রমজানুল মোবারকের আজ ২৯ তারিখ। হতে পারে আজই এ মাসের শেষ দিন। রমজান আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চোখের পলকেই যেন কেটে গেল পবিত্র এ মাসটি।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যে রমজান পেল, অথচ নিজের গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না। প্রিয় নবিজির এ বদদোয়ার ভাগীদার যেন না হতে হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে।
পবিত্র রমজান ছিল তাকওয়া অর্জনের মাস। মহান আল্লাহ বলেন-হে ইমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া বা পরহেজগারি অর্জন করতে পার। (সুরা বাকারা : ১৮৩)।
পবিত্র এ মাসে আমরা কি পেরেছি রহমতের বৃষ্টিতে অবগাহন করতে, মাগফিরাতের সাগরে ভাসতে, আমরা কি পেয়েছি নাজাতের সুবাতাস?
আমরা কি পেরেছি মুত্তাকি হতে। আল্লাহর ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অপকর্ম, লোভ ছাড়তে পেরেছি কি?
রমজান এসেছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে সাধারণ ক্ষমা ও অশেষ প্রাপ্তির মাস হয়ে। রমজানের রোজা, তারাবিহ, সেহরি, ইফতার, ইতিকাফ, সদকাহসহ যাবতীয় সব আমলের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে আঁচল ভরে রহমত দান করেন।
এখন হিসাব মিলিয়ে দেখার সময় এসেছে এবারের রমজান থেকে আমাদের অর্জন কী কী? এ আশা কি আমরা করতে পারি যে আমরা খোদার দানের উপযুক্ত হয়েছি।
রমজান তো সহনশীল ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়। এ শিক্ষা কি আমরা গ্রহণ করতে পেরেছি, না রমজান আসা-যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল।
নিজেকে শুধরে নেওয়ার সময় ছিল রমজান। আমরা কি আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পেরেছি? অর্থাৎ লোভ-লালসা, গিবত, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, আত্ম-অহংকার, মিথ্যা বলা, কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত হতে পেরেছি?
আল্লাহতায়ালা প্রিয় বান্দাদের ভালোবেসে বিশেষ এ মাসটি উপহার দিয়েছিলেন, মহান রবের উপহার থেকে আমরা কতটুকু উপকৃত হতে পেরেছি, সে হিসাব মেলানোর এখনই শেষ সুযোগ।
প্রিয় পাঠক, রমজান আসে রমজান যায়। ভেবে কি দেখেছি কতটা ভরেছে আমার পাত্র? রমজানের পরিণতি কি কেবলই ঈদুল ফিতর। নাকি এরপরও কিছু বাকি থাকা উচিত। প্রতিটি ঈদের দিন আমাদের সবাইকে ভেবে দেখা জরুরি যে, আমলের ভিত্তিতে সত্যিই কি আমরা আনন্দ উদযাপনের অধিকার লাভ করেছি?
আল্লাহ বলছেন, তবে যারা তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয় (বাকারা ১৬০), অর্থাৎ তওবা করতে হবে এবং সেই সঙ্গে নিজেকে সংশোধনও করতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে রমজানের বরকত ও মাগফিরাত। অন্যথায় প্রভূত কল্যাণ নিয়ে প্রতিবছরের মতো রমজান আসবে, আবার চলেও যাবে, কারও কোনো লাভ হবে না।
রমজান মুসলমানদের জীবনে পরিবর্তন আনার মোক্ষম সুযোগ। তাই রমজানের পর পরিবর্তিত জীবনে ফিরে যাওয়াই রমজানের দাবি। কেননা রোজা নিছকই উপবাস থাকা, পানাহার ও কামাচার বর্জনের নাম নয়। এর বিশেষ তাৎপর্য ও দর্শন রয়েছে। রয়েছে এর দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপকারিতা।
মাহে রমজানের রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও অহংবোধ ভুলে গিয়ে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাসই হলো মাহে রমজান।
রোজা মানুষকে পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়।
রোজা মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণ, মিতাচার, মিতব্যয়িতা ও পারস্পরিক ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। রমজানে বিশেষ বিশেষ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে-সিয়াম সাধনা, তারাবিহ, রোজাদারকে ইফতার করান, ইতিকাফ, কুরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা, সহমর্মিতা প্রকাশ, শবেকদর অন্বেষণ, ওমরাহ পালনসহ বহু ইবাদতের বিধান রয়েছে। এ সবের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে সারা বছরই।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন ঈদুল ফিতরের দিন আসে, তখন আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের কাছে তাদের ব্যাপারে গর্ব করে বলেন, হে আমার ফেরেশতারা!
যে শ্রমিক তার কার্য সম্পন্ন করেছে, তার প্রতিদান কী হতে পারে? ফেরেশতারা জবাবে বলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! তার পারিশ্রমিক পুরোপুরি দেওয়া হচ্ছে। তখন আল্লাহ বলেন, হে আমার ফেরেশতারা! আমার যে বান্দা তাদের ওপর অর্পিত আমার ফরজ যথাযথভাবে পালন করেছে, অতঃপর তারা (নিজের ঘর থেকে ঈদগাহের দিকে) উচ্চৈঃস্বরে দোয়া করতে করতে বের হয়েছে-আমার ইজ্জত ও সম্মানের কসম, আমি নিশ্চয় তাদের দোয়া কবুল করব। তারপর তিনি বলেন, (হে বান্দারা!) তোমরা ফিরে যাও। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের পাপগুলোকে পুণ্য দিয়ে পরিবর্তিত করে দিলাম। রাসুল (সা.) বলেন, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে। (বায়হাকি)।
ঈদুল ফিতর মূলত রমজানের প্রশিক্ষণ কোর্সে সফলতা লাভের পুরস্কার। তাই হাদিসে এ দিনকে ‘ইয়াওমুল জায়িজাহ’ বা ‘পুরস্কার দিবস’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ঈদুল ফিতর আমাদের পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানায় যে, আমরা আমল ও আখলাকের এ প্রশিক্ষণ কোর্সে সত্যিই সফলতা লাভ করেছি কিনা?
এ বছরের মতো রমজান শেষ। অনেকেই গত রমজানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার ট্রেনিং নিয়েছেন। কিন্তু রমজান শেষ হতেই বন্ধ হয়ে গেছে সেই ধারা। অথচ এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। এক মাসের ট্রেনিং নিয়ে সারা বছর তা অব্যাহত রাখতে হবে এটাই রমজানের শিক্ষা। তাই নামাজের সঙ্গে থাকুন। কুরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা, সহমর্মিতা প্রকাশ অব্যাহত রাখুন।
প্রিয় পাঠক, রমজানের একবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি আমরা। এ মাসের সমাপনী আমল হলো সাদকাতুল ফিতর। দৈহিক ও আধ্যাত্মিক সাধনার সঙ্গে অর্থনৈতিক এ আমলও পূর্ণ করতে হবে। তারপর আসবে ঈদের উৎসব। মুসলমানদের ঈদ নিছক একটি উৎসবই শুধু নয়, এটি ত্যাগে ভাস্বর, অংশীদারত্ব ও সম্প্রীতির মহিমায় মহিমান্বিত।
আল্লাহতায়ালা সব রোজাদারকে সাদকাতুল ফিতর আদায়ের মাধ্যমে রোজার সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিন।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে রমজানের শিক্ষায় ‘শিক্ষিত’ হওয়ার তাওফিক দান করুন।
এ জীবনে বারবার ফিরে পেতে চাই রমজান। হে আল্লাহ আমাদের রোজাগুলো কবুল করে নিন।
হে আল্লাহ, ঈদ আনন্দ এ জাতিকে দান করুন বারবার। ঈদের খুশি ছড়িয়ে দিন জমিনজুড়ে।
সব রোজাদার ভাইবোনকে সালাম ও ঈদের শুভেচ্ছা
লেখক : গবেষক আলেম ও সেন্টার ফর এডুকেশন রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান