নাগরিক ঐক্যে চা-চক্রে বক্তারা
রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ঐক্যমতের বিকল্প নেই

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:২২ পিএম

দেশের চলমান পরিস্থিতি ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে। গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার প্রথম ধাপ নির্বাচন। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থাণের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করা সম্ভব হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান অনেক বিপ্লবী সৃষ্টি করেছে। এখন রাজনৈতিক ঐক্য করতে কোনো ফ্যাসিবাদ বাধা দিলে তাদেরকেও প্রতিহত করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘সংকট থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক ঐক্যমতের বিকল্প নেই’ শীর্ষক চা-চক্রে বক্তারা এসব কথা বলেন। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এই চা-চক্রের আয়োজন করেন।
বক্তারা বলেন, বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম ও জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের আন্দোলনের মধ্যে বড় একটা সর্ম্পক রয়েছে। সবাই ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার এক লক্ষ্য থাকার কারণে শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত করা গেছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্রুত সময়ে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। অন্যস্থায় বিপ্লব বেহাত হতে পারে। কারণ, নির্বাচন কেন্দ্রীক সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত সময়ে নির্বাচন দিতে বিলম্ব করলে ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরা নানা ষড়যন্ত্র অব্যহত রাখবে। বর্তমানে দেশে একটা সংকট রয়েছে, এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য করতে হবে। দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সকলকে একটা ‘সমঝোতা পরিষদ’ গড়ার কথাও বলেন তারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৬ মাসে কী কী কাজ করছেন তার একটা স্বেতপত্র প্রকাশেরও দাবি জানান বক্তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের শপথ নিয়েছে। তার মেয়াদ কত হবে সেটা দেওয়া নেই। নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে, নির্বাচন কমিশন যতই নিরপেক্ষ বলুক, সেটি কিন্তু ঠুনকো জগন্নাথ। এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখন ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেছে, তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য করতে হবে। কাউকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সংবিধান নিয়ে বেশি বিরোধ নেই, আমি দেখেছি, আলী রীয়াজ সাহেব পাঠিয়েছেন। তবে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান তুলনা করা ঠিক হবে না। ফ্যাসিবাদী বিরোধী জাতীয় ঐক্যটাকে সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কারণ নিজেদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যমত না থাকার কারণে অনেক দেশে বিপ্লব হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, যদি আমরা রাজনৈতিক ঐক্যটা ধরে রাখতে পারি তাহলে এটাকে শক্তিতে পরিণত করতে পারব। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য হয়েছে, এখন এটাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে হবে।
তিনি বলেন, পতিত স্বৈরাচাররা লুটপাট করে প্রচুর অর্থ নিয়ে পাশের দেশে বসে আছে। সেখানে বলে ষড়যন্ত্র করছে, ভাষণ দিচ্ছে। আমাদের তরুণরা এই যে প্রতিবাদ করছে, আমি মনে করি এই মুর্হুতে এটা দরকার ছিল না। পতিতরা বাংলাদেশের মধ্যে একটা তৎপরতা চালাচ্ছে, যাতে আমাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা যায়, অস্থিরতা সৃষ্টি করা যায়। এর মধ্য দিয়ে তারা ফায়দা নিতে চায়। এইটুকু বুঝতে পারলেই আমাদের মধ্যে ঐক্য হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা দেখেছি, আন্দোলনের পর একটা মার্শাল ল’ আসে। সেটি পাকিস্থান আমল থেকে দেখে আসছি। আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে নির্বাচন দিলে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এবারের আন্দোলন কিন্তু ভিন্ন, আমরা সবাই নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ২৪’ এ ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আলো দেখেছি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের অ্যাসেট। উনাকে পেয়ে আমরা গর্বিত। কিন্তু এখন সরকারের পথ চলা ভিন্ন দেখছি। স্বল্পকালীন সরকারের জন্য এত বড় ক্যানভাস করা প্রয়োজন ছিল না। শেখ হাসিনা তো ১৫ বছরে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে অন্তর্বতী সরকারের উচিত ছিলো নির্বাচনমুখী হওয়া। আমরা সরকারে সংস্কার প্রতিবেদন গুলো ফেলে দেয়ার কথা বলছি। এগুলো নিয়ে ভাবছি। শেখ হাসিনার পতনের পর কেউ আগের মতো দেশ চালাবে, এটা ভাবা যায় না। আমরা নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ চালাবো। যত সমস্যার একমাত্র সমাধান নির্বাচন।
সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয় নির্বাচনে। নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে, বিএনপির ফলাফল তত ভালো হবে। তাদের কাছে অনুরোধ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলে তারা যেনো সংস্কার গুলো ঠিক মতো করে। একই সঙ্গে সতর্ক চোখ রাখতে চাই, তারা যেনো ভুল না করে। এজন্যই ঐক্য দরকার। তিনি বলেন, আগস্টের পর অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেই সাথে চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ঐক্যমতের বিকল্প নেই। ঐক্যমতের মাধ্যমে সব সম্ভব। জাতীয় ঐক্যমতের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের নিরপেক্ষাতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে কিন্তু সরকার হোচট খাবে। ইতোমধ্যে এই সরকারের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার অদলীয় নাকি নিরপেক্ষ সরকার? বিশেষ কোনো আইডিওলজি, বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্রদের প্রতি যদি পক্ষপাতীত্ব কাজ করে তাহলে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারের নিরপেক্ষতা যদি প্রশ্নবিদ্ধা হয়, তাহলে আগামীতে এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন বড় আকারে আসবে। এই সরকারের নিরপেক্ষতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে তাহলে আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলো তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলবে কিনা সেটা জানি না। কিন্তু আমি দেখতে চাই, সরকার সফল হবেন। কার্যকর হবেন। তাদের মধ্যে যে এক দিকে ঝুকে পড়ার প্রবনতা, সরকার ও দেশের জন্য ভালো লক্ষ্যন না। অব্যাহত সমঝোতা জন্য নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। আমি চাইবো সরকারের নিরপেক্ষ বৈশিষ্টা অক্ষুণ্ণ রাখবেন। যাতে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না তুলতে হয়। আমরা সরকারকে সফল করতে চাই, কার্যকর করতে চাই। আমরা সহযোগীতা যোগাতে চাই। আপনারা জানা-অজানা কোনো এজেন্ডা নিয়ে কাজ করবেন না। আপনার যে দেশ চালাতে পারছেন না এটা দেশের মানুষ জানে। কিন্তু তারপরও আমরা সমালোচনা করি সরকার যেনো সঠিক পথে থাকে।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, জাতীয় নেতৃত্বে বের করতে ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিন। এতে করে নেতৃত্বে বের হয়ে আসবে। ক্ষমতার পেছনে না ঘুরে। এখন আমাদের ভেতরে কথার ফুলঝুড়ি উঠেছে। কোনো ঐক্যমত নেই। যত দিন যাচ্ছে সব কিছু ঝুলে যাচ্ছে। তাই সরকারকে বলি, বেশি বেশি সংস্কারের কথা বলে, কুসংস্কার করবে না। যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। না হলে মঈন উদ্দিন ফখরুদ্দিনের মতো পালাতে হবে। এখন তো দেখি সরকার থেকে কিংস পার্টি করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে, যেটি ব্যাবহার করে এক দলীয় বা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। সেটির বিলোপ করতে হবে। ৭২ সংবিধান হাত ধরে আওয়ামী লীগ বারবার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান একটা বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মানুষের নতুন স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। ৭২ সংবিধানের একদলীয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রতারণা, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার যন্ত্র। যেটাকে পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। বর্তমানে মানুষের অধিকারের আন্দোলনকে সামনে রাজনৈতিক সংকট হতে পারে বলে বাধা দেওয়া যাবে না।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ৭১ কে বাদ দিয়ে কিছু করতে দেয়া হবে না। কেউ বলে মহান গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলে বিপ্লব? কিন্তু বিপ্লব ও মহান অভ্যুত্থান আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়নি, স্বাধীন হয়েছে ৭১ সালেই।