Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

বইচা মাছের বৃত্তান্ত

Icon

ইমদাদুল হক মিলন

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বইচা মাছের বৃত্তান্ত

রব বয়াতিকে দেখে উচ্ছ্বসিত হলেন এনাম সাহেব। ‘আরে এসো এসো বয়াতি। জানলে কী করে আমি বাড়িতে এসেছি?’

বয়াতি হাসল। ‘হাশেম রে কইয়া রাখছিলাম, সাহেব আসলে আমারে য্যান খবর দেয়। কাইল বিকালেই ফোনে জানাইছে, আইজ আপনে আসবেন। ম্যালাদিন বাদে গ্রামে আইলেন।’

একতলা বাংলোর চওড়া বারান্দায় সুন্দর চেয়ার টেবিল পাতা। সেখানে বসে এনাম সাহেব বিকালের চা খাচ্ছিলেন। বাড়ি এসেছেন দুপুরের আগে। কেয়ারটেকার হাশেমকে বলা ছিল। হাশেমের বউয়ের রান্না খুব ভালো। পাবদা মাছ রান্না করেছিল। খেয়ে ভালো একটা ঘুম দিয়েছেন এনাম সাহেব। বিকালের নাশতা ছিল তিল মেশানো চাপটি। একেবারেই গ্রাম্য খাবার। গ্রামে এলে এ ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করেন তিনি। দুটো চাপটি খেয়ে চা নিয়ে বসেছেন। গেটের কাছে রাখা আছে গাড়ি। ড্রাইভার মফিজ গল্পবাজ মানুষ। হাশেমের ঘরের দাওয়ায় বসে গল্প জুড়েছে তার সঙ্গে।

এনাম সাহেব ইশারায় হাশেমকে ডাকলেন। বয়াতিকে চা-নাশতা দিতে বললেন। কখন সিগারেট ধরিয়েছেন খেয়ালই করেননি। চায়ে চুমুক দিয়ে বড় করে সিগারেটে টান দিলেন। ‘রাতে থাকবে না বয়াতি?’

গলায় ঝুলানো দোতরা খুলে দেওয়ালের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখল রব বয়াতি। বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসল। কথায় কথায় হাসার অভ্যাস তার। ঝিমকালো মুখে সাদা দাঁতের হাসি দেখতে ভালো লাগে। মানুষটা লম্বা চওড়া। মাথায় তেল চকচকে বাবরি চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। এনাম সাহেবের চেয়ে এক দুবছরের বড় হবে। তার এখন একষট্টি। চুল-দাড়ি সবই পাকা। বয়াতির পাকেনি একটিও। ঝুল পকেটওয়ালা সাদা ফুলহাতা শার্ট পরেছে। লুঙ্গিও সাদা। বহু দিন ধরে এই হচ্ছে তার লেবাস। বলল, ‘থাকতেই আইছি।’

বয়াতিকে চা-বিস্কুট দিয়ে গেল হাশেম। রাতে সে এই বাড়িতে থাকবে। তার সঙ্গেই খাবে। হাশেমকে তা বলে দিলেন এনাম সাহেব।

‘এখনো কি রানাদিয়াতেই থাক বয়াতি?’

এক মুঠ মুড়ি মুখে দিয়েছে বয়াতি। সঙ্গে এক চুমুক চা। খেতে খেতে বলল, ‘রানাদিয়া গ্রামটা নাই সাহেব। পদ্মায় ভাইঙা গেছে। ঘর দুইটা সরাইতে পারছিলাম। নাইলে বাড়িটুকুর লগে ঘর দুইটাও খাইত পদ্মায়। এখন থাকি হাইরাদি গ্রামে। রাস্তার ধারে সরকারি জমি। আমার মতো বহুত নদীভাঙা পরিবার ওইভাবে থাকে। মাইয়ার বিয়া দিয়া ফালাইছিলাম সাত-আষ্ট বছর আগে। পোলায়ও বিয়া করছে। আপনে দুইটা গরু কিনা দিছিলেন। ওই দুইটা থিকা অহন পাঁচটা হইছে। বাপে পোলায় মিলা গরু পালি আর মাছের কারবার করি।’

‘মাছের কারবার মানে? মাছ কেনাবেচা?’

‘হ, লৌহজং আড়ত থিকা মাছ কিনা হাইরাদি বাজারে নিয়া বেচি। ওই যে আপনে বিশ হাজার টেকা দিছিলেন, ওইটাই মূলধন। তয় পুরা টেকাটা নাই। কিছু ভাইঙা খাইছি। অহন হাজার দশেক আছে। তাও দুই চাইরশ টেকার কাম হয়। আবার কোনো কোনো দিন লোকসানও হয়। তার বাদেও আল্লাহয় ভালোই রাখছে।’

‘গান-বাজনা কইরা কিছু রোজগার হয় না?’

‘আরে না সাহেব, এখন কি আর বয়াতি গো গান শোনে লোকে! গেরাম তো আর গেরাম নাই। টাউন হইয়া গেছে। ঘরে ঘরে টেলিভিশন। চায়ের দোকানে টেলিভিশন। কত সিনেমা-নাটক। কত গান। ওই সব রাইখা আমগো লাহান বয়াতির গান কে শুনব? দোতরা ঘরেই পইড়া থাকে। আপনের কাছে আইছি দেইখা লগে লইয়াইলাম। আপনে আমার গান পছন্দ করেন।’

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলেন এনাম সাহেব। ‘শুধু গান না, তোমার সব কিছুই পছন্দ করি। তোমার কথাবার্তা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, সবই ভালো। ছোটবেলা থেকে তোমাকে দেখি। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে আমাদের জমিতে কাজ করতে। ক্লাস সেভেনে উঠে আমি চলে গেলাম ঢাকায়। একটা সময় পড়তে চলে গেলাম বিদেশে। ফিরে এসে শুনলাম, রানাদিয়া গ্রামে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে চলে গেছ তুমি।’

দু-তিন মুঠ মুড়ি খাওয়ার পর মুড়ি আর খেলো না বয়াতি। চায়ে চুমুক দিচ্ছে। ‘ঘরজামাই হইয়া গেছিলাম ঠিকই, তয় শ্বশুরবাড়ি থিকা তেমন কিছু পাই নাই। খালি ওই পাঁচ শতক জমিন দিছিল। ঘর দুইটা উঠাইছিলাম আমিই। সেই জমিন তো পদ্মায়ই খাইল। তারপরও আল্লাহয় রাখছে ভালো।’

‘এই এক গুণ তোমার। কোনো দিন তোমার মুখে শুনলাম না যে, তুমি খারাপ আছ। অভাবে থাকলেও মুখ ফুটে বলো না।’

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রাখল বয়াতি।

‘তবে তোমার একটা ব্যাপার ভালো লাগে না। আমার সামনে চেয়ারে বস না। মেঝেতে বস। পায়ের কাছে। এজন্য এখন আর তোমাকে চেয়ারে বসার কথা বলি না।’

বয়াতি আবার হাসল। ‘আপনের সামনে চেয়ারে বসা আমার শোভা পায় না। আমরা আছিলাম আপনেগ বাড়ির কামলা। ছোটবেলা থিকা গান-বাজনা করতাম দেইখা, আপনে আমারে একটু বেশি খাতির করেন। আমিও আপনেরে পছন্দ করি। সব সমায় যোগাযোগ রাখতে পারি না, তয় আপনের কথা রোজই একবার দুইবার মনে হয়।’

নিজে সিগারেট ধরিয়ে বয়াতিকেও একটা দিলেন এনাম সাহেব। লাইটার এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধরাও।’

বয়াতি হাশেমের ঘরের দিকে তাকাল। সেখানে আগের মতোই উঠোনে বসে গল্প করছে মফিজ আর হাশেম। হাশেমের মেয়েটি বছর দশকের। সে তার মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে।

বয়াতির ওদিকপানে তাকানোর অর্থটা এনাম সাহেব বুঝলেন। ‘তুমি ভাবছ, আমার ড্রাইভার আর কেয়ারটেকার যদি দেখে, তুমি আমার সামনে বসে সিগারেট টানছ, তা হলে তারা কী ভাববে, এই তো? ওদের ভাবাভাবিতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি আমার বন্ধুর মতো। সিগারেট ধরাও। কাউকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’

বিকাল ফুরিয়ে গেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে মাঠের ওপারে। সে দিকে তাকিয়ে এনাম সাহেব বললেন, ‘গ্রামে এলে ছেলেবেলার কথা খুব মনে হয়। এ বাড়িটার নাম সেই কারণেই ‘ছেলেবেলা’ রেখেছি। আজ দুপুরে এখানে আসার পর সেসব দিনের অনেক কিছু মনে পড়ছিল। এ বাড়িটার জায়গায় ছিল ধানখেত। দূরে-দূরে বিচ্ছিন্ন একেকটা বাড়ি। বর্ষাকালে প্রতিটা বাড়িই দ্বীপ। মাঠ-বিল পানিতে টইটুম্বুর। কোনো কোনো বছর বাড়ির উঠান-পালানে পানি। জ্যৈষ্ঠ মাসে শুরু হতো বৃষ্টি। তখন চার দিকে কত খাল। পদ্মার পানি আসত খাল ভাসিয়ে। আকাশ থেকে ঝরছে বৃষ্টি। জ্যৈষ্ঠ মাসেই ধীরে ধীরে ডুবতে শুরু করত মাঠঘাট। পানি নামত কার্তিক মাসে। কত মাছ ছিল গ্রামে।’

সিগারেটে টান দিয়ে বয়াতি বলল, ‘মাছের কথা আর বইলেন না সাহেব। খাল-বিল, পুকুরভরা মাছ। জষ্ঠি মাসে খালে পানি আইলে আর বৃষ্টি নামলে আমরা বলতাম, জোয়ার আইছে। খাল ভইরা যাওনের পর পানি ওঠে ধানখেতে, পাটখেতে। লগে ওঠে মাছ। পুকুর ভইরা গেলে পুকুরের মাছও উইঠা যায় খেতখোলায়। আমরা বলতাম ‘জোয়াইরা মাছ’। দিনে তো গিরস্থে মাছ ধরতই। রাইত্রেও বিল-বাঁওড়ে চইলা যাইত হারিকেন, জুতি আর টেঁটা লইয়া। কেউর এক হাতে টর্চলাইট, আরেক হাতে পলো। দুইটা-তিনটা বোয়ালমাছ এক লগে হইয়া খলবল খলবল করে। আমরা কইতাম বোয়ালমাছে ‘পির ধরছে’। পলো চাপ দিয়া ধরতে হইত বোয়াল। ছোট-বড় আরও কত পদের মাছ উঠত। আহা রে, কই গেছে গা সেই সব দিন! এখন তো বর্ষায়ই হয় না। বিলে-মাঠে পানিই উঠে না। খাল তো নাইই। খালের ওপর দিয়া রাস্তা হইয়া গেছে। গ্রাম কি আর গ্রাম আছে!’

বয়াতি ফুক ফুক করে দুবার সিগারেটে টান দিল। হাশেম এসে চায়ের কাপ, মুড়ির পেট এসব তুলে নিয়ে গেল। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পুব আকাশে ডিঙিনোকার মতো চাঁদ উঠেছে।

এনাম সাহেব হাশেমকে বললেন, ‘ফ্রিজে বরফ জমাতে বলেছিলাম, জমিয়েছ?’

হাশেম বিনীত গলায় বলল, ‘জমাইছি স্যার।’

‘বয়াতি থাকবে গেস্টরুমে। ড্রাইভার কোন রুমে থাকবে, তা তো তুমি জানই।’

‘সব জানি স্যার। এখনই কি ওইসব দিমু?’

