বিএনপির বর্ধিত সভা যে বার্তা তৃণমূলে
নির্বাচনের মনোনয়নে গুরুত্ব পাবেন ত্যাগী ও জনবান্ধব নেতারা

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের ত্যাগী, জনবান্ধব ও ক্লিন ইমেজের নেতাদের গুরুত্ব দেবে বিএনপি। আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকে দলীয় নির্দেশনা মেনে যারা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তারা মনোনয়নে এগিয়ে থাকবেন এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একই সঙ্গে দলীয় শৃঙ্খলা মেনে নির্বাচনের প্রস্তুতির বার্তাও দিয়েছেন তিনি। এজন্য তিনি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি দ্রুত সময়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যে কোন্দল-দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে তা, দল ও দেশের স্বার্থে নিরসনে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও যারা দলকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে সুবিধা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাদের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত ও সুবিধাভোগীদের জায়গা হবে না বলেও নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের বর্ধিত সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে দলের বর্ধিত সভার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে নেতাকর্মীদের এসব বার্তা দেন তারেক রহমান।
বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা বলেন, আগামী নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে বিএনপি। এজন্য বির্তকিত, নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাভোগী-হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে বারবার সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। এসব নেতা যাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পান সেদিকে নজর দেবে বিএনপি। এখন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ থেকে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করলে জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফলাফল আসবে এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ নীতিনির্ধারকরা। এজন্য নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ ভুলে জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলীয় নেতাদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেছেন, দলকে যে কোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। খারাপকে দূরে সরিয়ে দিয়ে এলাকার মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। কেউ (নেতাকর্মী) যদি দলকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে চান, তখন বসে থাকা উচিত হবে না। মোকাবিলা করতে হবে। দলকে রক্ষা করতে হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে, নেতাকর্মীদের মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বস্তরের প্রতিটি নেতাকর্মীকে আরও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আচার-আচরণে হতে হবে আরও সতর্ক এবং সংযত। যারা দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণ হবেন, ব্যক্তির চেয়ে দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে, নিতে হবে। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ বা দলের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো কাজকে বিএনপি বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, বিগত ১৭ বছরের বেশি সময় বিএনপি ক্ষমতার বাহিরে। এই সময়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর অনেক অত্যাচার, নির্যাতন করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির নেতাকর্মীরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন এলাকায় গুটিকয়েক নেতা দলকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তারা সুবিধাভোগী। ফ্যাসিস্টদের সঙ্গেও তারা আঁতাত করে বিএনপিকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছেন। এখন সময় এসেছে তাদের শনাক্ত করার। বিতর্কিত ও ওইসব সুবিধাভোগীদের দল মনোনয়ন দেবে না। বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতারা ক্লিন ইমেজ, জনবান্ধব ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের কথা বলেছেন। ত্যাগীদের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা আশা করি, আন্দোলন-সংগ্রামে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং জনগণ ও ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য তারাই মনোনয়ন পাবেন।
বিএনপির বর্ধিত সভায় অংশ নেওয়া তৃণমূলের একাধিক নেতা প্রায় একই সুরে বলেন, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতা বক্তব্য দেন। তাদের বৈঠকে বেশিরভাগই দলীয় গ্র“পিং নিরসন ও নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানান। আগামী নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে এলাকায় দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং চরমে। বিগত সময়ে আন্দোলনে ছিলেন না, বিতর্কিত ও ফ্যাসিস্টের সুবিধাভোগী এমন নেতাও মনোনয়নের জন্য এলাকায় যাচ্ছেন। এতে দলের মধ্যে বিভক্তির আশঙ্কা রয়েছে। বিতর্কিত ও নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাভোগী ওইসব নেতা যাতে দলীয় মনোনয়ন না পান সেজন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও এই বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আগামীতে ওই সব সুবিধাভোগীদের স্থান বিএনপিতে হবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা বলেছেন। এছাড়া তিনি আগামী নির্বাচনের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। বিএনপি সরকারের আমলে ইতিবাচক দিক ও সাফল্যগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরার বিষয়েও জোর দিয়েছেন।
বর্ধিত সভা থেকে কি বার্তা দিল বিএনপি? এ প্রসঙ্গে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, অতীতে আন্দোলন, লড়াই-সংগ্রামে যে প্রত্যাশাগুলো ছিল, সেগুলোকে পুনরায় উপস্থাপন করা। একই সঙ্গে দলের মধ্যে কেউ কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে, দলকে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করলে, তাদের কোনোভাবেই ছাড় না দেওয়া। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা যারা বলে তারা গণতন্ত্রকে সংকুচিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এছাড়া নেতাকর্মীদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে মন কষাকষি বা অন্য যা কিছুই থাকুক না কেন, তা মিটিয়ে ফেলে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। না পারলে দলের ও দেশের অস্তিত্ব নিয়েও সংকট দেখা দেবে। বিএনপি কোনো সংকটে পড়তে চায় না, এজন্য নেতাকর্মীদের সতর্ক করা। সামনে জাতীয় নির্বাচন এজন্য দলীয় শৃঙ্খলা মেনেই নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকবে বিএনপির সব পর্যায়ের নেতাকর্মী।
জানতে চাইলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু যুগান্তরকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন ঐক্যের বিকল্প নেই। ৫ আগস্টের পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে দ্বন্দ্ব ও বিভেদ দেখা দিয়েছে, সেগুলো ভুলে গিয়ে এই মুহূর্তে আমাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হবে। আওয়ামী দুঃশাসনের সময় অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে আমরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সবাই এক ছিলাম, এখনো সেই ঐক্য ধরে রাখতে হবে। আগামী নির্বাচনও ঐক্যবদ্ধভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই যার যার এলাকায় নির্বাচনি কাজগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া হাইব্রিড নেতারা, যারা ৫ আগস্টের আগে বিএনপিতে ছিলেন না, তারা নতুন করে বিএনপিতে এসে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। এই বিষয়গুলোতে সতর্ক থাকার বিষয়ে নেতাকর্মীরা কথা বলেছেন।
বাগেরহাট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, তৃণমূলে এখন যে সমস্যাগুলো আছে তা আমাদের সমাধান করার বার্তা দিয়েছেন তারেক রহমান। যাতে সাধারণ মানুষের আস্থা আমাদের ওপর আরও বাড়ে। সব পর্যায়ে ঐক্য রাখতে হবে। যে কোনো ষড়যন্ত্র আমরা যেন মোকাবিলা করতে পারি। আগামী নির্বাচনে কেউ যেন বিভ্রান্ত করতে না পারে। দল ও জনগণের মধ্যে ঐক্য গড়ার বার্তা ছিল। দলের নির্দেশনা ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে তিনি আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির বার্তা দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচনি কার্যক্রম চালাব।