গণহত্যা আড়াল করতে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি সামনে আনছে সরকার: মির্জা ফখরুল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৭:২২ পিএম
ফাইল ছবি
গণহত্যাকে আড়াল করতে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের বিষয়টি সরকার সামনে আনছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, সরকার একটার পর একটা ইস্যু তৈরি করে। আর ইস্যু তৈরি করে ভিন্নদিকে নিয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের বিষয়টি এখন আবার আরেকটা প্রজেক্ট। সরকার আবার বাকশাল কায়েক করতে চায়।
তিনি বলেন, আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন বাম রাজনীতি যারা করতেন, তারা সব দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ভারতে প্রায় দুই বছর থেকে যখন প্রত্যাহার করা হলো তারা আবার দেশে ফিরে আসেন। যারা স্বৈরাচারী, যাদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত বহু নিয়েছে। এসব তাদের নিতে হয়। কেন এতদিন তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়নি? আজকে এখন নিচ্ছে কেন? এজন্য তাদের অনেক যুক্তি থাকবে, অনেক কথা তারা বলবে। আমরা যে কথাগুলো বলছি, এসব নিয়েও তারা অনেক কথা বলবে। তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা খুব পরিষ্কার করে বলি- আমরা বিশ্বাস করি যারা রাজনীতি করে, তাদের অধিকার আছে রাজনীতি করার। এখন জনগণের দায়িত্ব কার রাজনীতি গ্রহণ করবে, কার রাজনীতি গ্রহণ করবে না। এজন্য যেটা দরকার একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আজকে এখন যে ক্রাইসিস তার মূলে রয়েছে এদেশে প্রতিনিধিত্বমূলক কোনো সরকার নেই। প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার না হলে তো এ সমস্যা সমাধান হবে না। আজকে এ সরকারের কোনো জনপ্রিয়তা নেই, তাদের কোনো বৈধতা নেই। তারা কোনো নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসেনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলকে কেন্দ্র করে হত্যার ঘটনাকে গণহত্যা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ ঘটনা জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত হওয়া উচিত। সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, নিরাপত্তার নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ অন্য সমন্বয়কদের হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক ডিবি কার্যালয়ে তুলে এনে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ করে ডিবি কার্যালয়েই নজিরবিহীনভাবে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে তাদের মাধ্যমেই কর্মসূচি প্রত্যাহার করানোর নাটক সাজানো হয়েছে। তা আপনাদের সঙ্গে দেশবাসীও অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন। ডিবি হেফাজতে রেখে সমন্বয়কদের ওপর চাপ দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণার নাটক সাজানো হলেও সাধারণ ছাত্রদের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিল না। সরকার কত দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, তা ডিবি হেফাজতে আটক রাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ওপর বলপ্রয়োগ করে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করার ঘটনায় অনুমান করা যায়। এ কথা কারো বুঝতে বাকি নাই যে, চিকিৎসাধীন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের জোর করে হাসপাতাল থেকে তুলে এনে ডিবি কার্যালয়ে তাদের হেফাজতে রেখে বল প্রয়োগ করে ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করতে চায় সরকার।
তিনি বলেন, ‘ছাত্র সমন্বয়করা আটক নয়’, এ কথা ডিবিপ্রধান বললেও তাদের কেন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না? কেন তাদের অভিভাবকদের কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না? ডিবি কার্যালয় নিশ্চয়ই সরকারি বিশ্রামখানা, অতিথিশালা বা খাবার হোটেল নয়। প্রায়ই ডিবি কার্যালয়ে রাজনৈতিক নেতাসহ অন্যদের ডেকে নিয়ে বা তুলে নিয়ে খাবার টেবিলে ছবি তুলে তা গণমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়। যদিও সর্বোচ্চ আদালত থেকে ডিবি প্রধানের এ অযাচিত কর্মকাণ্ডকে ‘জাতির সঙ্গে মশকরা’ বলে অবিহিত করা হয়েছে। জাতির সঙ্গে তামাশা, মশকরা করার জন্য অবৈধ সরকার সরকারি এ সংস্থাকে দিয়ে তার রাজনৈতিক হীন স্বার্থ উদ্ধারে অপব্যবহার করছে। শত শত শহিদের রক্তে রঞ্জিত এ আন্দোলন বৃথা যেতে পারে না। সরকারের এ উদ্যোগ বুমেরাং হবে এবং নৃশংস এ হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী সরকারকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী নিরীহ ছাত্র জনতাসহ বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠন ও অন্যান্য বিরোধী দল, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের ওপর সরকারের নিষ্ঠুর, নির্মম দমন নিপীড়ন চলছেই। বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের এবং অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের অন্যায়ভাবে মিথ্যা অভিযোগে আটক করতে চিরুনি অভিযানের নামে এবং আটকের পর রিমান্ডে এমনকি কারাগারে অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সরকার দিনে বলছে অন্যায়ভাবে কাউকেই আটক করা হবে না, আবার রাতেই ব্লকরেইড দিয়ে অন্যায়ভাবে নিরীহ, নিরপরাধ নেতাকর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থী, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও আটক করছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদেরও আটক করা হচ্ছে অমানবিকভাবে। আটক করতে গিয়ে তাদের বাসা বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ ও আসবাবপত্র ভাঙচুর, এমনকি লুটপাট করার সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। এসব অত্যাচার, নির্যাতন বর্বরোচিত, নৃশংস ও কাপুরুষোচিত। কারাগারে আইনসম্মত সুযোগ সুবিধা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না শিক্ষার্থীসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের। সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। রিমান্ডের পর রিমান্ডে নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও অমান্য করছে অমানবিক এ সরকার। রিমান্ডে অকথ্য ও লোমহর্ষক নির্যাতনের কিছু বিবরণ সম্প্রতি আটক ডাকসুর সাবেক ভিপির কাছ থেকে আমরা গণমাধ্যমে শুনেছি। এসব শুনে জাতি স্তম্ভিত। অসুস্থ রাজনৈতিক বন্দিদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে না। তাদের আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। অবিলম্বে এসব নির্মম-নির্দয় দমন-নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। রাজবন্দিদের সঙ্গে নির্মম অসদাচরণ বন্ধ করতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিতে হবে এবং পরিবার পরিজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দিতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সরকারের বর্বরতা বিশদভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট নয়, সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট এবং সরকারের ফ্যসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এর জন্য দায়ী একমাত্র সরকার, যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নিষ্ঠরভাবে দমন করতে গিয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করে নিরপরাধ, মানুষ, ছাত্র, যুবক, নিষ্পাপ শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। গত ১৭ বছরে সরকারের অগণতান্ত্রিক, গণবিরোধী কার্যকলাপ, ভোটাধিকারসহ জনগণের সব অধিকার হরণ, নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস, দুর্নীতি, লুটপাটের কারণে বিদেশে এ সরকার বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আগেই ধ্বংস করে দিয়েছে। এটা নতুন নয়। বরং দেশের জনগণ আন্দোলন সংগ্রাম করে দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, দেশ ও বিশ্বব্যাপী গণবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ, ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রশমিত করার ব্যর্থ চেষ্টায় নিহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার নামে জোর করে ধরে এনে মায়াকান্নার নামে ফটোসেশন করছে অবৈধ সরকার প্রধান। হত্যাকারীদের খোঁজার কথা বলে প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করতে প্রতারণা করা হচ্ছে শহিদ পরিবারের সঙ্গে। এখন কার্ফু জারি রেখে, সেনা মোতায়েন করে, কঠোর প্রেস সেন্সরশিপ দিয়ে, সামাজিক গণমাধ্যম বন্ধ রেখে, শক্তি প্রয়োগ করে, গুম, গ্রেফতার অব্যাহত রেখে, রাজনীতি ও গণতন্ত্রের গলা চেপে ধরে হতাযজ্ঞের সাফাই গাইছেন এবং উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর ষড়যন্ত্র করছেন। চলমান আন্দোলনের রচয়িতা এ দেশের সাধারণ ছাত্রসমাজ। আন্দোলন এবং হত্যাযজ্ঞ নিয়ে মিথাচার করে ছাত্র-জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ছাত্র-জনতা নিজেদের চোখে দেখেছেন অবৈধ সরকারের নির্দেশে তাদের পেটোয়া বাহিনী আকাশ ও ভূমি থেকে নজিরবিহীনভাবে নির্বিচারে গুলি করে ছাত্র জনতাকে হত্যা করেছে। অথচ রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে সরাসরি পুলিশের গুলিতে হত্যা করা হলেও ও ঘটনায় উল্টো আন্দোলনকারীদের ইট পাটকেলে তার মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশের এজাহার দায়ের প্রমাণ করে সরকার প্রকৃত হত্যাকারীদের বাঁচাতে ব্যস্ত। অন্যান্য হত্যার ঘটনার মামলা একই রকমের হবে- এটা দেশবাসীর অজানা নয়। বিনা ভোটে জবরদখল করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান সরকার ছাত্র আন্দোলনের ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিত্যদিন পাগলের প্রলাপ বকছে। প্রতিনিয়ত মিথ্যা, বানোয়াট ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়েই চলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মন্ত্রী, দলকানা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা মনে করছেন বাংলাদেশের তথা সারা বিশ্বের মানুষ বোকার স্বর্গে বাস করছে, তারা যা বলবে তাই বিশ্বাস করবে। আন্দোলন দমন করতে ইন্টারনেট সরকারের নির্দেশে বন্ধ করলেও ডাটা সেন্টারে অগুন দেওয়ার মিথ্যা কথা প্রচার করা হয়েছে। জনগণকে বোকা বানানোর এ ধরনের বিরামবিহীন সরকারি প্রচেষ্টা পণ্ডশ্রমে পরিণত হতে বাধ্য।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব- আর কোনো প্রাণ কেড়ে না নিয়ে, আন্দোলন দমনে ব্যর্থ চেষ্টা না করে, হত্যা, ধ্বংস, নৈরাজ্যের দায়-দায়িত্ব অন্যায়ভাবে অন্যের ওপর না চাপিয়ে অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। আমি অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে রাজনীতিকে উন্মুক্ত করা, নিষ্ঠুর দমন নিপীড়ন বন্ধ, গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি করছি। রাজনৈতিক সংকট সমাধানে রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।