
প্রিন্ট: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৫১ পিএম
ফিলিস্তিনিদের কান্না ঝরানো ঈদ

মাওলা আলী
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বছর ঘুরে আবার এসেছে ঈদ। ঈদ মানে হাসি। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে সীমাহীন আনন্দ। ঈদ এলেই মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার দিনগুলো। নতুন জামা পুরোনো হয়ে যাবে বলে কাউকে দেখতে না দেওয়া। ঈদের সকালে গোসল করে বাবার আঙুল ধরে ঈদগাহে যাওয়া। সালামি পাওয়া। নানুবাড়ি-দাদুবাড়ি ঘুরতে যাওয়াসহ অনেক স্মৃতিই মনের কোণে খেলা করে। তবে এবারের ঈদ বিশ্ব মুসলমানদের জন্য ব্যতিক্রম। এবার ঈদ এসেছে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের রক্তাক্ত করুণ বাস্তবতা নিয়ে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমানরা একটি দেহের মতো। পৃথিবীর কোথাও তারা আক্রান্ত হলে অন্য প্রান্তের মুসলমানরা কেঁদে ওঠে। এবারের ঈদ তাই আনন্দের সঙ্গে নিয়ে এসেছে বেদনার ঝরনাও। ঈদের দিন তাই ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জন্য মন কাঁদবে বাংলাদেশের মুসলমানদের। বিশিষ্টজনদের ঈদের ভাবনা নিয়ে লিখেছেন-মাওলা আলী
মন পড়ে থাকবে
ফিলিস্তিনের লাল মাটিতে
শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন
চেয়ারম্যান, জামালী তালিমুল কুরআন ফাউন্ডেশন
পৃথিবীর ইতিহাসে আবারও এক কালো ঈদ এসেছে। একদিকে ফিলিস্তিনের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা বোমার আঘাতে শহিদ হচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ব মুসলমান ঈদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সন্দেহ নেই, মুসলমানদের দুয়ারে ঈদ এসেছে চাঁদের নিয়মেই। চাঁদ যদি কথা বলতে পারত তাহলে চিৎকার করে বলত, হে দুনিয়ার মানুষ! তোমরা সুন্দরের উপমা দাও আমার সঙ্গে। আর আমি সুন্দর দেখেছি ফিলিস্তিনের নিষ্পাপ শিশুদের মাঝে। আহ! এমন ফুটফুটে শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করতে কি খুনিদের বুক কাঁপে না? তাদের কি সন্তান নেই? তারা কি পিতা না? নিজের শিশুর মুখে চুমো খায় না? বাবা ডাক শোনে না? ফিলিস্তিনের শিশুদের তো অধিকার আছে বাবার আদর পাওয়ার। চুমো খাওয়ার। মন ভরে ডাকার। তাহলে কেন তাদের হত্যা করা হচ্ছে? কী তাদের অপরাধ? তাদের অপরাধ কি শুধু তারা মুসলমান এতটুকুই? এ জন্যই কি রমজানের মতো পবিত্র মাসে ফিলিস্তিনের হাজার হাজার মুসলমানকে বোমার আঘাতে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? হায়! কোথায় বিশ্বের মানবতা? ফিলিস্তিনের গণহত্যার ব্যাপারে কেন তারা চুপ? এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এবার আর আনন্দ নিয়ে ঈদ উদযাপন করবে না কোনো মুসলমান। হয়তো সে নতুন কাপড় পরবে কিংবা পরবে না, হয়তো সেমাই খাবে কিংবা খাবে না, কিন্তু তার মন সারক্ষণ পড়ে থাকবে ফিলিস্তিনের লাল মাটিতে। হে আল্লাহ! আপনি আমার ফিলিস্তিনের ভাইদের শান্তি দিন। তাদের আপনি স্বস্তি দিন। বিজয় তাদের জন্য তরান্বিত করে দিন। এবারের ঈদে এই হবে আমাদের দোয়া।
শোকরিয়া ও আনন্দ প্রকাশের উৎসব
মাওলানা শাহ্ মো. শফিকুর রহমান
খতিব, আমলীগোলা জামে মসজিদ, লালবাগ, ঢাকা
ঈদ একটি ইসলামি পরিভাষা। এটি মুসলিম উম্মাহর বিশেষ ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মুসলমানদের সংস্কৃতি। ইসলামি মূল্যবোধের আলোকেই ঈদ উদযাপন করতে হবে। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের দিনটি মূলত আল্লাহ দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের জন্য। তিনি যে রমজানের সব রোজা রাখার এবং তার ইবাদতে পুরা একটি মাস কাটানোর তাওফিক দিয়েছেন সেজন্য শোকর আদায়- এটাই ঈদের তাৎপর্য। এ মাসে রোজা রাখতে পারা এবং আল্লাহর ইবাদতের অসীম-অবারিত সুযোগ পাওয়ার যে আনন্দ মুমিন-হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়-ঈদুল ফিতর হলো সে আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব। সে আনন্দের প্রকাশ ঘটে দলে দলে ঈদগাহে হাজির হয়ে মহান রবের কৃতজ্ঞতায় সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। তার মহিমা ও বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে তাকবির পাঠের মাধ্যমে এবং এ সিয়াম সাধনা যেন কবুল হয় সেজন্য একে অপরের কাছে দোয়া চাওয়ার মাধ্যমে। ঈদের দিন কুশল বিনিময়ের ভাষার মধ্যেই এ বার্তা রয়েছে-‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ও মিনকুম। অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করুন-রমজান মাসে ও আজকের দিনে করা আমাদের ও তোমাদের নেক আমল।’ কুশল বিনিময়ের এ বাক্যটিই ইসলামের ঈদকে অন্যান্য ধর্মের উৎসব থেকে আলাদা করে দেয়। মুসলমানের ঈদ আশা ও ভয়ে মিশ্রিত এক সতর্ক ও সংযত আনন্দ উদযাপন। একদিকে খুশি-আলহামদুলিল্লাহ, রোজাগুলো রাখতে পেরেছি। অন্যদিকে শঙ্কা-কবুল হয়েছে তো! রমজান পেয়েও যদি মাগফিরাত নসিব না হয়, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য তো কিছু নেই।
ঈদের সঙ্গে শপিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই
মোহাম্মদ এজাজ
প্রশাসক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)
ঈদ মানেই নতুন জামা। আব্বা কাপড় কিনে জামা বানিয়ে দিতেন। জামার সঙ্গে নতুন জুতাও চাই। ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ থেকে ফিরে সবার আগে ফুফুর বাসায় চলে যেতাম। ফুফু সালামি দিতেন। আম্মাও দিতেন। তবে আগে ফুফুর বাসায় যেতাম। সবার থেকে সালামি নিয়ে চটপটি খেতে যেতাম। তখন ঢাকার অলিগলিতে চটপটির দোকান বসতে শুরু করেছে কেবল। বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। ফুটবল খেলতাম। রাতে তুরাগের পাড়ে ঘুরতে যেতাম। এখন আবার ঈদ অন্যভাবে উদযাপন করি। নামাজ পড়েই সবার আগে মনে পড়ে মায়ের কথা। কয়েক বছর আগেও মা কাছে ছিলেন। এখন নেই। মায়ের কবর জেয়ারত করে ঈদের দিন শুরু হয়। আগে আমি সালামি নিতাম। এখন সালামি দিই। এলাকার সবাইকে ৫০ টাকা করে সালামি দিই। সবাই আসে সালামি নিতে। সালামি নেওয়ার চেয়ে দেওয়ার আনন্দ কোনো অংশেই কম নয়। তবে ঈদ নিয়ে একটি কথা বলতে চাই। আমরা এখন অনেক বেশি ভোগবাদী হয়ে গেছি। কে কত টাকার শপিং করবে, এটা এখন ঈদের আনন্দের প্যারামিটার বানিয়ে ফেলেছি। ঈদের সঙ্গে অনেক টাকার শপিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। হ্যাঁ! একটা নতুন পাঞ্জাবি বা শাড়ি হলে ভালো। না হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যেভাবে লাখ টাকা শপিং করি এবং সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে প্রচার করে বেড়াই, এটা কোনোভাবেই ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে যায় না। যার আলমারি ভর্তি কাপড়, সে আরও কিনছে। আর যার গায়ে কোনো কাপড়ই নেই, সে কিছুই কিনছে না-এটা মুসলমানদের সমাজ হতে পারে না। রোজা এসেছে সংযম ও সহমর্মিতা শেখাতে। কিন্তু আমাদের জীবনে, আমাদের ঈদে, আমাদের ইফতারিতে, আমাদের শপিংয়ে কোথাও আমরা সংযম ও সহমর্মিতার চর্চা করছি না।
ঈদ শুধু উৎসব নয় ইবাদতও বটে
নাজমুল আহসান
সচিব, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়
আমরা সাত ভাইবোন। স্মৃতিতে ২০১০ সালের ঈদের কথা আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। ওই বছর আব্বা, আমি আর আমার ছেলে অর্থাৎ আমরা তিন পুরুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে যাই। বাবার সঙ্গে ওইটাই শেষ ঈদ, শেষ নামাজ পড়া। তার কিছুদিন পর আব্বা মারা যান। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমাদের ঈদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন আমাদের মা। সরকারি কাজে ঢাকার বাইরে না থাকলে ভাইবোন সবাই মিলে মায়ের সঙ্গেই ঈদ করতাম। গত বছর মা মারা যান। এবারই প্রথম আব্বার ছায়া আর মায়ের স্নেহ ছাড়া ঈদ করতে হবে। আমার সন্তানরা বড় হয়েছে। তারা এখন আমাদের সঙ্গে ঈদ করেন। এটাই পৃথিবীর নিয়ম, সন্তানরা বড় হতে থাকেন, আর বাবা-মা বৃদ্ধ হতে থাকেন। কর্মসূত্রে কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলে যদি দেশের বাইরে যায়, তাহলে সন্তানকে ছাড়া আমাকে ঈদ করতে হবে। এটা এক ধরনের খারাপ লাগা। আবার হাসিমুখে এটা মেনেও নিতে হবে। ঈদ সম্পর্কে যেটা বলব, ঈদ আমাদের শুধু উৎসব নয়, ইবাদতও বটে। একমাস সিয়াম সাধনা শেষে আমরা ঈদের দিন যে উৎসব করি, তা শুরু হয় দুই রাকাত নামাজের মাধ্যমে। এর মানে হলো, আমাদের উৎসব যেন ইবাদতের চেতনাকে ছাড়িয়ে না যায়। সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করাই ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য। আর সিয়াম সাধনা সে শিক্ষাই দেয় আমাদের। আমাদের জীবন থেকে সব ধরনের বৈষম্য চিরতরে মুছে দেওয়ার নামই সত্যিকারের ঈদ।