‘আধা ঘণ্টা পর দাও। এখানেই দিও। বাড়ির গেট বন্ধ করে দাও। কেউ যেন না আসে।’

‘সন্ধ্যার পর কেউ আসব না স্যার।’

হাশেম চলে যাওয়ার পর এনাম সাহেব বললেন, ‘তখনকার বর্ষাকালগুলো ছিল অনেক লম্বা। প্রায় ছ’মাস দেশ-গ্রামে পানি কাদা থাকত। আশ্বিন মাসে চক-বিলের পানিতে পচন ধরত। পচা পানির গন্ধ পাওয়া যেত। যেমন জ্যৈষ্ঠ মাসে পাওয়া যেত নতুন পানির গন্ধ।’

বয়াতি বলল, ‘পানিতে পচন ধরলে শুরু হইত আরেক কারবার। চক-বিলের সব মাছ ভাইসা উঠত। আমন ধানের খেতে নলা-কাতলা, গরমা আর রুহিত, কালি বাউশ এসব মাছ পানির ওপরে মুখ তুইলা শ্বাস নিত। আমরা বলতাম মাছে ‘খাজা খায়’। সেই খাজার মাছ মারণের লেইগা কোষানাও, ডিঙিনাও লইয়া গিরস্থে যাইত চকে-বিলে। রইদের কী তেজ! সেই রইদে পুইড়া জুতি টেঁটা দিয়া মাছ ধরত। নৌকার ডরা ভইরা মাছ লইয়াইত বাড়িতে। জষ্ঠি মাসে এখন আর বোয়ালে পির ধরে না। আশ্বিন মাসে খাজাও খায় না মাছে। সেই দিনই নাই। সব বদলাইয়া গেছে।’

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বারান্দার টেবিলেই সব কিছু গুছিয়ে দিল হাশেম। পানির বোতল, বরফ আর হুইস্কির বোতল। এনাম সাহেব বোতল খুললেন। দুটো গাসে ঢেলে বরফ পানি মেশালেন। একটা গাস বয়াতির হাতে দিয়ে বললেন, ‘চিয়ার্স’। দুজনে একসঙ্গে গ্লাসে চুমুক দিলেন। একসঙ্গে সিগারেটও ধরালেন।

‘কত দিন পরে খাচ্ছ, বয়াতি?’

বয়াতি তার স্বভাব মতো হাসল। ‘বিদেশি জিনিস খাইতাছি অনেক দিন পর। দেশি জিনিস মাস দুই এক আধবার খাওয়া হয়। গ্রামে কিছু ভক্ত আছে আমার। জ্যোৎস্না রাইতে মাঝে-মাঝে আসর জমায় তারা। আমি দুই চাইরটা গান করি। তারাই খাওয়ায়।’

‘আমি দুদিন থাকব বাড়িতে। তুমিও থাক। রোববার সকালে আমি চলে যাব, তুমিও সে দিন যেও। অসুবিধা নেই তো?’

‘না না, কিয়ের অসুবিদা?’

‘তোমার মাছের ব্যবসা?’

‘ওইটা পোলায় দেখব নে।’

ছোট ছোট চুমুকে পান করার অভ্যাস এনাম সাহেবের। তিনি লক্ষ করলেন, বয়াতিও ঠিক সেভাবেই চুমুক দিচ্ছে। এ জন্যই লোকটাকে তার বেশি ভালো লাগে। কোনো কিছুতেই সীমা অতিক্রম করে না।

‘ছোটবেলায় দেখেছি, বর্ষাকালে সারা রাত বিলে তুমি তোমার বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে। সকালবেলায় সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে। মাছ ধরা ছেড়ে দিলে কবে?’

“বহুত দিন আগে ছাড়ছি, সাহেব। রানাদিয়ায় গিয়াও ওই দিককার বিলে মাছ ধরতাম। ‘বানা দেওয়া’ বোঝেন তো? লম্বা রশির মইধ্যে দুই হাত পর পর, দুই হাত লম্বা সুতার মাথায় বরশি ঝুলাইয়া দিতে হয়। কেউচ্ছা দুই পদের হয়। লাল আর সাদা। লালটা মাছে বেশি পছন্দ করে। সেই কেউচ্ছা গাঁইথা তিনটা রশিতে দেড়শ বরশি পাততাম। ওইটারে কয় ‘বানা দেওয়া’। ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা পর পর বানা তুলতাম। সারা রাইতে পাঁচ ছয়বার বানা তুলতাম। মাছ পাইতাম ভালোই। দিন চইলা যাইত। দিনে দিনে সব বদলাইয়া গেল। বিলে পানিই হয় না, মাছ আইব কই থিকা! তার পরই তো ধরছিলাম মাছ কিনাবেচার কারবার। আপনের কাছে গেলাম। আপনে টেকা দিলেন।

দুজনেই আবার গ্লাসে চুমুক দিল। সিগারেটে টান দিল।

এনাম সাহেব বললেন, ‘আশ্বিনের শেষ দিক থেকেই বিল-চক থেকে বর্ষার পানি নামতে শুরু করত। আমন ধানের ক্ষেতে হাতখানেক পানি। সেই পানিতে গুঁড়াগাড়ি অনেক মাছ পাওয়া যেত...’’

“হ সাহেব। ‘য়োচা’ দিয়া আমরা ওই হগল গুঁড়া মাছ ধরতাম। বিয়ানবেলা। ‘য়োচা’ চিনছেন?’’

এনাম সাহেব মাথা নাড়লেন। চিনতে পারেননি।

বয়াতি হাসল। ‘বেত দিয়া বানানো তিন কোনা একখান জিনিস...’

এনাম সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, “চিনেছি, চিনেছি। চিকন বাঁশের সঙ্গে গাঁথা থাকে। বাঁশটার মাঝখানে ধরে বাইতে হয়। গ্রামের লোকে বলে, ‘খ্যাও দেওয়া’।”

“এই তো আপনের মনে আছে। ‘য়োচা’ দিয়া মাছ ধরে পোলাপানে। গুঁড়াগাড়ি মাছ ছাড়া অন্য মাছ ধরন যায় না। গুঁড়া ইচা, অর্থাৎ চিংড়ি, পুঁটি, ট্যাংরা, ছোট ছোট বাইলা, টাকি, খইলসা, পোকা শিং অর্থাৎ শিংয়ের বাচ্চা, বাইনের বাচ্চা, পাবদা, ফলি মাছের বাচ্চা, ভেদার বাচ্চা এসব পাওয়া যাইত। তয় চান্দা পাওয়া যাইত অনেক...”

দুজনে আবার গাসে চুমুক দিল। সিগারেটে টান দিয়ে এনাম সাহেব বললেন, ‘ওই চান্দা মাছটার কথা আমার মনে আছে। ছোট ছোট সাদা রঙের মাছ। পেটের ভেতর কী আছে দেখা যায়, এমন স্বচ্ছ। মাছটা বেশ শক্ত ধরনের। ভুনা করলে খেতে খুব ভালো লাগত।’

“কিছু মাছ আছিল ওইগুলো মাইনষে খাইত না। ‘গুতুম’ মাছটা আছিল বাইঙ মাছের বাচ্চার মতন। একটা টাকি মাছের নাম আছিল ‘য়োকল টাকি’। এ মাছটা বড় হয় না। তয় কেউ খাইত না। কাইতলা মাছ বড় হইত। অনেক বাড়িতে সেই মাছও কেউ খাইত না।”

‘কাইতলা’ নামটা শুনে হাসলেন এনাম সাহেব। ওটার নাম “কাইতলা। অনেক পাজি মাছ ছিল। ওই মাছ নিয়ে ছোটদের সঙ্গে ঠাট্টা করত বড়রা। একবার আইয়ুবদাদার সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম হাওলাদার বাড়ির পুকুরে। আমার কাজ ‘ডুলা’ রাখা। আইয়ুবদাদা ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরছেন। কয়েকটা কাইতলা উঠেছে জালে। একটা মাছ আমাকে দিয়ে বললেন, লেজে ধরে নাড়া, দেখবি কাইতলা মাছে ডিম পাড়ব। আমি তাই করেছি। লেজে ধরে একটা নাড়া দিতেই মাছটা ঘুরে আমার আঙুল কামড়ে ধরল...”

বয়াতি শব্দ করে হাসল। হ, কাইতলা মাছে কামড় দেয়। লম্বা লম্বা দাঁত আছে। কোথায় হারাইয়া গেছে সেসব মাছ। এখন সব মাছই চাষ হয়। যেই কাইতলা মাছ মাইনষে ফালাইয়া দিত, সেই মাছ টেকা দিয়া কিন্না খাইতে হয়! ওই মাছ চাষ হয় কিনা জানি না। তয় পুঁটি, ট্যাংরা, এমনকি খইলসা মাছও চাষ হয় সেটা আমি শুনছি।

এক পেগ শেষ হয়েছে। দুজনের গ্লাসেই দ্বিতীয় পেগ ঢাললেন এনাম সাহেব। গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, “খলিসা মাছের কথায় মনে পড়ল। ‘বইচা’ নামে একটা মাছ ছিল না? আমরা মনে করতাম বইচা আসলে খলিসা মাছের বাচ্চা...”

বয়াতিও তার গ্লাসে চুমুক দিল। “না না, বইচা আরেক জাতের মাছ। ছোট ছোট। ভারী স্বাদের মাছ আছিল। অল্প কিছু দিন ওই মাছটা পাওয়া যাইত। এ ধরেন, সপ্তাহ দুয়েক। তা-ও পাওয়া যাইত আশ্বিন মাসের শেষ দিক থিকা কার্তিক মাসের প্রথম দিককার কয়েক দিন পর্যন্ত। আমন ধানের খেতের আইলে আইলে পাওয়া যাইত। ‘য়োচা’ আর ‘পেনিজাল’ দিয়া ধরতে হইত। পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ দিয়া চরচরি করলে ভারী স্বাদ লাগত খাইতে। সেই মাছটা আর নাই। কবে হারাইয়া গেছে!”

কোন ফাঁকে দোতরা হাতে নিয়েছে বয়াতি, এনাম সাহেব তা খেয়াল করেননি। এবার দোতরায় টুং টাং শব্দ করল বয়াতি। তাতে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলেন এনাম সাহেব। ‘গান ধর বয়াতি, গান ধর।’

রব বয়াতি গলা খাঁকারি দিয়ে গান ধরল। ‘উপর তালায় কোট কাচারি/মাঝের তালায় রয় ব্যাপারি/নিচের তালায় কর্মচারী/ ধ্যান করে প্রেমের মালা/ঘরখানা হয় তিন তালা।’

দেহতত্ত্বের গান। খুবই অর্থময়। শুনে মুগ্ধ হলেন এনাম সাহেব। ‘আরেকটা ধর বয়াতি। আরেকটা ধর।’

বয়াতি এবার ধরল আবদুল আলীমের গান। ‘আমারে সাজাইয়া দিও নশার সাজন/হইলে পরে মা গো আমার বিয়ার লগন/কাঁচা বাঁশের পালকি করে মা গো, আমারে নিয়ো...’

গান শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বয়াতি। ‘আইজকাইল এসব গান শোনে না। আমগ লাহান বয়াতি গো হইছে বইচা মাছের অবস্থা। শিক্ষিত লোকেরা বলে না, ‘বিলুপ্ত’। আমরাও বইচা মাছের লাহান বিলুপ্ত হইয়া যাইতাছি।’

বয়াতির কথা শুনে এনাম সাহেবও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম