যেভাবে সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত রূপ দিতে চায় বিএনপি
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৪৫ পিএম
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটি প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পূর্ণ করল ১ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে ক্ষমতায় যাওয়াই রাজনৈতিক দলগুলোর মুল লক্ষ্য সেখানে গত ১৭ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে আছে দলটি; যা প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে দীর্ঘসময়ের অপেক্ষা। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির জন্য আগামী দ্বাদশ নির্বাচন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
আগামীতে ক্ষমতায় আসতে না পারলে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করবে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই আজ বয়সের ভারে ন্যুজ। গত নির্বাচনের আগে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন এমন বর্ষীয়ান নেতাদের অনেকেই মারা গেছেন। সেক্ষেত্রে তরুণ নেতৃত্ব কতটা দৃঢ়তা ও পরিপক্কতার সঙ্গে ভবিষ্যতে দলীয় কর্মকাণ্ড সামাল দেবেন সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
এ কারণে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা এই নির্বাচনকেই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে সরকারের পদত্যাগ দাবিতে এক দফা আন্দোলনে রাজপথে রয়েছে বিএনপি। তবে এবারের আন্দোলন অনেকাটাই পরিশীলিত। অহিংস ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণঅভ্যত্থান ঘটিয়ে সরকারকে বিদায় দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিএনপি ও তাদের আন্দোলনের সঙ্গীরা। বিএনপি ও তাদের যুগপৎ সঙ্গীরা যে একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সেটি কতটা সফল হবে তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছরের পথপরিক্রমা এবং আগামী দিনে তাদের কল্পিত অভ্যুত্থানের ভবিষ্যত নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে।
এতে বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে চাইছে বিএনপি। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিতে সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হওয়াটা এখন বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
বর্তমানে বিএনপির আন্দোলন যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে তারা সরকার পতন ঘটাতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে।
দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং সরকারের কঠোর অবস্থানে বিএনপির রাজনীতি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। আগামী দিনে সরকার বিএনপির প্রতি আরো কঠোর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই আগামী দিনে বিএনপির আন্দোলনের পরিণতি কী হয় সেদিকেও এখন অনেকের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।
আন্দোলনের সুনামি তুলে সরকারকে বিদায় করার হুশিয়ারি দেওয়া বিএনপি নেতারা মানছেন বিষয়টি খুব একটা সহজ হবে না। কারণ দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনে সরকারের শক্ত অবস্থান। অতীতে প্রশাসন ব্যবহার করে সরকার নির্বাচনে সুবিধা নিয়েছে।
বিএনপির অন্যতম নীতি নির্ধারক জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আপনার প্রতিপক্ষ যদি একটা রাজনৈতিক দল হয় সেটা এক ধরনের রাজনীতি। আপনার প্রতিপক্ষ যদি হয় একটা রেজিম, যারা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ব্যবহার করে পাওয়ারফুল হচ্ছে এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে, সেটি বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা, নির্বাচন কমিশন সবগুলোকে যখন করায়ত্ত করে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, সেটি খুব কঠিন অবস্থা। আমরা তার মুখোমুখি।
আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা নিয়ে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে চাপ তৈরি করেছে, তাতে বিএনপি নেতাদের মধ্যে একটা বাড়তি আত্মবিশ্বাস কাজ করছে। সরকার এবার একতরফা ভোট করতে চাইলে সেটি প্রতিরোধের চেষ্টা করবে বলেও ইঙ্গিত দিচ্ছে বিএনপি।
আরও পড়ুন: ‘ফাইনাল’ পরীক্ষায় বিএনপি
এ বিষয়ে আমির খসরু বলেন, আমরা আন্দোলনের এমন একটা পর্যায়ে চলে আসছি দেশের জনগণ প্রয়োজনে ক্ষমতাসীনদের প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধ করার অধিকার কিন্তু আছে দেশের নাগরিকদের। আপনি যখন তার রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করবেন, সেই দেশের নাগরিকদের প্রতিরোধ করার সাংবিধানিক অধিকার আছে কিন্তু। তো বাংলাদেশ ঠিক সেই পর্যায়ে এখন এসেছে।
'গণঅভ্যুত্থান' কীভাবে?
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের বাকি আছে চার মাসেরও কম। এখনও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনঢ় অবস্থান ধরে রেখেছে বিএনপি।
অন্যদিকে সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে সরকার অটল। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপ বা আলোচনার বিষয়টিও যেহেতু অনুপস্থিত, তাই দাবি আদায়ে গণ-আন্দোলন ছাড়া বিকল্প দেখছে না বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করতে চান তারা।
তিনি বলেন, এরশাদ পতনের মাত্র কয়েক দিন আগেও বলেছে যে কোথায় পদত্যাগ করব জিরো পয়েন্টে? আমরা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে কী দেখেছি? আটষট্টি সালে আইয়ুব খান উন্নয়নের একদশক পালন করেছে, কিন্তু ঊনসত্তরে তিনি আর নাই।
বিএনপির বর্ষীয়ান এই নেতা আরও যোগ করে, গণ-আন্দোলন বা মানুষের আন্দোলন এটা কখন স্পার্ক করবে, কখন পরিপূর্ণতা লাভ করবে এটা ভবিষ্যতবাণী করা যায় না। কে জানে যে এখন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে যাবে না। কে জানে যে দুই সপ্তাহের মধ্যে হবে না বা চার সপ্তাহের মধ্যে হবে না।
এদিকে বিএনপি গণঅভ্যুত্থানের কথা বললেও এখন পর্যন্ত তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে খণ্ড-খণ্ডভাবে। কয়েকটি বড় সমাবেশ ছাড়া টানা আন্দোলন কিংবা জোরালো কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির মাঠে অবস্থান নিতে পারেনি বিএনপি।
এ বাস্তবতায় নির্বাচনের আগে যতটুকু সময় আছে তার মধ্যে কীভাবে গণ-আন্দোলন সৃষ্টি হবে? আর সেই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কী? এমন প্রশ্নে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ড. শামসুজ্জোহা হত্যার ঘটনায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বা আসাদের মৃত্যুতে এটা বদলে গেছে। ডাক্তার মিলন বা নূর হোসেনের মৃত্যুতে এরশাদবিরোধী আন্দোলন মুহূর্তে বদলে গেছে।
তিনি বলেন, এটি কোনো পরিকল্পনার বিষয় না। একটা পরিকল্পনা ঠিক আছে। সেটা হচ্ছে— আমরা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমাদের এ আন্দোলনটা অব্যাহত রাখব এবং ক্রমান্বয়ে আরও জোরদার করার চেষ্টা করব। অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।
এখন পর্যন্ত রাজপথে সভা-সমাবেশ, পদযাত্রার মতো কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে নিচ্ছে দলটি। এসব কর্মসূচিতে যে সরকার নমনীয় নয় সেটি স্পষ্ট। তা হলে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি কেমন হবে?
এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, চলমান আন্দোলন যখন যে কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে সেই কর্মসূচি আসবে। আর কর্মসূচি তো একা বিএনপি দিচ্ছে না। এখানে ছত্রিশ দল আছে, ছত্রিশ দলের যুগপতের বাইরে যারা আছে, তাদের সঙ্গে আমাদের একটা মনের মিল আছে, সবাই একদিকে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, সুতরাং আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটা কিন্তু সে রকমই। কর্মসূচি যেগুলো আসবে সেগুলো কিন্তু সেটার ভিত্তিতেই হবে। আর আন্দোলন বলে দেবে কখন কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করেছে। কিন্তু এবার নিরপেক্ষ সরকার গঠন ছাড়া একতরফা নির্বাচন করার সুযোগ দিতে চায় না বিএনপি। যদিও সেটি আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি আদায় করতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।