সময় থাকতে কর মায়ের যতন
শেখ তারেক হাসান মাহদী
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সুন্দর পৃথিবী। সুন্দর সকালের আলো। আরও সুন্দর তারাভরা আকাশ, মায়াবী জোসনা, ভোরের শিশির, ফসলের মাঠ, সবুজ বাগান, নীল দিঘি, শান্ত পুকুর, পাশের খাল, মস্ত বিল, শাপলা ফুল। তবে সবচেয়ে সুন্দর আমার মায়ের মুখ। ওই মুখের মতো এত মায়া আর কোথাও নেই। প্রতিটি মায়ের বুকেই সন্তানের জন্য একটি নদী আছে। ভুল বললাম, নদী নয় সমুদ্র আছে। কারণে-অকারণে খেয়ালে-বেখেয়ালে, সুখে-দুঃখে হাসি উৎসবে সব সময় মায়ের বুকের সমুদ্রে ঢেউ ওঠে। বুকের ঢেউ চোখে নোনা পানির ঝরনা হয়ে ঝরে। সন্তানের ভালো দেখলে মায়ের চোখে পানি। সন্তানের মন্দ দেখলে মায়ের চোখে আরও বেশি পানি। ভালো দেখলে মা কেঁদে কেঁদে দোয়া করেন, ‘মাওলা গো! আমার ফুতেরে আরও ভালো রাইখো।’ আর মন্দ দেখলে মা সেজদায় পড়ে দোয়া করেন, ‘আমার জীবনের বিনিময়ে তুমি ভালো করে দাও আমার ফুতেরে।’ আসমানে যিনি মানুষের ভালো-মন্দ ঠিক করেন তিনি মাঝে মাঝে ভাবনায় পড়ে যান। মায়ের দোয়ায় ছেলের তাকদির পর্যন্ত বদলে দেন তিনি। এমন মা যার ঘরে আছে আল্লাহর জান্নাত তার হাতের মুঠোয়।
আমার মা জনমভর শুধু দুঃখই সয়েছেন। মানুষ ব্যথা পেলে কাঁদে। আমার মায়ের নিজস্ব কোনো ব্যথা ছিল না। তিনি কাঁদতেন আমি কষ্ট পেলে। মানুষ আনন্দে হাসে। আমার মায়ের নিজস্ব কোনো আনন্দ ছিল না। আমার আনন্দেই মা হাসতেন খল খল করে। হাসলে মাকে গোলাপের মতো মিষ্টি লাগত। কাঁদলে মাকে বেতফলের মতো বিধ্বস্ত দেখাত। বোকা ‘ফুত’ আমি, মায়ের হাসি কান্নার মর্ম বুঝিনি যখন কাছে ছিল। নির্বোধ আমি, মায়ের হক আদায় করতে পারিনি যখন সুযোগ ছিল। আবারও ভুল বললাম। পৃথিবীর কোনো সন্তানই মায়ের একফোঁটা দুধের হক আদায় করতে পারবে না। সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় তীব্র ক্ষুধা পেটে মা যখন খাবার সামনে নিয়ে বসে, এক উটকো গন্ধ মায়ের নাকে এসে লাগে। খালি পেটে পাক দিয়ে বমি আসে। সে কী কষ্ট! নাড়িভুঁড়ি কলিজা পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে চায়। ১০ মাস ১০ দিনের মধ্যে মাত্র একদিনের, না না একবেলা বমির সময় নিশ্বাস নিতে যে কষ্ট হয়েছে মায়ের, সারা জীবন কদমে পড়ে থাকলেও সে ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়।
সন্তানকে পেটে ধরার প্রথম দিন থেকেই মা ভুলে যান তার অস্তিত্ব। পরম যত্নে নিজের চেয়েও বেশি করে ভাবেন সন্তানের ভালো-মন্দ। সন্তান ঘরে থাকলে মায়ের দুশ্চিন্তা। সন্তান বাইরে থাকলে মায়ের আরও বেশি দুশ্চিন্তা। বাড়ির সবার চোখে ঠিক থাকলেও মায়ের কাছে কেন যেন মনে হয় সন্তান ঠিক মতো খায় না। মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কোনো কাজে সন্তান বাইরে গেলে হঠাৎ হঠাৎ বুকটা ধক করে ওঠে, সন্তান আমার ঠিক আছে তো? চোখে দেখার আগ পর্যন্ত মায়ের দুশ্চিন্তা কমে না। আর কোনো হতভাগা মায়ের সন্তান যদি প্রবাসে পাড়ি জামায়, সে মায়ের মনের কষ্ট প্রকাশ করার মতো ভাষা খোদ মাওলানা রুমিরও জানা ছিল না। সন্তান যতই ভিডিও কলে কথা বলে জানায় আমি ভালো আছি মা। মায়ের মনে হয় সন্তান কী যেন লুকাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের বুকের সমুদ্র শুকিয়ে ধু ধু মরুভূমি হয়ে যায়। হে আল্লাহ! সন্তানের জন্য মা কাঁদবে, হয়তো এ জন্যই মায়ের বুকে বিশাল সমুদ্র দিয়েছেন আপনি। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে যে মায়ের সমুদ্র শুকিয়ে গেছে, সে মায়ের বুকের ধনকে আপনি ঢেকে রাখুন বিশেষ রহমতের চাদরে।
স্বার্থপর পৃথিবীতে যার মা আছে, তার কোনো দুঃখ নেই। বিপরীত কথাটিও সত্য-যার মা নেই, তার চেয়ে দুঃখী কেউ নেই। সন্তান যেখানেই থাকুক কাছে কিংবা দূরে, মায়ের মুখ মনে হলেই হৃদয় নেচে ওঠে। আনন্দে চারদিক ঝলমল করে। খুশিতে বাগবাগ হয়ে যায় প্রাণ। সন্তানের যা ভালো, সৌভাগ্য, উন্নতি-সবকিছুই মায়ের দোয়ার ফসল। হায়! যার মা নেই, ঘরে বাইরে যেখানেই সে থাকে-পোড়া কপাল তার জোড়া লাগে না। সে জানে জটিল দুনিয়ায় সহজ করে তাকে ভালোবাসবে, মতলব ছাড়া তার খোঁজ নেবে এমন মানুষটি চলে গেছে পৃথিবীর সফর শেষ করে। এখন তাকে স্বার্থ ছাড়া কেউ ভালোবাসে না। মতলব ছাড়া কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। না খেয়ে কেউ তার জন্য বসে থাকে না। গভীর রাতে না ঘুমিয়ে তার জন্য কেউ হাসি মুখে অপেক্ষা করে না।
প্রিয় পাঠক! এক সপ্তাহ আগেও আমি ছিলাম পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষদের একজন। আমার মতো সৌভাগ্যবান আর কেউ ছিল না। আল্লাহর বিধান! আমার ভাগ্যরেখা ঘুরে গেছে। হতাভাগাদের তালিকায় আমার নাম চলে এসেছে। আজ কদিন হলো মা চলে গেছেন আল্লাহর জিম্মায়। আমি এক মা-হারা এতিম সন্তান। আমার মা নেই। আমার কেউ নেই। আমার মা নেই। আমার কিছু নেই। আমার মা নেই। আমার সব নেই। আমার মা নেই। আমার কোনো আত্মীয় নেই। আমার মা নেই। আমার কোনো সম্পদ নেই। আমার মা নেই। আমার কোনো সহায় নেই। আমার মা নেই। আমার কোনো পরিচয় নেই।
ঘরে ঢুকলেই দেখি মায়ের বিছানাটা খালি। বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মায়ের নাম্বার থেকে আর কোনো দিন কল আসবে না ভাবতেই বুকটা খানখান হয়ে যায়। মায়ের কোলে আর কখনো ঝাঁপিয়ে পড়ব না মনে হলেই কলিজা ছিঁড়ে যায়। তুমি হে পাঠক! মায়ের কদর কর। মায়ের সেবা কর। আমার মতো মা-হারা হলে মায়ের জন্য দোয়া কর। দোয়ার সময় আমার মায়ের কথা মনে রেখ। আমিও দোয়া করি তোমার মায়ের জন্য। জগতের সব মাকে আল্লাহ সুখী করুন। খুশি করুন। দীর্ঘ হায়াত দিন। হায়াত শেষে বেহেশতের রানি বানিয়ে দিন। আমিন।