
প্রতীকী ছবি
পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই চারপাশে ধর্ষণের খবরে মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধা, কিশোরী থেকে তরুণী—কেউই নিরাপদ নয়। চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে শিশুকে ধর্ষণ, গণপিটুনির পর বৃদ্ধ ধর্ষকের গ্রেফতার, সালিশে ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে অপবাদ দেওয়া, এমনকি আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাগুলো আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াও যেন হতাশার অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। তথ্য-প্রমাণের অভাবে আসামিরা খালাস পাচ্ছেন, মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে আর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময়ও লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে—তাহলে সমাধান কোন পথে?
এক. আইনের কঠোর প্রয়োগ
প্রথমত, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বর্তমানে মামলাগুলো বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকায় বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। এ ছাড়া, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়ানো উচিত, যাতে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেন।
দুই. সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষা
ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইনই যথেষ্ট নয়, সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে নারী-পুরুষের সমান অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে অপবাদ দেওয়া বা লজ্জা দেওয়ার মানসিকতা থেকে সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে সমর্থন ও সহায়তা দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
তিন. নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ও সমাজকে একসাথে কাজ করতে হবে। পাবলিক প্লেস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং পরিবহনে নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সিসি ক্যামেরা, সুরক্ষা কর্মী এবং জরুরি হেল্পলাইন চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া, নারী ও শিশুদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যাতে তারা বিপদে পড়লে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন।
চার. ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করা
ধর্ষণের মতো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তির ভয়ই অপরাধীকে অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত করে। এ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির সাক্ষ্য ও প্রমাণকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে আইনি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তার মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া জরুরি।
পাঁচ. মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা
মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ধর্ষণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে জনসচেতনতা তৈরি করা মিডিয়ার দায়িত্ব। এ ছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং শাস্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা বজায় রাখা জরুরি, যাতে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
ছয়. রাষ্ট্র ও সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা
ধর্ষণ প্রতিরোধে রাষ্ট্র ও সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকার, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষ—সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। ধর্ষণের মতো অপরাধকে কোনোভাবেই ক্ষমা করা যায় না। এটি শুধু একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ নয়, এটি সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
শেষ কথা
ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা, নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ, একটি অপরাধমুক্ত সমাজই পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করতে।
সমাধানের পথে এগিয়ে আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলুন একটি নিরাপদ সমাজ।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী