Logo
Logo
×

রাজনীতি

নির্বাচনে অংশ নেওয়া ‘কিংস পার্টি’গুলো এখন কী করছে?

Icon

বিবিসি বাংলা

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩৮ পিএম

নির্বাচনে অংশ নেওয়া ‘কিংস পার্টি’গুলো এখন কী করছে?

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত যেসব রাজনৈতিক দল সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, নির্বাচনের পর সেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। 

দলগুলোর নেতারা অবশ্য বলছেন, তারা তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং দল পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে সুষ্ঠু দেখানোর জন্য সরকারের নির্দেশে উত্থান হওয়া এসব দলের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ‘মৃত্যু’ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই খুব একটা সাড়াশব্দ নেই দলগুলোর।

নির্বাচনের আগে আগে অপরিচিত কয়েকটি রাজনৈতিক দল বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এসব দলকে নিবন্ধনও দেয়া হয়েছিল। বিএনপির অনেক দলছুট নেতাও এসব দলে বড় পদে যোগ দিয়েছিলেন।

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় কার্যালয় নিয়ে বেশ জোরেশোরেই দলীয় কার্যক্রম শুরু করেছিল এসব দল। রাজনৈতিক সমালোচকরা এসব রাজনৈতিক দলকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে অভিহিত করেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-বিএসপি-কে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে এই দলগুলো বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

এই দলগুলো এমন এক সময়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানায়- যখন দেশের অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। একই সঙ্গে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক চাপ ছিল।

নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া নতুন এই দলগুলো নির্বাচনে অংশও নিলেও জয় তো দূরের কথা, বেশির ভাগ প্রার্থীই জামানত পর্যন্ত হারিয়েছেন।

এসব দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচন থেকে তাদের মূল পাওয়া আসলে দলের পরিচিতি, জয়লাভ নয়। আর এখন দলকে সুসংগঠিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য।

‘দুই মাসের দল’

২০১৫ সালে তৃণমূল বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও দলটি নিবন্ধন পায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর দলটির প্রথম কাউন্সিলে যোগ দেন বিএনপির দলছুট দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার।

দলটির প্রতীক সোনালী আঁশ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩৩টি আসনে প্রার্থী দেয় তারা। তবে কোনো আসনেই এই দলের কোনো প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি। উল্টো বেশির ভাগ প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হয় সে বিষয়ে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে চল্লিশটিরও বেশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ দলের নাম ও প্রতীক তেমন কেউ জানে না। তবে তাদের দলের নাম, নেতাদের নাম ও প্রতীক দেশের মানুষ জেনেছে - এটা তাদের একটি অর্জন। দলটি হইল আমাদের দুই মাসের দল। নির্বাচন কমিশন আমাদের দলটাকে নিবন্ধন দেয় নাই। আমরা সুপ্রিম কোর্টে যুদ্ধ কইরা নিবন্ধন পাইছি।

নির্বাচনে আসার আগে সরকারের কাছ থেকে কোনও আশ্বাস পাননি উল্লেখ করে তিনি জানান, সরকারের বিরুদ্ধে তারা নির্বাচনে গিয়েছেন।

এর আগের নির্বাচনগুলোতে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সরকার গঠন, তাদের ক্ষমতায় থাকা এবং বিদেশি সমর্থন- কোনোটিই ঠেকানো যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাই এবার ক্ষমতাসীন দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে জিততে না পারে তা নিশ্চিত করতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তারা।

 তৈমুর আলম বলেন, সরকারকে আমরা ব্ল্যাংক চেক দিতে চাই নাই। আমরা চাই নাই যে, সরকার শুয়ে শুয়ে পাস করুক। এবার আমাদের সাথে নির্বাচন করতে গিয়ে সরকারকে অনেক বেগ পাইতে হইছে। সরকারকেও মাঠে নামতে হইছে।

‘কিংস পার্টি’ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। 

আপাতত দলের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া, এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলা এবং পরবর্তী সময়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

কেন্দ্রীয় কার্যালয় এখনও পল্টনের তোপখানা রোডেই রয়েছে। তবে একই এলাকায় ভালো আরেকটি নতুন কার্যালয়ের কথা চিন্তা করছেন তারা।

তিনি বলেন, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সেগুলো বিস্তার লাভ করতে বা বড় দল হতে পেরেছে। তৃণমূল বিএনপি এখনও সেই সুযোগ পায়নি।

দল নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, তৃতীয় ধারার একটি রাজনীতি গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাবেন তারা। ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে তারা পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘কার্যালয়ে যাওয়া-আসা হচ্ছে’

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে ২০২৩ সালের আগস্টে নিবন্ধন পায়।

সবশেষ নির্বাচনে নোঙর প্রতীকে দলটি ৫৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। তবে কোনও প্রার্থীই এই নির্বাচনে জয় পাননি। বরং একজন বাদে দলের সব প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

বিএনএম-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই নির্বাচন থেকে তাদের প্রাপ্তি হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করা। এই বিষয়টিকেই তারা সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে দেখছেন।

দ্বিতীয়ত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের দলকে কিছুটা হলেও সংগঠিত করা গেছে। একই সাথে বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্ব বাছাই করতে সমর্থ হয়েছেন তারা।

আবু জাফর বলেন, হতাশাগ্রস্ত রাজনৈতিক লোক যারা বসেছিল চুপ করে, তাদের এই দল দিয়ে তাদের সক্রিয় করার একটা প্রচেষ্টা আমরা পেয়েছি। 

নির্বাচনের আগে গুলশানে একটি কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে বিএনএম। তবে নির্বাচনের পর এই কার্যালয়টিতে তেমন কোনও কার্যক্রম নেই বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।

আবু জাফর অবশ্য বলছেন, বর্তমানে তারা নিজেদের দলকে গোছানোর কাজে সময় পার করছেন। মঙ্গলবারও তারা তাদের কার্যালয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। তাদের একটি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দলীয় কমিটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সাথে দলের অঙ্গসংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগের এবং জেলার দলীয় দায়িত্ব প্রদান করা হচ্ছে। তারা অচিরেই কার্যক্রম শুরু করবে।

এছাড়া তারা উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করছেন। সেখানে ভালো প্রার্থী পাওয়া গেলে মনোনয়ন দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আগামী সময়ে তাদের পরিকল্পনা জানতে চাইলে আবু জাফর বলেন, আগামী পাঁচ বছরকে কেন্দ্র করে তারা দলকে সংগঠিত এবং শক্তিশালী করতে চান। এছাড়া অঙ্গসংগঠন গড়ে তোলা এবং গণসংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

আর যেসব এলাকায় প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা রয়েছে তারা যাতে গণমুখী কার্যক্রম করে আরো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে তার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, সরকারের যে ভুল থাকবে সেটার সমালোচনা করবো, যেটা ভাল থাকবে তার সমর্থন করবো। এই নীতি নিয়েই আমরা অগ্রসর হবো।

তিনি জানান, গত নির্বাচনে তাদের প্রার্থীরা খুব একটা হালে পানি পায়নি কারণ মাঠ পর্যায়ে কর্মী সংখ্যা কম ছিল। এছাড়া সরকার যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে প্রশাসনের লোকজন একমুখী আচরণ করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

দল নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তাদের দলটিই নতুন। এখনো তারা দলের কার্যালয়ে মূলত যাওয়া-আসা করছেন। দলটি ছোট হওয়ার কারণে সেগুলো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো জাঁকজমকপূর্ণ নয়। ছোট অন্য দলগুলোর মতোই তারা রয়েছেন এবং তারা ভবিষ্যতে দল গঠনে কাজ করবেন।

তিনি জানান, কেন্দ্রীয় কার্যালয় আছে এবং এটা থাকবে। বিভাগীয় পর্যায়ে কার্যালয় স্থাপনের চেষ্টা করা হবে।

‘কিংস পার্টি’র অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কিংস পার্টি যদি আমরা হতাম তাহলে কিছু অন্তত নমিনেশন, আমরা নির্বাচনে বিজয় লাভ করার জন্য একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকতো। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বা কারো সাথে আমাদের কোনও বৈঠক হয় নাই। এবং আমরা জিতবো, এই কয়টা সিট পাবো এরকম ভাগাভাগি হয় নাই।

তিনি জানান, সরকারের সাথে তাদের কোনো সমঝোতা নাই।

‘কিংস পাটি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আরেকটি রাজনৈতিক দল হলো বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। এই দলটি ৭৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। কোনো প্রার্থীই জয়লাভ করেননি।

এই দলটির সঙ্গে যোগাযোগ করেও প্রাথমিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘কিংস পার্টি’ বা হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে উঠা এসব রাজনৈতিক দলগুলো আসলে ‘পুতুল দল’ হিসেবে কাজ করে। সরকার যেভাবে চায় দলগুলো ঠিক সেভাবেই আচরণ করে।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনের মাঠে নামানোর জন্য এসব দলকে তড়িঘড়ি করে গঠন করা হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনও তাদেরকে দল হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছে।

তার বক্তব্য, নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্দেশে সরকারেরই একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। তা না হলে এসব দলের নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়।

তিনি বলেন, সরকারের নিম্নমানের স্থূল কৌশল ছিল নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দলগুলোর উত্থান। আর নির্বাচন যেহেতু হয়ে গেছে তাই এগুলোর স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। যেভাবে বুদবুদের মতো ভেসে উঠেছিল, আবার মিলিয়ে যাবে।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, নানা ধরনের লোভ দেখিয়ে এবং সুযোগসুবিধা দিয়ে এসব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা হয় বলে মনে করেন তিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতিতে এদের কোনও অবস্থান থাকে না। এরা এর আগে হয়তো নানা ধরনের দলে ছিল। এরা যে নির্বাচনটা করেছে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা বা ভালোবাসার কারণে নয়। এরা করেছে লোভে পড়ে। এর পেছনে লেনদেনের ইতিহাস থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। অতীতেও আমরা এমনটা দেখেছি। 

আরও পড়ুন: ভোটে ধরাশায়ী হয়ে আলোচনায় ‘কিংস পার্টি’র নেতারা

 
Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম