাঠামো সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে। আর প্রাণহীন এসব কংক্রিটের দঙ্গলের মধ্যে প্রাণাচার্য মানুষ ভোগ-ব্যসনে আবদ্ধ হয়ে মিথ্যা অস্তিত্ব খুঁজে ফিরছে। স্বার্থপরতার চক্রাকারে নিত্য ঘুরছে মানুষ, অপরিমেয় ভোগের লালসায় অমূল্য প্রাণ ও নিবেদিত প্রকৃতি উজাড় করে প্রকৃতপক্ষে একে অপরের গিনিপিগ হয়ে উদ্বায়ী তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। কখনো কি আমরা ভাবি প্রাণ ও প্রকৃতি পৃথিবীর আদি এবং সর্বজনীন একক সত্তা?

পৃথিবীতে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে অঞ্চলে যে জীববৈচিত্র্য বা সমন্বিত বাস্তুসংস্থান (ইকোসিস্টেম) দরকার, স্রষ্টা ঠিক সেভাবেই সাজিয়ে দিয়েছেন। অ্যামাজান বন কেন ল্যাটিন আমেরিকায় না হয়ে এশিয়ায় সৃষ্টি হয়নি, হিমালয় পর্বত কেন নেপালে না হয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়নি, প্রমত্ত পদ্মাই বা কেন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ল, কেন তা ভারত মহাসাগরে পতিত হলো না, প্রশান্ত মহাসাগরের জীববৈচিত্র্যের মতো সব সাগর-মহাসাগরের জন্য একইরকম হলো না, কেন প্রতিটা নদী, সাগর, মহাসাগরে ভিন্ন বাস্তুসংস্থান বা জীববৈচিত্র্য বিদ্যমান, ইলিশ মাছ কেন সব সাগরে জন্মায় না-এ প্রশ্নগুলোর মধ্যেই প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষা জড়িয়ে আছে।

জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ প্রাকৃতিকভাবে সন্নিবেশিত যে কোনো একটি প্রাণের ক্ষতি হলে খাদ্য শৃঙ্খলের ওপর নির্ভরশীল প্রত্যেকটি জীব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ যখন একটি গাছ কাটে তাতে শুধু গাছই কাটা হয় না, গাছে বাসরত পাখি, পিঁপড়া, সাপের বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণ বাঁচতে প্রাণ আহার করে, যেমনটি জীবকোষ বিকশিত হয় আরেকটি কোষকে খেয়ে। খাদ্যচক্রের সর্বনিম্ন স্তর প্ল্যাংক্টন ও শ্যাওলা খেয়ে বাঁচে ছোট মাছ, আবার ছোট বা মাঝারিকে খায় বড় এবং বৃহদাকার মাছ বা অন্য প্রাণী, যেমনি তৃণভোজী হরিণকে বাঘ বা সিংহের আহারে পরিণত করে। কিন্তু একমাত্র মানুষ সব ধরনের তৃণ, সবজি, মাছ বা মাংসভোজী। এটা ধ্রুব সত্য যে, মানুষ বা জীবদেহ যদি কার্বন ও অন্যান্য বস্তু সরাসরি আহার ও হজম করতে পারত, তাহলে খাদ্যচক্র বা প্রাণ ও প্রকৃতি পরস্পর নির্ভরশীলতা থাকত না। নির্ভরশীলতার এ ধ্রুব সত্যকে অস্বীকার করে মানুষ জীবনের উৎসকে ধ্বংস করে আত্মহননের ফলেই তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক উপাদান যেমন খাদ্য, অক্সিজেন, পানির সংকট ক্রমেই চরমতম পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। যুগে যুগে যেসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে তার প্রধান কারণ যে প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচার এবং তার প্রধান শিকার মানুষই, সেটি বিভিন্ন গবেষণায় যথাযথভাবে প্রমাণিত। প্রকৃতি একদিকে যেমন প্রাণের প্রতিপালন করে, তেমনি মানুষের জীবন ধারণে প্রাণহরণের সুযোগ দিয়ে প্রতিপালন করে বলেই জীববৈচিত্র্য বিদ্যমান।

অরণ্যভিত্তিক বসবাস ও সমাজ থেকে ধীরে ধীরে মানবসমাজ গড়লেও অপরিণামদর্শী মানুষের কারণে সভ্যতার নামে ইট-পাথর-কাঠ-লোহার সঙ্গে প্রযুক্তি ও অন্তর্জালের সমন্বয়ে নতুন এক অজানা পৃথিবী বানানোর অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের। ভঙ্গুর পিলারের ওপর যতই সুদৃশ্য দালান তৈরি হোক না কেন, তা ভেঙে পড়া অবধারিত, কেননা সমাজ-সভ্যতার টেকসই ব্যবস্থার পরিবর্তে গড়ে উঠেছে নিষ্ফল অভিসমাজ, অভিসভ্যতা। আধুনিকতার আবরণে নির্মল বায়ুর অভাবে ক্রমেই প্রাণপূর্ণ জনপদের ছন্দপতন ঘটছে, কংক্রিটনগরীর উচ্ছিষ্টপূর্ণ দূষণের দুষ্ট স্রোতে প্রকৃতি-প্রদত্ত নদীর প্রবাহ হারাচ্ছে, প্রাণের নগর ঢেকে যাচ্ছে আত্মহননের বিষাক্ত বায়ুতে। তারই মাঝে প্রতিনিয়ত মানুষের ভোগের লালসায় নির্যাতিত, অত্যাচারিত সবুজের টিকে থাকার প্রাণপণ লড়াই, তা-ও প্রাণের স্বার্থে, পরার্থে।

মানুষের ন্যায়-অন্যায় আচরণ, একদিকে ক্রমেই বেড়ে যাওয়া অন্যায্য ভোগলিপ্সা আর অন্যদিকে প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে মানবেতর জীবনযাপনের শিকার কোটি কোটি প্রাণের হাহাকার, পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে মানহীন আবাসন এবং কয়লা, তেল পুড়িয়ে সভ্য হওয়ার প্রাণান্তকর ভঙ্গুর চেষ্টার ফলে পৃথিবী ক্রমেই অবাসযোগ্য হয়ে উঠছে। মানুষ যখনই প্রকৃতির নিয়ম ও বিন্যাস নষ্ট করে অপরিমেয় ভোগ বা অপচয় করে, তখনই প্রকৃতি প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং বিরূপ আচরণ করে, জলবায়ু পরিবর্তন তার অন্যতম উদাহরণ। এর ফলে ক্ষুদ্র অণুজীবের চেয়েও অতি ক্ষুদ্র জীবাণু কোভিড-১৯ সারা পৃথিবীকে মাসের পর মাস থমকে দিয়ে প্রমাণ করল কত ঠুনকো এ উন্নয়নের আয়োজন। শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার এ আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অপরিসীম গবেষণা, বুদ্ধি, ক্ষমতার বাহাদুরি কোনো কিছুই ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না অদৃশ্য জীবাণুর সর্বগ্রাসী আক্রমণকে। এক ভয়ংকর অসহায় অবস্থায় অক্সিজেনের অভাবে রাস্তায় পড়ে লাখো মানুষ মারা যাচ্ছে, নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া মানুষ কিছুই করতে পারছে না, প্রাণসংহারে প্রাণের নীরব বিলাপ প্রকৃতির রুদ্ররোষের সামান্য নমুনা। এটাই যে শেষ নয়, তা-ও জানান দিচ্ছে।

বরফ রাজ্যে তৃণভূমি জানান দিলে তুষার গলে সমুদ্র মহাসাগরে পরিণত হচ্ছে, মরুভূমি বানে ভাসছে, অক্সিজেনের প্রাকৃতিক কারখানা অ্যামাজনের ওপর অসুরের কুনজর পড়েছে, দিকে দিকে প্রাকৃতিক বনগুলো অগ্নিবাণে ছারখার হচ্ছে, সুন্দরীর গালের সৌন্দর্যময় তিলকের মতো বৈচিত্র্যময় সাগরের বুকে ভেসে থাকা ক্ষুদ্র দ্বীপগুলো ফুলে-ফেঁপে ওঠা লোনা জলের রুদ্ররোষে বাঁচা-মরার অবিরত সংগ্রামে লিপ্ত। অথচ কতই না সৌন্দর্যময় এ মুমূর্ষু দ্বীপগুলো ফুল-ফলের সমারোহে সমৃদ্ধ অরণ্য, পাহাড় ছাড়াও ঝরনা, ঝিরিঝিরি নদী, ঢেউয়ের খেলায় সাগরের পানিতে চাঁদের ছলকে পড়া জ্যোৎস্নার বান, বিচিত্র রঙের পশুপাখি, মাছ ও জলজপ্রাণী দিয়ে সাজিয়েছে প্রকৃতি।

পৃথিবীর অসংখ্য বঞ্চিত মানুষ মানবসমাজে অন্যান্য প্রাণীর চেয়েও নিচু স্তরে দিনাতিপাত করছে। মানবাধিকার তো আকাশকুসুম মানবেতর হিসাবে ন্যূনতম অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে কিনা, তাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। প্রকৃতির কোলে বসে শ্রেষ্ঠ প্রাণ মানুষই মানুষকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে, অতলগহ্বর থেকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে, যা সব প্রাণিকুলের স্বাভাবিক জীবনেরও অধম। টেকসই উন্নয়নের আড়ালে বিশ্বব্যাপী সবুজ অর্থনীতি (গ্রিন ইকোনমি), সবুজ চাকরি (গ্রিন জব), সবুজ জ্বালানির নামে ‘মানবিক বাণিজ্য’ জেঁকে বসলেও পৃথিবীব্যাপী সম্পদের অসম বণ্টনে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য ও হাহাকার বেড়েই চলছে, নির্বিকার বোধের লৌহ পাঁজরে মানবতা ঠুকরে মরছে, তাতেও সভ্যতা লজ্জা পায় না। অথচ রূপে-রসে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর রিজিক শুষে নিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলল একশ্রেণির সভ্য (?) মানুষ। অসংখ্য নিরন্ন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ব্যয় না করে তাদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে মঙ্গলকে বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা চরম স্বার্থপরতা ও পৃথিবীবাসীর সঙ্গে প্রতারণামূলক আচরণ।

মানুষ সভ্যতা বিনির্মাণ বা উন্নয়নের নামে যে প্রকৃতিবিধ্বংসী কাঠামো তৈরি করেছে, তা কালের আবর্তে কখনো স্থায়িত্বশীল নয়। কৃত্রিম বন তৈরি করে মানুষ তার নির্বিচার ভোগকে যৌক্তিকতা দিতে চাইলেও মহাপ্রাণের আধার সুন্দরবন এবং পাহাড়, পর্বত বা নদী তৈরি করতে পারে কী? এ অক্ষমতার মধ্যেই সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা নিহিত। অধিক বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষ এ সত্তার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, পরিচর্যা এবং সংরক্ষণের প্রাকৃতিকভাবেই দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের সঙ্গে শুধু অন্যান্য প্রাণের অস্তিত্ব নয়, মানুষের অস্তিত্বও জড়িত।

মানবসৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তাপমাত্রা সজীব দেহকে নির্জীব করে তুললে বা পার্থিব কাজের দৌরাত্ম্যে মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠে সবুজের সান্নিধ্যে নিরাময় খোঁজে, অস্থিরতার জাহান্নাম হতে চিত্তে স্থিরতার নদীতে স্থান করে নিতে, অমাবস্যার গা ছমছম ভাব ছাপিয়ে জোনাকির আলোতে রোমাঞ্চকর সময় অতিবাহিত করে নির্জীব মনকে সজীব করতে হবে বলেই অপরূপভাবে সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। অথচ এ নদীর দুই ধারে কতই না বিচিত্র প্রাণী, জঙ্গলে শিয়ালের হুক্কাহুয়ায় রাতের নিস্তব্ধতা হারাত, বৃষ্টির ছন্দোবদ্ধ শব্দে অশান্ত চিত্তে ঘুমের ছায়া নামে। প্রকৃতিকে সত্যই ভালোবাসলে সব জায়গাতেই প্রকৃতির সুর ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়।

প্রকৃতির কল্পনা মানুষের চিন্তার অতীত বলেই আমাদের চলমান রাখে, প্রকৃতি মানুষের প্রকৃত আবাসন, প্রকৃতিতে প্রাণেরা প্রাণ ফিরে পায়। প্রকৃতি সবসময় আত্মিকতাপূর্ণ, বনের প্রকৃতিতে ফুটন্ত প্রত্যেক ফুলই একেকটি আত্মা, অন্তর্জাল না থাকলেও সেখানেই সবচেয়ে গতিশীল সংযোগ, তাতে হারালে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। এটাই চিরসত্য যে, প্রকৃতি সবকিছুকেই পুনরায় তৈরি করে দেয় যখন মানুষ তা ধ্বংস করে। প্রকৃতির গভীরে তাকালেই প্রাণ ও প্রকৃতি ভালো করে বোঝা সম্ভব, প্রকৃতি যেমন নির্দিষ্ট নিয়মে তার সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে, যেমন রাতের পরে ভোর আসে এবং শীতের পরে বসন্ত আসে, তেমনি প্রকৃতির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে তথা পুনরাবৃত্তিতে অসুস্থ পৃথিবীর নিরাময়ের প্রতিকার রয়েছে।

লেখক : পরিবেশবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম