Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রশাসনে নিয়োগ-বদলি-পদায়নে শৃঙ্খলা আনুন

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশাসনে নিয়োগ-বদলি-পদায়নে শৃঙ্খলা আনুন

জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে নিয়োগ বদলি ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে সরকার। ১০ জানুয়ারি এমন একটি খবর যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে কোনো কমিটি গঠনের বিষয়টি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়।

বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো অঘটনকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উদ্ভূত ফলাফলের দায় যাতে বায়বীয় হয়ে যায় বা কোনো একক দায় না বর্তায়; সমস্যার প্রকৃত সমাধান না করে পোশাকি পরিবর্তনের মাধ্যমে দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় (আইওয়াশ)-ইত্যাদি উদ্দেশ্যে কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে। কমিটি নিয়ে এমন নেতিবাচক ধারণা আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রচলিত আছে। এমন নেতিবাচক ধারণা একেবারেই অমূলক নয়। বিশেষত গত ৫২-৫৩ বছরের সরকারি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সম্পর্কে এমন ধারণাই জনমানসে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।

কাজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কি আগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে, না নতুন কিছু হবে, এখন তা দেখার বিষয়। কেননা গত ৫ মাসে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আগের অস্বচ্ছ পদ্ধতি প্রক্রিয়া এখনো অনুসরণ করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কোনো সরকারি অফিসে উচ্চতর পদে পদোন্নতির জন্য পদশূন্য থাকতে হয়। কিন্তু বৈষম্য দূরীকরণের জন্য প্রশাসন ক্যাডারের শত শত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে শূন্য পদ ছাড়াই। অথচ সেখানে অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে বৈষম্যের বিষয়াদি যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি। অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব পদে নির্ধারিতসংখ্যক পদের ২/৩ গুণ বেশি কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন এবং কর্মরত আছেন। ওইসব পদে এখন আবার পদোন্নতি দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। হয়তো হয়েও যাবে।

গত সরকারের আমলে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাব, ক্ষমতাধর আমলার প্রভাব এবং পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন লাভজনক পদে প্রশাসনের ডিসি-কমিশনার, সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। শোনা যাচ্ছে, এ সরকারের আমলেও সমন্বয়ক, উপদেষ্টা বা ক্ষমতাধর আমলার অনুগ্রহ ছাড়া সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে আগের সরকারের আমলে যেভাবে নিয়োগ পাওয়া যেত, সেটি এখনো চলমান আছে কিনা, খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে। তবে সে সময়কার দালাল চক্রের সদস্যের আনাগোনা এখনো সচিবালয়সহ বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় লক্ষ করা যাচ্ছে। সেদিন পরিচিত এক আমলার কাছে জানা গেল, তার চেনামতে এক দালাল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় অপেক্ষা করছে। সে অন্তত একজনকে ওএসডি হওয়া বা শৃঙ্খলাজনিত শাস্তি থেকে রক্ষার জন্য অনেক উঁচু পর্যায়ের একজনের সাক্ষাতের সময়সূচি নিয়ে এসেছে। সেই দালাল তাকে বলেছে, পদ্ধতি একই আছে, ব্যক্তি এবং পরিমাণে পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। গত সরকারের সময় বিভিন্ন লাভজনক পদের বিপরীতে নিলামে যে ডাক উঠেছে, তার পরিমাণ নিচে ১০ কোটি, উপরে এখন পর্যন্ত ১৫০ কোটি শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি ডিসি পদায়নের সময় তার ঝলকানির একটি নমুনা দেখা গেল। বিষয়টির বস্তুনিষ্ঠতা থাকুক আর ফেইক বা সাজানো হোক, বাজারে এমন ঘটনার মুখরোচক আলোচনা তো শোনা যাচ্ছে। ডিসি নিয়োগের ওই ঘটনার পর যাদের নাম এসেছে, প্রথমে ঢাকা থেকে একটু দূরে সরানো হলেও তাদের আবার ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। ওই ঘটনার পরপরই বর্তমানের মতো উপদেষ্টা কমিটি করা হলে হয়তো এতদিনে আরও কিছু ভালো ফলাফল দেখা যেত! এখনো যদি উপদেষ্টা কমিটি আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিয়মনীতি অনুসরণ করে নিজস্ব ন্যায়ভিত্তিক চিন্তায় কাজ করতে পারে, তাহলে হয়তো সুশাসনের প্রভাত দৃশ্যমান হতেও পারে। নচেৎ নয়!

যে তিনটি মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনপ্রশাসন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের জন্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা এবং বাণিজ্য ক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। এটিই তাদের দায় ও দায়িত্ব। এক্ষেত্রে উপযুক্ত লোককে চিহ্নিত করে পদায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আগে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কথোপকথনে সমাজের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, থানার ওসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অর্থের বিনিময় পদায়ন হয়েছে। তাহলে ওসি হওয়ার জন্য যদি কেউ টাকা বিনিয়োগ করে থাকে, সে তা তার দশগুণ উসুল করবে, সেটাই স্বাভাবিক। ফলে সমাজে অপরাধী ছাড়া পায়, সে আরও বহুগুণ মাত্রায় অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। অপরাধ একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়! সমাজে বিভিন্ন অপরাধ, মাদক ব্যবসা বৃদ্ধি পায়। বিচার না পাওয়ায় মজলুম-নিরীহ মানুষ অসহায় অবস্থায় বিধ্বস্ত-বিপন্ন জীবনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়।

৩/৪ বছর আগের কথা। নিজ এলাকার একজন মানুষ ফোন করে জানাল, তার মেয়েকে নিয়ে এক ছেলে পালিয়েছে। গাজীপুর বা সাভার এলাকার কোনো এক থানায় আটক আছে। আমি যাতে একটু যোগাযোগ করে বিষয়টি নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করি। মেয়ের বাবা ফোন করেছিলেন। আমি বললাম, ওসিরা আমার মতো সাধারণ মানুষের কথা শোনে না। তারপরও মেয়ের বাবার কান্নাকাটিতে রাজি হই। আমাদের গ্রাম এলাকার একজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলি। সে পারিবারিকভাবে পরিচিত। মেয়ের বাবাকে পুলিশ কর্মকর্তার নম্বরও দিলাম। ওই কর্তা ঢাকার বাইরে কর্মরত ছিল। তার কাছে অনুরোধ ছিল, সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করে বিষয়টি যাতে নিষ্পত্তি করে দেয়। পরদিন ফলোআপ নিতে গিয়ে কথায় কথায় আমার পরিচিত কর্মকর্তা বলল, ওই এলাকার থানায় কর্মরত ওসিরা শত কোটি টাকার মালিক, তারা দরিদ্র পুলিশ কর্মকর্তাদের কথায় বেশি পাত্তা দেয় না! এভাবে প্রায় সব সরকারি অফিসই দুর্নীতির নিকষ কালোছায়ায় আচ্ছাদিত। কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে ‘কত ধানে কত চাল’। যা হোক, আমার এ লেখার উদ্দেশ্য কোনো গোষ্ঠীকে হেয় করা বা আক্রমণ করা নয়। আমাদের সমাজকে পরিবর্তনের একটি সুযোগ এসেছে, তাকে কাজে লাগাতে হলে বর্তমান সরকারের কুশীলবদের সমস্যার গভীরতা বোঝা দরকার। তাই কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র।

কয়েকদিন আগে নিউএইজ সম্পাদক নুরুল কবিরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা কার্যসম্পাদনের দায়-দায়িত্ব বা সামর্থ্যরে জায়গায় কথা বলতে গিয়ে আমলাদের কিছু নিয়মকানুনের সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আমলারা নিয়মকানুনের দুর্বল দিক তুলে ধরে ওই কাজ বাধাগ্রস্ত করতে। তারা যে সবসময়েই এমনটা করে, তা নয়। তবে কোনো কাজে যদি তাদের স্বার্থ থাকে, সেখানে তারা নিয়মকানুনের বাধা বা দুর্বলতা তাদের খোঁড়া যুক্তির আড়ালে ফেলে দিয়ে কাজ হাসিল করে। আবার কোনো কাজ তাদের স্বার্থের বাইরে হলে তা যতই জনস্বার্থমূলক হোক, তাকে তারা বাধা দেবেই। তখন আইনের, নিয়মের পাহাড় তুলবে। রাজনৈতিক পর্যায় বা মন্ত্রী বা উপদেষ্টা পর্যায় থেকে যদি সেই যুক্তি খণ্ডানো না যায়, তাহলেই আমলাদের পোয়াবারো। রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীরা বুঝেও না বোঝার ভান করত তাদের নিজস্ব ধান্দা হাসিলের লক্ষ্যে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিশ্চয়ই তা করবে না। তাই নিয়মকানুন যা আছে, তা গোড়া থেকে বুঝে কাজ করতে হবে। আইনকানুনের ব্যাখ্যার জন্য আমলাদের ওপর একক নির্ভরশীলতা কোনোভাবে কাম্য নয়। ‘আপনারা বুঝবেন না, না বুঝে ভুল কাজ করবেন’, এটা সাধারণ মানুষ মানতে রাজি নয়। তাদের কথা-না বুঝলে সে কাজ করবেন না। না বুঝে কাজ করার জন্য কোনো দায়মুক্তি পাওয়া যায় না। নিন্দুকরা আপনাদেরও আগের মতো পক্ষপাতিত্বের বা বাণিজ্যের দোষে দোষী সাব্যস্ত করবে। মাঠে-ময়দানে যে কথা ঘোরে, তার খবর আপনাদের রাখতে হবে।

জনপ্রশাসনে ডিসিকাণ্ডসহ কিছু ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো কোনো ভালো বার্তা দিচ্ছে না। কয়েকজন নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; কোন মাপকাঠিতে? সচিব হওয়ার জন্য কোনো নীতিমালা কি আছে? থাকলে তা প্রকাশ করুন। কয়েকজন সচিবকে নিয়োগ দিয়ে ২/১ দিনের মধ্য নিয়োগ প্রত্যাহার করা হয়! এ নিয়োগ প্রদানে যারা ভূমিকা রেখেছিল, সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি? বর্তমানে ৫/৭ বছর আগে অবসরপ্রাপ্তদের এনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এর কারণে বর্তমানে যারা বঞ্চিত হচ্ছে বা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তারা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবে? আর প্রশাসনিক কাঠামোতে যে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে এ দৃষ্টান্ত অনুসারে আরও কত বঞ্চনা, বৈষম্য করা হবে, সে সম্পর্কে কী ভাবনা-চিন্তা করা হয়েছে? বহু ক্ষেত্রেই এ ধরনের নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হচ্ছে, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও দুঃখজনক। এ বিষয় উপদেষ্টা পরিষদের দায়িত্বশীলদের অজ্ঞতার অজুহাত কোনো দায়মুক্তির সনদ হতে পারে না।

সিভিল সার্ভিসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জ্যেষ্ঠতা, শৃঙ্খলা এবং সুনির্দিষ্ট পদ সোপান। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৯৯০ পর্যন্ত এ বিধান পালন করা হয়েছে। কিন্তু তথাকথিত গণতন্ত্রায়নের নামে ’৯০-পরবতী সময় থেকে রাজনৈতিক সরকারের আনুকূল্যে অথবা দুর্বলতার সুযোগে আমলারাই তাদের স্বার্থে নিয়মকানুন ভঙ্গুর করেছে। তাদের কারও বিচার হয়নি। মাঝেমধ্যে কেয়ারটেকার সরকার এসে হম্বিতম্বি করেছে। কিন্তু গুণগত কোনো পরিবর্তন বা পুনঃশৃঙ্খলায়ন করতে পারেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেও সে পূর্ব লক্ষণই দৃশ্যমান। অনেক বিলম্বে হলেও এ কমিটি নিয়ে কিছুটা আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে। তাই আমিও নিজের অবস্থান থেকে কিঞ্চিৎ ভূমিকা রাখতে পারি কিনা, এ দায় থেকে লিখতে বসা। কর্তৃপক্ষ যদি কর্ণপাত করে, সে লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করছি।

১. বদলি, পদায়ন নিয়ে কোনো নীতিমালা থাকলে তা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণের উদ্দেশে প্রকাশ করুন। না থাকলে নতুনভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করুন। নীতিমালা প্রণয়ন করতে হলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তৃতীয় কোনো সংস্থাকে দিয়ে খসড়া প্রস্তুত করুন। প্রশাসন বা পুলিশের জন্য নীতিমালা করতে তাদের মতামত নেওয়া যায়, কিন্তু তাদের হাতে খসড়া হলে তা স্বার্থের সংঘাতে পক্ষপাতমূলক হবে, এটাই স্বাভাবিক।

২. বর্তমানে কোনো নীতিমালা থাকলে উপদেষ্টারা, বিশেষত প্রধান উপদেষ্টা নিজেই পাঠ করুন। ব্যাখ্যা প্রয়োজন হলে পিএসসি, এমনকি এখন যারা সার্ভিসে নেই, এমন আমলাদের ডেকে প্রকৃত অর্থ বুঝে নিন। বড় বড় পদে প্রধান উপদেষ্টাই অনুমোদন দেন। কাজেই তাকে বিষয়টি অবশ্যই বুঝতে হবে।

৩. আমলাতন্ত্রের কাঠামো-ক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে পারবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কয়েকজন শিক্ষককে ডেকে তাদের ব্যাখ্যা ও মতামত শোনা যায়। নীতিমালা প্রস্তুত করার জন্যও তাদের সাহায্য নেওয়া যায়।

৪. বাংলাদেশের সব অফিসে পদোন্নতির প্রধান দুটো শর্ত হলো : ক. গ্রেডেশন লিস্ট, যা প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রচার করে তালিকাভুক্তদের মতামত/অনাপত্তি নিয়ে চূড়ান্ত জ্যেষ্ঠতা তালিকা করা হয়; খ. পদ শূন্য থাকার শর্তে তালিকা অনুসারে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিসে এ নিয়ম কেন অনুসরণ করা হয় না, তা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে ওই নিয়ম ভেঙে পদোন্নতির যে রেওয়াজ চালু করা হয়েছে, তা বন্ধ করা প্রয়োজন।

৫. হাঁটাচলার পথে বহু বছর ধরে শুনছি, দক্ষতার সঙ্গে সমন্বয় করে পদায়ন করা হবে। বদলির ক্ষেত্রে ক্লাস্টার করা হবে, পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হবে ইত্যাদি। এগুলো এখনো করা হয়নি। বরং তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে বদলি-পদায়ন হাসিল করা হচ্ছে, বদলি ঠেকানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা করতে না পারলে সম্ভাব্যদের মধ্য থেকে অন্তত লটারির মাধ্যমে বদলি-পদায়ন করা যায় অথবা বদলি-পদায়নের ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতা তালিকা ও শূন্য পদের তালিকা Cross Matching করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।

৬. সচিব এবং অন্যান্য সার্ভিসের সমমানের পদের ক্ষেত্রে অবশ্যই জ্যেষ্ঠতা তালিকা অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে Biased Choose and Pick বন্ধ করতে হবে। না হলে সরকারকে পদ বাণিজ্যের বদনাম বহন করতে হবে এবং ঊর্ধ্বতন প্রশাসনে ক্ষোভ বৃদ্ধি পাবে। সরকার এটি করতে চাইলে তাদের আশপাশের ক্ষমতাধর আমলারা প্রবল বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করবে নানা অজুহাতে। উপদেষ্টাদের নিজ বুদ্ধিমত্তার সামর্থ্যে তা অতিক্রম করতে হবে। অন্যথায় ‘যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন’ অবস্থা চলবে।

এ সরকারের প্রধান কাজ সংস্কার আর জুলাই-আগস্ট হত্যার বিচার। আমলাদের রুটিন পদোন্নতির কাজ তাদের বাধ্যতামূলক কাজের মধ্যে পড়ে না। বৈষম্যের শিকার নামে অবসরপ্রাপ্তদের যে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পদোন্নতি দেবেন, সেটা কোন নীতি বা বিধির বলে? আবার কর্মরত কর্মকর্তারাও পদোন্নতি চাচ্ছেন গ্রেডেশন তালিকা আর শূন্য পদ না থাকা সত্ত্বেও। এগুলো বন্ধ রাখতে হবে। উপসচিব, যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে যে সংখ্যক কর্মকর্তা কাজ করছেন, তাতে আগামী তিন বছর পর্যন্ত পদোন্নতি না দিলেও ওই স্তরে কর্মকর্তার ঘাটতি হবে না। যারা আছেন, প্রকৃত পদের বিপরীতে তাদের সংখ্যা সমন্বয় হতে তিন বছরেরও বেশি সময় লাগবে। কাজেই এ সরকারের উচিত ওইসব পদে পদোন্নতি বন্ধ করা। আগে নিয়ম ঠিক করা। অন্যান্য ক্যাডারের বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের ক্ষোভ নিরসন করা। প্রশাসনে বদলি-পদোন্নতিতে নিয়মশৃঙ্খলা আনা এ সরকারের ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি বড় মাইলফলক হতে পারে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষোভ নিরসনের জন্য পিএসসির যৌথ মেধাতালিকা অনুসরণ করা যেতে পারে। অন্য ক্যাডারের ১৫ বিসিএসের কর্মকর্তার ২০ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে পদোন্নতি হবে এমন বৈষম্য চলতে পারে না। হয় তা দূর করুন, নয় সবকিছু বন্ধ রাখুন।

মোহাম্মদ হোসেন : জনপ্রশাসন পর্যবেক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম