Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

অবৈধ পথে আন্তর্জাতিক এসএমএস আদান-প্রদান

রাজস্ব হাতছাড়া বছরে ২০০ কোটি টাকা

বৈধ পথে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে আন্তর্জাতিক কলের সংখ্যা

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজস্ব হাতছাড়া বছরে ২০০ কোটি টাকা

প্রতীকী ছবি

বৈধ পথে আন্তর্জাতিক শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস) আদান-প্রদান না করায় সরকার প্রতিবছর ২০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। শুধু শর্ট মেসেজ নয়, আশঙ্কাজনক হারে কমেছে আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ। আগের বছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ কমেছে ১১৬ কোটি ৫৩ হাজার মিনিট। এটি চলতি অর্থবছরে ৩০০ কোটি মিনিট ছাড়িয়ে যেতে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।

তাদের মতে, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) অপারেটরগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব বিবেচনায় না নেওয়া, অবৈধ পথে কল ও মেসেজ টার্মিনেশনে পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকা এবং কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই মূলত অস্বাভাবিকভাবে কমেছে আন্তর্জাতিক কল ও মেসেজ টার্মিনেশন। শুধু তাই নয়, আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে না এনে মোবাইল ফোন অপারেটরের মাধ্যমে মেসেজ আনাও অন্যতম কারণ। এছাড়া ১৭ বছর ধরে কতিপয় অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দিতে ক্রমান্বয়ে কল রেট কমানোর অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে এ সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী যুগান্তরকে বলেন, অবৈধ কল টার্মিনেশন, আন্তর্জাতিক কল কমে যাওয়া, বৈধ পথে শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস) না আসাসহ আরও কয়েকটি জায়গায় সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। যেসব কোম্পানির কাছে বকেয়া পাওনা আছে, সেসব পাওনা আদায় করা হবে। কিছু সেক্টরে অতিরিক্ত লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কাটছাঁট করা হবে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে প্রতিমাসে আন্তর্জাতিক এসএমএস (শর্ট মেসেজ সার্ভিস) আসছে তিন কোটির মতো। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে এসএমএস যাচ্ছে অগণিত। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৈধ পথে মেসেজগুলো না আসা এবং এ নিয়ে বিটিআরসির কোনো নীতিমালা না থাকায় আন্তর্জাতিক এসএমএস থেকে সরকার প্রতিবছর কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। বিটিআরসি উদ্যোগ নিলে সরকারের এ রাজস্ব আয় আরও বাড়বে। বর্তমানে কোনো ধরনের নীতিমালা না থাকায় হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার, ইমোসহ বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে কলের কারণেও সাধারণ কল একেবারে কমে গেছে।

বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোবাইল ও টেলিফোন নেটওয়ার্কে বৈধ আন্তর্জাতিক আগমনি কলের পরিমাণ ছিল ৮৪৭ কোটি ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৩৫৮ মিনিট। একই সময়ে দেশের মধ্য থেকে বহির্গামী আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ২১ মিনিট। আগের বছরের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক আগমনি কলের পরিমাণ কমেছে ১৩ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ৭৪০ মিনিট। একই সময়ে আগের বছরের তুলনায় বহির্গামী আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ কমেছে ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ৩৩ মিনিট। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোবাইল ও টেলিফোন নেটওয়ার্কে বৈধ আন্তর্জাতিক আগমনি কলের পরিমাণ ছিল ৭৩১ কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার ২৯৫ মিনিট। একই সময়ে দেশের মধ্য থেকে বহির্গামী আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ২৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫ মিনিট। আগের বছরের চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক আগমনি কলের পরিমাণ কমেছে ১১৬ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৬৩ মিনিট। একই সময়ে আগের বছরের তুলনায় বহির্গামী আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ কমেছে ৯১ লাখ ৮০ হাজার ৯৭৬ মিনিট।

বর্তমানে বিটিসিএল-সহ বেসরকারি আইজিডব্লিউ অপারেটর মিলিয়ে ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আইজিডব্লিউ মূলত একটি সেবা, যার মাধ্যমে দেশের ভেতর ও বাইরের ফোনকল সংযুক্ত করা হয়। যখন কোনো গ্রাহক বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কল করেন বা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে কোনো গ্রাহকের কাছে কল আসে, তখন এটি আইজিডব্লিউর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। গ্রাহকরা বিদেশে কল করলে মোবাইল অপারেটররা কলটিকে আইজিডব্লিউতে পাঠায়। তারপর সেখান থেকে কলটি যে দেশে করা হয়েছে, তার নেটওয়ার্কে পৌঁছে যায়। একইভাবে যখন বিদেশ থেকে বাংলাদেশে কারও কাছে কল আসে, তখন কলটি আইজিডব্লিউর মাধ্যমে গ্রাহকের নির্ধারিত মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কে পৌঁছায়। সেখান থেকে গ্রাহক কল গ্রহণ করেন।

এ প্রসঙ্গে আইজিডব্লিউ অপারেটর ফোরামের (আইওএফ) চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মুশফিক মনজুর বলেন, বিশ্বব্যাপী হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার, ভাইবার, ইমোর মতো ওটিটি অ্যাপের ব্যবহার বাড়ায় প্রচলিত মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ কমে এসেছে। এমনকি বর্তমানে ব্যবসায়িক কথোপকথনগুলোও ওটিটি অ্যাপের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

মুশফিক মনজুর বলেন, এছাড়া ভিওআইপি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসাধু ব্যক্তিদের অবৈধ কল পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির অভাব আইজিডব্লিউ ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব রাখছে।

আন্তর্জাতিক বহির্গামী কল কমে আসার আরেকটি কারণ হিসাবে আইওএফ-এর এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ সালের পর বিটিআরসি কর্তৃক আন্তর্জাতিক কলের ট্যারিফ কাঠামো হালনাগাদ করা হয়নি। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশে কলরেট উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী অর্ধেকের বেশি দেশে বহির্গামী কল কমে এসেছে, যা আইজিডব্লিউ অপারেটরকে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি করছে।

আইওএফ-এর সিওও আরও বলেন, আইএলডিটিএস নীতিমালা অনুযায়ী ইন্টারনেট ট্রাফিক বাদে সব আন্তর্জাতিক সার্ভিস আইজিডব্লিউর মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) রেসপনসিবল থাকবে। কিন্তু বিটিআরসি শুধু আন্তর্জাতিক আগমনি ও বহির্গামী কল পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক এসএমএস পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সরকার যদি আইজিডব্লিউ অপারেটরদের আন্তর্জাতিক এসএমএস পরিচালনার সুযোগ দেয়, তবে এখান থেকে প্রতিমাসে দেড় থেকে দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে পারবে, যা বর্তমান রেভিনিউ থেকে প্রায় ৯ গুণ বেশি। এছাড়া আইজিডব্লিউ অপারেটরগুলোকে সিগন্যালিং লিংক রোমিংয়ের সুযোগ দিলে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এমনটা হলে আন্তর্জাতিক ভয়েস কল কমে আসার পরিস্থিতিতেও আইজিডব্লিউ অপারেটররা টিকে থাকতে পারবে।

এ খাতে একাধিক ব্যবসায়ী মনে করেন, ২০০৮ সালে অবৈধ ভিওআইপি এবং মোবাইল অপারেটর কর্তৃক সরকারের রেভিনিউ ফাঁকি রোধে নতুন টপোলজিতে আইজিডব্লিউ ও আইসিএক্স-এর সংযোজন ছিল সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। ২০১৫ সালে আইওএফ গঠন করে নতুন টপোলজিতে পরিবর্তনও এ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং বিটিআরসির অর্থ আদায়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।

অভিযোগ আছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেলিযোগাযোগ খাতে বেশকিছু লাইসেন্স দেওয়া হয়। তখন বিদেশ থেকে কল আনা ছিল লাভজনক ব্যবসা। ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিরা বিটিআরসির পাওনা না দিয়ে একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম