নাজাতের দশ দিন
রমজানের প্রশিক্ষণ কতটুকু অর্জন হয়েছে?
মুফতি তানজিল আমির
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫২ এএম
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান শেষ হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে রমজানের বাকি দিন কটিও অতিবাহিত হয়ে যাবে। এ সময়ে এসে আমরা যদি পেছনে ফিরে তাকাই, কতটুকু মর্যাদায় রোজা পালন করতে পেরেছি!
বলা হয়ে থাকে, রোজার কোনো সওয়াব নেই, কারণ রোজাদারের পুরস্কার মহান আল্লাহ নিজেই দেবেন। রোজাদারের জন্য আল্লাহ নিজে হয়ে যান মেজবান, আর মেজবান হন তার মেহমান। এজন্যই এ মাসটি আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত বরকতের মাস।
রমজানের বিশেষ নির্দেশনা সংযম পালন ও দানের মাধ্যমে অশেষ পুণ্য লাভেরও সুযোগ তৈরি হয়েছে।
রোজা মানে শুধু উপবাস নয়, ইসলাম ধর্মের প্রতিটি কাজের মতোই রোজার উদ্দেশ্য হলো-আল্লাহ এবং তার রাসূলের সন্তুষ্টি। সে সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে দেহ-মনকে একান্তভাবে প্রস্তুত করতে হবে একাগ্রতা দিয়ে, নিবিষ্টতা দিয়ে।
রমজান মূলত মুমিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস। এ মাসে প্রশিক্ষণ নিয়ে বান্দা নিজের মধ্যে মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটাবে। মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে এজন্য সৃষ্টি করেছি, যেন তারা আমারই ইবাদত করে।’ (সূরা যারিয়াত, আয়াত-৫৬)।
সদা সর্বদা বান্দা আল্লাহর পছন্দনীয় পথে চলবে, আল্লাহর হুকুমকে সর্বাবস্থায় মান্য করবে, এটিই মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি। কিন্তু নফসের প্ররোচনায় পড়ে মানুষ তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে যায়। নিজেকে সোপর্দ করে নফস ও শয়তানের হাতে। আত্মভোলা মানুষ যেন সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ভুলে না বসে, সে জন্যই রমজানের প্রশিক্ষণ।
রমজানুল মোবারক হচ্ছে আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের এক ঐশী উৎসব। দুনিয়ার সব অঞ্চলের সব শ্রেণির সব মুসলমান সমভাবে এ উৎসবে শরিক হন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, পণ্ডিত-মূর্খ, শাসক-প্রজা ও ধনী-গরিব সবাই ইহ ও পরকালীন কল্যাণ অর্জনের এ প্রতিযোগিতায় সমান উৎসাহী হন। মনে হয় যেন গোটা মুসলিম উম্মাহ শান্তি ও কল্যাণের স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময়তার এক বিস্তৃত শামিয়ানার নিচে ঠাঁই নিয়েছে।
বছরের ১১টি মাস মানুষ তার বৈষয়িক ব্যস্ততায় মনোনিবেশ করে, এ ব্যস্ততাই হয় তার সব মনোযোগের কেন্দ্র। ফলে তার অন্তরে আধ্যাত্মিক ক্রিয়া-কর্মে উদাসীনতার আবরণ পড়তে থাকে। রমজান মাসের ইবাদতে তা সরে যায়।
এক মাসের সিয়াম সাধনার মূল কথা হলো, পবিত্র এ মাসে মানুষ দৈহিক খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে আধ্যাত্মিক খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে এবং তার নফসের গতি মন্থর করে আধ্যাত্মিক পথচলার গতি বেগবান করবে। এভাবে দেহ ও আত্মা উভয়ের ভারসাম্য ঠিক হয়ে সে খাঁটি মুমিন বান্দা হয়ে উঠবে।
নবিজি (সা.) বলেন, ‘যে রোজা রেখেছে, অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি, তার কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিয়ামরত অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশালীন ও অর্থহীন কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়। কেউ যদি তাকে অশালীন কথা বলে কিংবা তার সঙ্গে অকারণে বাদানুবাদে লিপ্ত হতে চায় তবে সে যেন এ কথা বলে দেয়, আমি রোজাদার।’
তাই এ ইবাদতের মৌসুমে আমাদের দেহ-মনকে সিয়ামের মাধ্যমে পরিপাটি করে তুলতে হবে। ইবাদত ও পরোপকারের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে আত্মার বলিষ্ঠতা।
প্রিয় পাঠক! দেখতে দেখতে রমজান প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। রহমত, বরকত পেরিয়ে নাজাত বা ক্ষমার দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। মানুষ হিসাবে রমজানে আমাদের প্রাপ্তি কী?
এমন প্রশ্নের হিসাব মেলাতে গেলে প্রথমে পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটি দেখা যেতে পারে।
মহান আল্লাহ বলেন, হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পার। (সূরা বাকারা-১৮৩)।
বোঝা গেল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের রোজা ও রমজান দান করার উদ্দেশ্য হলো আমরা যেন মুত্তাকি হতে পারি। মুত্তাকি বলা হয়-সব অন্যায় কাজে আল্লাহর ভয় এতটা প্রবল হওয়া যে, এই ভয় তাকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।
এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারব। রমজান চলে যাচ্ছে আর আমরা কতটুকু মুত্তাকি হয়েছি? মানুষ ঠকানোর যে প্রতিযোগিতা, প্রতারণা, অহংকার, মিথ্যা, বাটপারি সর্বোপরি আমার, আমার বলে যে ধ্যান জ্ঞান তা থেকে কতটুকু পবিত্র হতে পেরেছি? দুনিয়ার মোহ থেকে আমরা কতটা বের হতে পেরেছি?
রমজানে কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলো মান্য করার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়। যাতে বাকি ১১ মাস মানুষ দ্বীনের ওপর সহজভাবে চলতে পারে। এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমগুলো পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে রমজানের প্রশিক্ষণ পূর্ণভাবে গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: গবেষক, আলেম ও সেন্টার ফর এডুকেশন রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান