Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা

Icon

অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৪ পিএম

বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সমাজ-অর্থনীতি, ইতিহাস-ধর্মচর্চা প্রভৃতির উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তৃতি সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। পৃথিবীতে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উৎপত্তি ধর্মীয় চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা’। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়। নালন্দা শব্দের অর্থ ‘দানে অকৃপণ’। বিদ্যাদান ও বিস্তরণে নালন্দার অকৃপণতা ইতিহাস স্বীকৃত। পারিবারিক বা ধর্মীয় শিক্ষার বাহিরে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম সম্ভবত পৃথিবীব্যাপী প্রথম। বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন বিষয়, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, গণিত, দর্শনশাস্ত্র, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদি বিষয়ে এখানে জ্ঞানদান করা হতো। প্রাচীন ভারতের মগধ (বর্তমান বিহার) রাজ্যের রাজধানী রাজগীর থেকে ১০ কি.মি. দূরে অবস্থিত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। কায়রোতে আল আজহার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭২ সালে, যা নালন্দা প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর পর।

প্রায় ১২০০ বছর পূর্বে ইউরোপে গির্জা, চার্চ, তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক জ্ঞান-চর্চার প্রসার ব্যাপকভাবে শুরু হয় এবং ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিকতা পেতে থাকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা। এর ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইতালির বোলোনিয়া ইউনিভার্সিটি (১০৮৮)। ধারণা করা হচ্ছে, এটিই পৃথিবীতে সনদ প্রদানকারী প্রথম ইউনিভার্সিটি। মধ্যযুগে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বস্তুত উচ্চশিক্ষার আধুনিক ভাবধারা নিয়ে আসে। যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় (১০৯৬), সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয় (১১৩৪), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় (১১৬০), ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় (১২০৯) ইত্যাদি। মধ্যযুগে যখন পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র ছিল না। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো। পৃথিবীর দেশে দেশে গণতান্ত্রিক বিকাশ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতির বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিবার্যতা অনুভূত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ-ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৭৫)।
শিক্ষাবিদ এন্ডু কার্নেগি তথা কার্নেগি ফাউন্ডেশন কর্তৃক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ চারটি ভাগে বিভাজন করা হয়েছে। এগুলো R1- উচ্চ গবেষণাধর্মী প্রধানত মৌলিক গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন: স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়; R2-  মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন: মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়; R3- প্রায়োগিক ও মৌলিক গবেষণাসম্পন্ন ডিগ্রি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন: সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং M- ডিগ্রি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত M ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় R3 এবং M ক্যাটাগরির মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর এতদ্ঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির পথ যখন রুদ্ধ হয়, অব্যাহত হতাশা ও বঞ্চনার ব্রিটিশ রাজশক্তির ওপর যখন এতদঞ্চলের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে, তখন এই ক্ষোভ উপলব্ধি করে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে, ০২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদন শেষে ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মত গড়ে তোলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আবাসিক ব্যবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রাচীন প্যারিস মডেল  (যেমন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ) এবং আধুনিক প্যারিস মডেল (আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়) এর এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। যাত্রার শুরু থেকে পাঠদান ও গবেষণা সমান্তরালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে থাকে, তবে গবেষণায় বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারিনি। ২০২১ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৯৬টি একাডেমিক বিভাগ/ইনস্টিটিউটের মধ্যে ৪৬টিতে মাস্টার্স পর্যায়ে কোন থিসিস ছিল না। গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য বিভাগ/ইনস্টিটিউটে মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের ৩০% বাধ্যতামূলক গবেষণা নির্ভর মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদানের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল গ্রহণ করে।

উন্নত দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান চরিত্র হলো বিশেষত মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণায় বিশেষ মনোনিবেশ এবং ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটির কার্যকর সমঝোতা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনায় সরাসরি সমাজের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক স্থাপন করা। নিও-লিবারেল (Neo-Liberal) গ্লোবালাইজেশন এবং জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতির এই যুগে উচ্চশিক্ষা ও উচ্চপ্রবৃত্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর বড় দৃষ্টান্ত হলো দক্ষিণ কোরিয়া। প্রায় ৬০ বছর পূর্বে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল আজকের হাইতি, ইথোপিয়া বা ইয়েমেন-এর মতো। প্রযুক্তি নির্ভর উচ্চশিক্ষার প্রসারের মধ্যদিয়ে দেশটি গত ছয় বছর পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্ভাবন-প্রবন (Innovative) দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। নেচার ইনডেক্স এর তথ্য অনুযায়ী উচ্চমানের গবেষণায় কোরিয়া পৃথিবীতে প্রথম দশটি দেশের মধ্যে একটি। গবেষণায় ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজারমুখী শিক্ষায় এশিয়ায় বহুদূর এগিয়ে। এক্ষেত্রে গবেষণা-উন্নয়নে সরকারের বরাদ্দও প্রনিধানযোগ্য, যা জিডিপির ৪.৮০ শতাংশ। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ১৭১৫ ডলার, ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৫০০০ ডলার-এ, যা যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষার ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া গত চার দশকে উচ্চশিক্ষায়, বিশেষত গবেষণায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং আশাতিরিক্ত ফলও পেয়েছে। মালয়েশিয়ায় ২০১৫ সালের পর উচ্চশিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গবেষণা ও উদ্ভাবনের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন সংগ্রহ করতে হয়। অথচ ২০০০ সাল থেকে প্রায় ১৫ বছর সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মনষ্কতা ও অবকাঠামো বিনির্মাণে ব্যাপক অর্থায়ন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আউটপুট নির্ভর প্রশাসনিক ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে। সিঙ্গাপুরকে অনুসরণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত রুয়ান্ডা উচ্চশিক্ষায় বহুদূর এগিয়ে গেছে। আজ রুয়ান্ডা আফ্রিকার সিঙ্গাপুর নামে খ্যাত।

ইন্ডাস্ট্রি ইউনিভার্সিটির কার্যকর সমঝোতা ব্যতীত উচ্চশিক্ষা কখনো প্রায়োগিক ও বাজারমুখী করা সম্ভব নয়। এই ধরনের সমঝোতার কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। জাপানের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়কে ইনোভেশন-হাব হিসেবে চিহ্নিত করে দেশটি প্রতিটি উন্নয়ন কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগিতা নিয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থীকে গভীর মনোযোগের সাথে সম্পূর্ণ নির্ভুল গবেষণা কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়। জাপানি শিক্ষার্থী-গবেষকরা নির্ভুল কাজের জন্য পরীক্ষাগারে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে থাকে। যে কারণে আজ জাপানি বিশেষজ্ঞরা পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত এবং জাপানি প্রযুক্তিও অত্যন্ত সূক্ষ্মমানসম্পন্ন ও ব্যয়বহুল।

গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্ট জ্ঞানের প্রয়োগ ও প্রভাব নিশ্চিতকরণও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় কাজ। জ্ঞান অর্থহীন, যদি এর প্রয়োগ সামাজিক উন্নয়নে না আসে। টেকসই উন্নয়নের এই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব সমাজে কতটুকু, তাও বর্তমানে নির্ণয় করা হয়। একে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইফপ্যাক্ট মর্যাদাক্রম বলা হয়। টাইমস্ হায়ার এডুকেশনের তথ্যমতে, এসডিজি গোলভিত্তিক ইফপ্যাক্ট মর্যাদাক্রমে ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটি (অস্ট্রেলিয়া) পৃথিবীব্যাপী ২০২২ সালে শীর্ষে অবস্থান করেছে। পৃথিবীর কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফপ্যাক্ট মর্যাদাক্রম-এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রশাসকও নিয়োগ করে থাকে। যেমন: কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (ইফপ্যাক্ট) নামে একটি পদ আছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি বা পদায়ন নির্ভর করে শিক্ষকতা ও গবেষণায় তাঁরা সমাজে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারছে তার উপর। মাস দুয়েক আগে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাসেল থমসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। আমার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি ড. রাসেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার গবেষণা প্রবন্ধ কতটি। তিনি জানালেন প্রায় ২০০টি। জানতে চাইলাম, এখনো অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাননি কেন? ড. রাসেল জানালো, সোসাইটিতে তাঁর গবেষণার সরাসরি ইফপ্যাক্ট কম বিধায় পদোন্নতি বিলম্বিত হয়েছে, তবে এখন তিনি পদোন্নতির শর্ত পূরণ করেছেন।

শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষাদানের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি বা পদায়নের যৌক্তিকতা উচ্চশিক্ষার অনুষঙ্গী অংশ। আমি যখন ১৯৯৬ সালে নেদারল্যান্ডের টুয়েন্টি বিশ্ববিদ্যালয়ে’র ফ্যাকাল্টি অব জিও ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড আর্থ অবজারভেশন-এ দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রিতে অধ্যয়ন করি তখন ড. ভেনডার মীর আমাদের রিমোট সেন্সিং পড়াতেন। তিনি ১৯৯৯ সালে বত্রিশ বছর বয়সে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। অবজেক্ট নির্ণয় সংক্রান্ত রিমোট সেন্সিং গবেষণায় অসামান্য দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন বিধায় তিনি পদোন্নতি পেয়েছিলেন। অথচ তাঁর সমসাময়িক অনেকেই অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাননি; যাঁদের পদোন্নতি হয়েছে তারাও অনেক বয়সেই পেয়েছেন। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক কারণে আমাদের দেশে পদোন্নতির এরকম নীতি অনুসরণ করা এখনো দুরূহ।

শিক্ষাদানের উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত পঠন-পাঠন ও গবেষণায় শিক্ষার্থীদের স্থির মনোনিবেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে আমি পিকিং ইউনিভার্সিটির (বেইজিং) সেনজেন গ্র্যাজুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম। পিনপতন নিস্তব্ধতা এবং পড়াশুনা ও গবেষণায় একাগ্রতার পরিবেশ যেভাবে এই ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা হয়েছে, তা আমাকে বিমোহিত করেছে। মনে হয়েছে, ক্যাম্পাসটি একটি আরাধনার স্থান। বেইজিং থেকে সেনজেন প্রায় ২০০০ কি.মি. দূরে, বিশ্ববিদ্যালয়টির তৃতীয় ক্যাম্পাস। বর্তমানে টাইমস হাইয়ার এডুকেশনের মর্যাদাক্রমে পিকিং ইউনিভার্সিটির (বেইজিং) অবস্থান বিশ্বে ১৬তম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে হাইওয়ে ও সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা। প্রায় সাতটি প্রবেশ পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যাতায়াত করা যায়। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, কোলাহল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যসঙ্গী। তার উপর অধিক শিক্ষার্থীর চাপ। এমতাবস্থায়, পঠন-পাঠনে ও গবেষণায় সুস্থির মনোনিবেশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির পারিপার্শিকতা আজকের বাস্তবতায় কতটুকু শিক্ষার্থীবান্ধব, তা ভাবা দরকার।

স্কেনডেভেনিয়ান দেশগুলো ব্যতীত পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থা বাণিজ্যকরণের কারণে র্যাঙ্কিং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা-নির্ভর প্রথম সারির আটটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রুপ-৮ নামে ভূষিত করা হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মেলবোর্ন, সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৫৪,০০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৪% বিদেশি। ৪৯% মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থী। শুধু গ্রুপ-৮ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে প্রায় ৬৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে যা দেশটির জিডিপি’র ৪%। মর্যাদাক্রম নির্ধারণের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট, গবেষণা ও গবেষণা বরাদ্দ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ইত্যাদির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার পরিবেশ ও বিবেচিত হয়। আমি ২০০৪ সালের মাঝামাঝি টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করি। ২০১০ সালে আমি যখন টোকিওতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যাই, তখন সম্পূর্ণ নতুন অবয়ব লক্ষ্য করি। নতুনভাবে ল্যাবরেটরি ও ভবনগুলো সাজানো হয়েছে। আমার ডক্টরাল সুপারভাইজার অধ্যাপক ছাবুরো মিডোরিকাওয়া’কে এমন পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তিনির্ভর দ্রুত পরিবর্তনের সাথে তালমিলিয়ে নেওয়ার কথা তিনি জানালেন। তিনি বললেন- আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি ক্যাম্পাসের বাহ্যিক সৌন্দর্য ও শিক্ষার্থীদের নানাভাবে প্রভাবিত করে, মনোজগতে পরিবর্তন ঘটায়। আমাদের দেশের বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা যন্ত্রপাতি যেমন অপ্রতুল, তেমনি ক্যাম্পাসের পরিবেশও শিক্ষার্থীদের মনোজগতকে প্রভাবিত করার মত নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষকে সামনে রেখে গবেষণার ইকোসিস্টেম উন্নয়ন, শিক্ষার্থী সংখ্যা বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত করা, অবকাঠামোগত ও একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুতকরণ, জার্নালগুলোর মানোন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পদোন্নতির নীতিমালা সংস্কার, শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়ন, কারিকুলাম যুগোপযোগী ও গবেষণাগার আধুনীকরণসহ বহু পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। উচ্চশিক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তন আনতে হলে অ্যালামনাইদের সামগ্রিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। বস্তুত পশ্চিমা দেশগুলোতে অ্যালামনাইগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। গুণগত শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর উপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরশীলতা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে, দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সহজতর হবে। এখানে উল্লেখ্য, এসব কারণে বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষাকে টপ-ডাউন-এপ্রোচ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।


লেখক: উপ-উপাচার্য (শিক্ষা),ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম