তবুও জীবন অগাধ
ভালোবাসার মরমি দর্শনে সমৃদ্ধ
মেহেদী হাসান
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জীবনানন্দ দাশ কবিতা সম্পর্কে যে বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি, কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে। তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয় নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’
এ জন্যই কবিতা অনেক রকম, কবিতা অনেক বিষয়ের বাহক। প্রেম ভালোবাসা যেমন কবিতা বহন করে, আবার বিরহ-দ্রোহও কবিতা বয়ে বেড়ায়। এমন বৈচিত্র্যময় শিল্পগুণে সমৃদ্ধ একটি কাব্যগ্রন্থ কবি তানজিয়া সালমা’র ‘তবুও জীবন অগাধ’। এই বইতে শিল্পসমৃদ্ধ অনেক কবিতা রয়েছে। বেশিরভাগ কবিতায় জীবন-মৃত্যু, প্রেম-বিরহ এবং প্রকৃতি স্থান পেয়েছে। ‘অপার্থিব অনুভব’ শিরোনামের একটি কবিতার কিছু অংশ উল্লেখ করছি-
চাঁদ ছুঁয়েছে ব্যালকনিতে হাসনাহেনার মন/উদাস-হৃদয় গন্ধরাজের চিত্ত উচাটন,
মাতাল হাওয়ায় আলুথালু ঝুমকো জবার কেশ/গা এলিয়ে বাগানবিলাস আছেন সুখে বেশ।
মুচকি হেসেন গোলাপ-কলি বাড়ালো যেই হাত/জ্যোৎস্না-ঢলে ভেসে গেল নিকষ কালো রাত।
এখানে জীবন-মরণের এক ধরনের সুফিবাদি সুর আছে। আছে প্রকৃতি আর প্রাত্যহিক জীবনের কাব্যিক চিত্রায়ণ। মানব জীবনের একটা পূর্ণাঙ্গ ভাবনা ধারণ করে আছে এই ছোট্ট কবিতাটি। এখানেই কবির সার্থকতা। অল্প কথায় অনেক বেশি দার্শনিকতা ফুটিয়ে তোলা শক্তিমান কবির পক্ষেই সম্ভব। বইয়ের শেষের দিকে অণুকাব্য সিরিজের বেশ কয়েকটি ছোট ছোট কবিতা আছে। ছোট সে আকারে, কিন্তু এর গভীরতা এবং বিষয়বৈচিত্র্য মোটেও ছোট না।
‘অণুকাব্য-২’ শিরোনামের কবিতাটি উল্লেখ করছি-
তোমার আকাশ আছে আমার অতল এক নদী
অনন্ত বিরহ নিয়ে আমি বয়ে চলি নিরবধি,
দিগন্তে তোমার শেষ মোহনাতে আমি যাই মরে
ভালোবাসা হয়ে ফের এসো এই মানবী-অধরে।
এখনে নদীর বয়ে চলার মধ্যে প্রকৃতির এক অনিন্দ সুন্দর দৃশ্য ফুটে ওঠে। ফুটে ওঠে জীবন মৃত্যুর চিরন্তন সত্যটিও। এ দুটি বিষয়ের সাঁকো হিসাবে আমরা দেখতে পাই ভালোবাসাকেই। ভালোবাসায় বাঁচা-মরার এই আকুতিই পাঠকের কাছে তুলে ধরে মহৎ হৃদয়ের এক কবিকে। এই সিরিজের ছোট ছোট কবিতাগুলো অনেকটা মরমি ধাঁচের। আবার একই সঙ্গে ভালোবাসার দর্শনেও সমৃদ্ধ।
এই বইয়ের ‘কবি’ শিরোনামের কবিতাটি অসাধরণ-
যে আগুন আত্মাকে দহন করে প্রজ্বলিত হয়
সে আগুন থেকেই কবির জন্ম,
অন্তর্গত বোধে কবিকে ক্রমাগত পুড়তে হয়
বিষাদের বিশুদ্ধ বৈশ্বানরে।
যে জল হৃদয়কে বিধৌত করে নিত্য পুণ্যস্নানে
সে অশ্রুধারায়ই জন্ম কবিতার,
কবিতা তাই নিত্য বহমান এক ব্যথার জলধারা
আর কবি মাত্রই আজন্ম এক বেদনার হিমবাহ।
এ কবিতাটির কারণেই প্রথমে জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কিত কথাগুলো উল্লেখ করেছিলাম। কবিতা কি, কবিতাকে কীভাবে কবিতা হয়ে উঠতে হয় এর সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা এবং .... এ কবিতাটি আমাদের একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে পারবে।