Logo
Logo
×

রাজনীতি

আ.লীগবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে জয়ী হয়েও হতাশ যারা

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩০ পিএম

আ.লীগবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে জয়ী হয়েও হতাশ যারা

ফাইল ছবি

বাংলাদেশে বামদলগুলোতে তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি ধারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে, আরেকটি বিএনপি ধারার সঙ্গে আন্দোলন ও ক্ষমতার অংশীদার হতে আগ্রহী এবং অন্যটি এই দুই ধারার মাঝামাঝি বা কোনোটিতে নেই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে দলমত-নির্বিশেষে লাখো জনতা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল। এক অভূতপূর্ণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন হয়।

সেই আন্দোলনে কিছু বামদলও ছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী রাজপথে সরব থাকা বামদলগুলো হলো-  ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’, ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’, ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’ এবং ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা’সহ বাম ঘরানার আরও একাধিক রাজনৈতিক জোট। 

আওয়ামী লীগবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে জয়ী হয়েও হতাশ তারা। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারলেও এখন স্বস্তিতে নেই তারা। টিকে থাকার লড়াই দেখা গেছে তাদের মধ্যে।

বামদলগুলো নিজেদের শক্তির বিষয়ে অবগত। কোনো বামদলই দাবি করতে পারবে না যে তাদের নিজস্ব শক্তি দিয়ে সংসদে একটি আসন পেতে পারে।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, সাম্যবাদী দল (এমএল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-রেজাউর), কমিউনিস্ট কেন্দ্রসহ বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের মধ্যে বড় একটি অংশ ১৪ দলীয় জোটের ব্যানারে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। গত ৫ আগস্ট জোটের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর অবস্থা দেখে এরা হতাশ। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতো নিজেরাও এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। দলগুলো মাঠে টিকে থাকার পথ খুঁজছে।

১৪ দলীয় জোটভুক্ত বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের বাইরে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’, ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’, ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’ এবং ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা’সহ বাম ঘরানার আরও একাধিক রাজনৈতিক জোট ও দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী রাজপথে সরব এবং সক্রিয় ছিল। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারলেও এখন স্বস্তিতে নেই তারাও। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে পারছে না এই দলগুলোর শীর্ষনেতারা। বিশেষ করে সরকারের তরফ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত না হওয়ায় হতাশ তারা। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিসহ জনজীবনের সমস্যাগুলো লাগামহীন গতিতে বাড়তে থাকায় বিক্ষুব্ধ বামপাড়ার এসব জোট ও দলগুলো।

এ প্রসঙ্গে দেশের প্রবীণ বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে সমাজতন্ত্র অভিমুখী সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা আগাগোড়াই নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে অগ্রসর হয়েছি, এখনো হচ্ছি। আমরা মনে করি আওয়ামী ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একদিনে কিংবা কোনো মাস্টারমাইন্ডের কারণে মাত্র দুই মাসে হয়নি। এই সংগ্রাম ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে এবং এই আন্দোলনের মূল মাস্টারমাইন্ড দেশের জনগণ। সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ভূমিকা রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তাদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে অসন্তোষ বাড়িয়েছে। কারও জীবনের নিরাপত্তা নেই। চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুন, রাহাজানি, মাস্তানি, জবরদখল বাড়ছেই। নির্ভয়ে মানুষ ঘর থেকে বের হতেও পারছে না। একইভাবে বাজার পরিস্থিতি কোনোভাবেই এই সরকার সামাল দিতে পারছে না। বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট আরোপ করে সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। বেশকিছু আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে, কিন্তু এরপরও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। বরং সরকারের কারও কারও অতিকথন, ছাত্রদের অতিকথন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তিনি আরও বলেন, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার এখন পর্যন্ত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। আগে সংস্কার, আগে বিচার, এরপর নির্বাচন এসব কথা কেউ বলছেন। আমরা মনে করি সংস্কার, বিচারিক প্রক্রিয়া যেমন অব্যাহত থাকবে। তেমনি নির্বাচনি প্রক্রিয়াকেও এগিয়ে নিতে হবে। বামপাড়ার দলগুলোর বিষয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন তোপখানা, পুরানা পল্টন, সেগুনবাগিচা এবং গুলিস্তান-এই চার এলাকা ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘বামপাড়া’ বলে বিবেচিত। নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলিয়ে দেশের প্রায় অর্ধশত বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এই এলাকায়। এদের মধ্যে চারটি দল স্থায়ী কার্যালয়ে, বাকিরা সবাই ভাড়া বাড়িতেই অফিস বানিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। শুধু তাই নয়, তোপখানা, পুরানা পল্টন, সেগুনবাগিচা এবং গুলিস্তান-বামদলগুলোর যাবতীয় কর্মকাণ্ড, সভা-সমাবেশ এই এলাকার মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে সীমাবদ্ধ। মুক্তাঙ্গনে এক সময় তারা সরব থাকলেও এখন সরব জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। সীমিত শক্তি এবং সামর্থ্য নিয়ে কমবেশি প্রতিদিনই এরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, ১৪ দলীয় জোটের শরিক বামদলগুলোর বাইরে বাম ঘরানার আরও চারটি জোট রাজনীতির মাঠে পুরোমাত্রায় সক্রিয়। এই চারটি জোটের শরিকরাই বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী রাজপথে সক্রিয় ছিল। এদের মধ্যে তিনটি জোট বিএনপির সঙ্গে যুগপৎভাবে, একটি জোটের শরিকরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। বহুধাবিভক্ত এই বামদলগুলো দেশে ‘বাম বিকল্প শক্তি’ হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা সফল হতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ বিরোধ আর মতদ্বৈধার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় দুই বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে, ক্ষমতার মোহগ্রস্ত হয়ে বারবার খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে, ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান ও আকর্ষণ-দুটোই হারিয়েছে বামপাড়ার অধিকাংশ দল। বামপাড়ার এই দলগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর এই জোট এবং জোটের শরিক বাম ঘরানার দলগুলোর ‘অস্তিত্ব’ রক্ষা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে কোনো কোনো শরিক বামদলে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এই মুহূর্তে জোটের সব দলই নিজেদের রাজনৈতিক ‘সত্তা’ টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ লড়াইয়ে। ‘গণরোষের ভয়ে’ কোনো দলই নামছে না মাঠের কর্মসূচিতে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী পাঁচ মাস এসব দল রাজনৈতিকভাবে কার্যত বিচ্ছিন্ন এবং নিষ্ক্রিয়, অনেকটাই ছন্দহারা। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আচমকা ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই ধুঁকছে। বাম ঘরানাসহ জোটের অন্য শরিক দলগুলোর ভাগ্যেও নেমে এসেছে বিপর্যয়। এরই মধ্যে জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু জুলাই-আগস্টে সংঘটিত একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়ে কারাবন্দি। দুর্নীতি-লুটপাটসহ নানা অভিযোগ ওঠায় এ দুই সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হয়ে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষনেতাসহ দেশের বেশির ভাগ নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় আমাদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বৈরী পরিবেশে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক সরকারের শাসনামলেও আমরা আমাদের দলীয় কর্মকাণ্ড নিজেদের মতো করে অব্যাহত রেখেছি। অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় আগের মতোই জাসদ অবদান রাখবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম