Logo
Logo
×

রাজনীতি

মায়ের স্পর্শে তারেক রহমান, এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি

আতাউর রহমান

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৩৮ পিএম

মায়ের স্পর্শে তারেক রহমান, এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি

গুনে গুনে সাড়ে সাত বছরের বেশি সময়ের অপেক্ষা। প্রতীক্ষার প্রহর যেন ফুরোয় না। একজন মানুষের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে আপনজন মা; তার জন্য এতো সময় অপেক্ষা...ভাবা যায়! অবশেষে মায়ের ছোঁয়া পেলেন তারেক রহমান। এ এক অন্যরকম স্পর্শ।  মা-ছেলের ভিন্ন রকমের মিলন। স্বর্গীয় অনুভূতি। যেটি কোনো ভাষায়, ছন্দে কিংবা পংক্তিতে প্রকাশ করা যায় না।

সত্যিই এই আবেগ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এই সাড়ে সাতটি বছর কীভাবে যে কেটেছে দুজনের। ছেলেকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন খালেদা জিয়া। চলৎক্ষমতা থাকলে হয়তো দাঁড়িয়েই বুঁকে জড়িয়ে ধরতেন। চলাফেরার অবলম্বন হুইল চেয়ারে বসেই তারেক রহমানকে বুকে টেনে নেন। চৈত্রের ক্ষরাক্লিষ্ট ভূমি যেমন বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে সঞ্জীবনী শক্তি ফিরে পায়; নিশ্চয়ই তারেক রহমানের মনেও আজ একই অবস্থা। এতোদিন পর মায়ের ছোঁয়া-আবেশ পেয়ে হৃদয়ে খুশির জোয়ার বইছে। মা-ছেলের পুনর্মিলের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী যারা তাদের চোখের কোনে অজান্তেই পানি এসে যায়। এটি আনন্দাশ্রু। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদার রহমানও। যিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জীবন সংগ্রামের জীবন্ত ডায়েরি।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনের স্থানীয় সময় বুধবার সকালে ৯ টার (বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টায়) পরপর হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমান।

কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে খালেদা জিয়া লন্ডনে পৌঁছান। টার্মিনালে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার হযরত আলী খান।


এরপর পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান খালেদা জিয়ার পা ছুঁয়ে সালাম করেন। শাশুড়ি-পুত্রবধূর মাঝে কিছু সময় ভাব বিনিময় হয়।  তারপর তারেক রহমান মায়ের হুইল চেয়ারের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেন। তখন সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে মা-ছেলের পুনর্মিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ উপভোগ করেন ডা. জোবাইদা রহমান।

খালেদা জিয়ার সঙ্গেই লন্ডনে গেছেন তার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দ শামিলা রহমান সিঁথি। দুই পুত্রবধূ ও ছেলের সঙ্গে দলের কয়েকজন নেতাকর্মী এ সময় ছিলেন। ছিলেন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

২০০৭-০৮ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খড়গ নেমে আসে জিয়া পরিবারে। খালেদা জিয়ার মত তার বড় ছেলে তারেক রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে কারাগারে নির্যাতন করে পাজরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান, দেশে আর ফিরতে পারেননি।  এর মধ্যে পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারেক রহমানকে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু আর মায়ের কারাগারে যাওয়ার মত দুঃসময়েও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। তার মতো ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার আর কজন রাজনীতিক আছেন! যিনি কিনা স্নেহের আপন ছোটভাইয়ের লাশটি দেখার সুযোগ পাননি-তার কবরটি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।  

খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলে কেবল তখনই মায়ের স্পর্শ পাওয়ার সুযোগ হত তারেক রহমানের। সবশেষ সে সুযোগ হয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। সেবার নিজে গাড়ি চালিয়ে মাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আজও হিথ্রু বিমানবন্দর থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে মাকে নিয়ে লন্ডন ক্লিনিকে নিয়ে যান তারেক রহমান। কালো রঙের জ্বিপ গাড়িতে সামনের সিটে ছিলেন জোবাইদা রহমান। আর পেছনের সিটে ছিলেন খালেদা জিয়া ও সিঁথি। 


এবার খালেদা জিয়াকে বিমান থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে করে যখন টার্মিনালে নেওয়া হল, তার সামনে থমকে দাঁড়ান তারেক। হাঁটু গেড়ে বুকে জড়িয়ে নেন মাকে। এই দৃশ্যের স্বাক্ষী যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক বলেন, ‘এ যেন এক অন্যরকম স্পর্শ, অন্য রকম মুহূর্ত যা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। যিনি মায়ের স্পর্শ অনেকদিন পাননি, তিনিই বুঝতে পারবেন এর আবেদন। ‘

আশি ঊর্ধ্ব একজন রাজনীতিকের জীবনে আপনজনদেরকে কাছে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছিল না। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। অসুস্থ হয়েছেন বারবার; চিকিৎসাটুকুও দেওয়া হয়নি।  সন্তান-পুত্রবধূ-নাতনিকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে রাখা হয়েছে। কাছে ভিড়তে দেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার মতো জুলুমের শিকার নারী রাজনীতিক পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন আছে কিনা ভেবে দেখতে হবে। যিনি অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। গৃহবধূ থেকে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম করে আপোষহীন নেত্রীর উপাধি পেয়েছেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার বারবার দেশত্যাগের চাপ দিলেও জনগণের কথা ভেবে দলের নেতাকর্মীদের কথা ভেবে যাননি। অথচ জীবন সায়াহ্নে চিকিৎসার বিদেশে যাওয়ার জন্য বারবার আবেদন করেও সেই অধিকারটুকু দীর্ঘকাল পাননি। গণতন্ত্রের জন্য বিএনপি নেত্রীর দীর্ঘ সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।    

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি মামলায় সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ কারাভোগের পর ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয়। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসা আর হাসপাতালের জীবনে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য বার বার অনুমতি চাইলেও তাতে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার।

এবার খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাত্রা রাজনৈতিক অঙ্গনে ভিন্ন আবহ তৈরি করেছে। হাসিনা পতনের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় খালেদা জিয়ার প্রয়োজনীয়তা যে কতটুকু তা বলে বোঝানো যাবে না। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ সবাই উপলব্ধি করেছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি, অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না।  

১৯৮২ সালে ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া দলে প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়ে গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮৩ সালে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, ১৯৮৪ সালে ১২ জানুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও একই বছরে ১ মে চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পান। এরপর থেকে ‘স্বৈরাচারের সঙ্গে কোনো আপস নয়’ এই নীতিতে অটুট থেকে ৯ বছর এরশাদবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যান। এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে যাননি তিনি। ওই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে। বেশিদিন টিকতে পারেননি তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়। পরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর ২০০১ সালের আবারও ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দলটি। ২০০৭ সালে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগ বয়কট করলে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেশজুড়ে শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। এর প্রভাবে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ১১/১ সরকার আবির্ভাব ঘটে। দুর্নীতির দায়ে সপরিবারে খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হয়। পরবর্তীতে জামিনে মুক্তি পান । দুই ছেলেকে বিদেশে চলে যেতে হয়। বড় ছেলে তারেক রহমান এখনও দেশে ফিরতে পারেননি। আরেক ছেলে আরাফাত রহমান কোকো বিদেশের মাটিতেই মারা গেছেন।

৮০ বছর বয়সি খালেদা জিয়া ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার এমন একজন রাজনীতিক যিনি রাজনীতি করার কারণে গণতন্ত্রের পক্ষে থাকার কারণে বারবার নিগৃহীত হয়েছেন। স্বামীর স্মৃতি বিজরিত বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। শেষ বয়সে জেল খেটেছেন। সুচিকিৎসা পর্যন্ত পাননি। যে বয়সে মানুষ সন্তান-আত্মীয় পরিজন নিয়ে সময় কাটান সেই সময়ে তাকে একাকি সময় কাটাতে হচ্ছে। ছেলে-পুত্রবধূ-নাতনিকে থাকতে হয়েছে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে। দেশে আসতে দেওয়া হচ্ছে না তাদের। খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমান যার বাবা জিয়াউর রহমান স্বাধীন দেশের জন্য সম্মখ সমরে লড়াই করেছেন দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন তাকে আজ দেশে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। যার বাবা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভূ-খন্ড সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন স্বাধীন দেশে সেই তারেক রহমানের মাথা গোজার কোনো ঠাঁই নাই।

খালেদা জিয়া সন্তান তারেক রহমানকে সঙ্গে করেই নতুন বাংলাদেশে ফিরবেন এমন প্রত্যাশা দলটির নেতাকর্মীদের। 

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম