ভারতীয় পণ্য বর্জন প্রচারণা নিয়ে কেন অবস্থান স্পষ্ট করছে না বিএনপি?
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:২৫ পিএম
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে প্রচারণা চলছে তা নিয়ে গত কয়েকদিনে বিরোধী দল বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিলেও, দলীয়ভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছে না বিএনপি।
দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, এই কর্মসূচি বিএনপি আহবান করেনি। এটি এখন সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিএনপি এখনো দলীয়ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। পরে যথাসময়ে এ বিষয়ে দলের অবস্থান বা প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির মধ্যে নেতৃত্বের যে সংকট চলছে ভারত-বিরোধী ইস্যুতে তা প্রকট হয়েছে।
একইসঙ্গে ভারত ইস্যুতে বরাবরের মতোই দলটিতে যে মতের পার্থক্য রয়েছে তাও স্পষ্ট হয়েছে। এতে বরং আওয়ামী লীগই লাভবান হবে বলে মনে করছেন কোন কোন বিশ্লেষক।
ভারতের যে কোন ইস্যুতে বরাবরের মতোই এবারও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি।
সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ক্যাম্পেইন চলছে তাতে বিএনপির সরাসরি কোন দলীয় অবস্থান না থাকলেও দলটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এতে সমর্থন জানিয়েছেন।
বুধবার এবিষয়ে বিএনপি নেতাদের সমালোনা করে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ২০ মার্চ বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিজের ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে এই আন্দোলনে সংহতি জানান।
যদিও পরে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছেন, এটি তার ব্যক্তিগত বক্তব্য।
এরই মধ্যে গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এই ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ বিষয়টি নিয়ে ও আলোচনা হয়।
এতে রুহুল কবির রিজভীর ওই কর্মকাণ্ড তুলে ধরে আলোচনা করা হয়। ভারতীয় পণ্য বর্জনে রিজভীর সংহতি জানিয়ে দেওয়া বক্তব্য ব্যক্তিগত বলে স্থায়ী কমিটিতে জানানো হয়েছে।
দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, এই আন্দোলন বা কর্মসূচি বিএনপি আহ্বান করেনি। অন্যান্য বিভিন্ন জায়গা থেকে এই আহ্বান করা হয়েছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, মানুষ যখন মার্কেটে যায় তারা একটা কোয়ালিটি কাপড় দেখে। সেটা মেইড ইন বাংলাদেশ, মেইড ইন ইনডিয়া নাকি চায়না এটা দেখে না। ইনডিয়ান কাপড় কেনে এমন ও না। এটার কথা স্পেসিফিক করা যাবে না। এটা একটা রাজনৈতিক আবেগ। মানুষ ভোট দিতে পারে নাই।
নির্বাচনের পরে আওয়ামী-লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
এই মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে গয়েশ্বর রায় বলেন, জনগণ স্বাভাবিকভাবেই ভাবতে পারে ভারতের কারণেই বাংলাদেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। তার ক্ষোভ, অভিমান থেকে জনগণ অনেক কথাই বলছে।
এই আন্দোলনটি এখন সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবে দলীয়ভাবে এ বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয় নি। যথাসময়ে এ বিষয়ে বিএনপি তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে।
আরও পড়ুন: বিএনপি কি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ল?
এ বিষয়ে মঙ্গলবার থেকে বিবিসি দলটির আরো কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সাড়া দেননি তারা।
কিন্তু, বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আবারও ভারতীয় পণ্য নিয়ে কথা বলেন।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেতারা কেন স্ত্রীদের ভারতীয় শাড়ি পোড়াচ্ছেন না এমন প্রশ্ন তোলেন।
সেই প্রশ্নের উত্তরে রিজভী বলেন, বিএনপির নেতারা ইন্ডিয়া থেকে শাড়ি খুব একটা কেনে না। আমার নানাবাড়ি ভারতে। বিয়ের পর একবার ভারত গিয়েছিলাম মামাবাড়ি। সেখান থেকে আমার স্ত্রীকে একটা শাড়ি দিয়েছিল। সেটা অনেক আগেই কাথা বানানো হয়েছে, সেটাও ছিড়ে গেছে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক ক্ষুন্ন করা এটা নিয়ে দুই একটা পত্রিকা খুব বিচলিত। আমরা ছাত্রজীবন থেকেই রুশ ভারতের দালাল স্লোগান দিয়ে এসেছি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতকে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে বেশি মূল্যায়ন করেছে। বামপন্থী দলগুলো বেশি এই মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু আজকে হঠাৎ করে মনে হচ্ছে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলাই যেন পাপ।
রিজভী বলেন, জাতীয় স্বার্থের বাইরে যা যাচ্ছে তা নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করি।
নিজের দেশের কারখানায় শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যের কাছে নতজানু হওয়া যাবে না।
সীমান্ত হত্যা, ডামি নির্বাচন, ডামি সরকারের বিরুদ্ধে থাকলে তাদের (ভারত) বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হবে না জনগণ, পণ্য বয়কট করবে না?এমন প্রশ্ন তোলেন বিএনপির এই যুগ্ম মহাসচিব।
ভারতীয় পণ্য বয়কট প্রচারণাকে সামাজিক আন্দোলন উল্লেখ করে তাতে সংহতি জানানো ন্যায়সঙ্গত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রিজভী।
যে কয়েকটি দল দলীয়ভাবে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রচারণা চালাচ্ছে তার একটি গণ-অধিকার পরিষদ।
দলটির নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক বলেন, জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে যখন ভারত একটা রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দেয়, তখন বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ভারতের এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে দাঁড়াতে হয়। তাই ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে একটা বার্তা দিতে এই ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে।
তবে বিএনপি দলীয়ভাবে এই প্রচারণায় অংশ না নেওয়া নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
ভারত বিরোধী ইস্যুতে বিএনপি এখনো দলীয় সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেনি। বরং যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্য নিয়ে দলের মধ্যেই যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাতে এই বিষয়টিকে নেতৃত্বের সংকট বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, বিএনপির মধ্যে নেতৃত্বের সংকট চলছে। ফলে এটি যুগ্ম মহাসচিবের ব্যক্তিগত বক্তব্য নাকি কতখানি বিএনপির সিদ্ধান্ত তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে।
রাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, এই কর্মসূচি নিয়ে দেখা যাচ্ছে বিএনপির দলের মধ্যেই দ্বন্দ্ব আছে। রিজভীর চাদর পোড়ানোর মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। আরেক দল বলছে ভারতকে আমরা অসন্তুষ্ট করবো না কারণ তাহলে ক্ষমতায় আসা যাবে না। আবার আরেকদল ভাবছে তাদের অফিসিয়াল স্ট্যান্ড গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্বের জন্য ফাইট করবো। সুতরাং দলের মধ্যেই এরকম একটা দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বিএনপির মধ্যে যে লিডারশীপের ক্রাইসিস চলছে। কে মহাসচিব হবে সেটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় নির্বাচনে যেহেতু পশ্চিমা দেশের সাপোর্ট তা সেভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। তাই অ্যান্টি ভারত সেন্টিমেন্ট সামনে নিয়ে এসে সেটাকে কাজে লাগিয়ে তারা সাফল্য পেতে চায়।
ভারত-বিরোধী এই কর্মসূচির কোন প্রভাব নেই বরং বিএনপি এতে যুক্ত হলে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করবে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।